সংস্কার কর্মসূচি বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এক প্রতিজ্ঞা বা প্রতিশ্রুতি, যা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্প্রতি শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নানান পেশা, শ্রেণি, রাজনৈতিক দল-গোত্রের ‘প্রতিনিধিত্বশীল’ ব্যক্তি ‘বাছাই’ ও জড়ো করে গঠন করা হয়েছে সংস্কার কমিটি। উদ্দেশ্য, প্রতিষ্ঠানগুলোর বিধিবিধানসমেত অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন, যাতে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ না ঘটে; স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত হয়।
১৯ জন নিয়ে বাংলা একাডেমির জন্যও গঠিত হয়েছে সংস্কার কমিটি। তবে এর গঠন নিয়ে সচেতন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ স্বাগত জানালেও গঠনপ্রক্রিয়া, সদস্যদের অধিকাংশের গ্রহণযোগ্যতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিটির সামর্থ্য ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রথমত, একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, ফেলো এবং জীবন সদস্যদের অনেককে না জানিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ মনে করেন, এই সংস্কারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসিত চরিত্র ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়তে পারে। তৃতীয়ত, বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘদিন ধরে যে দুর্নীতি চলছে, এই কমিটি তা কতটা দূর করতে পারবে—এ নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে।
বলা বাহুল্য নয়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান অনিয়মবৈচিত্র্য ও দুর্নীতিহেতু অকার্যকর হতে শুরু করে। বাংলা একাডেমি খানিকটা ব্যতিক্রম। কারণ, আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মৌলিক কিছু কর্তব্য সম্পাদনে প্রতিষ্ঠানটির গতিশীলতা দেখা যায়, অন্তত যদি বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার প্রসঙ্গ ওঠে। এরপর বাংলা একাডেমি লক্ষ্যচ্যুত হতে হতে এত শোচনীয় দশায় পৌঁছায় যে মূল কাজগুলো বাদ দিয়ে কাণ্ডকর্ম ও অনাবশ্যক ব্যস্ততায় আন্তরিক বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আরও মর্মান্তিক, বিগত সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটি কমিউনিটি সেন্টারের রূপ ‘লাভ’ করে। বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান ছাড়া সবই এখানে ঘটেছে। ফলে যে তিনটি রূপে এটি সর্বজনবিদিত হয়ে ওঠে, সেগুলো হলো ১. গ্রন্থপ্রকাশক ও বিক্রেতা, ২. বইমেলার আয়োজক এবং ৩. ইভেন্ট ভেন্যু।
বাস্তবিক, গুণগত পরিবর্তন ও সময়োপযোগী করে তোলার জন্য এ প্রতিষ্ঠানেরও সংস্কার জরুরি। কিন্তু এ উদ্দেশ্যে যাঁদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কমিটি, ছয়-সাতজন ছাড়া অধিকাংশেরই জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের মতো স্পর্শকাতর, জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের যোগ্যতা নেই। কোন মানদণ্ডে তাঁরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, প্রশ্ন উঠেছে সে সম্পর্কে। নিশ্চয়ই তাঁরা নিজ নিজ স্থানে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু জ্ঞানচর্চার পরিমণ্ডলে জাতীয় বা সামগ্রিকভাবে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নোর্ধ্ব নয়—পরীক্ষিত তো নয়ই। তালিকার দিকে তাকালে সহজে বোঝা যায়, যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা এবং প্রভাবশালী মহলের বিশেষ সংযোগকে অন্তর্ভুক্তির ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এমনকি, রাজনৈতিক বিবেচনার প্রশ্ন যদি ওঠে, তাতেও দেখা যায়, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে স্পষ্ট হয়নি কমিটির কারও কারও অবস্থান। তাঁদের মনোভাব সম্পর্কে এ সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে স্বৈরাচারের পতন না হলেও কোনো সমস্যা নেই; তবে পরিবর্তিত বাস্তবতার সুবিধা নেওয়ার সামর্থ্য ও অভ্যাস তাঁদের রয়েছে। ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগসন্ধানী এই চরিত্রগুলো যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপজ্জনক। গ্রহণযোগ্য যে ছয়-সাতজনকে ১৯ সদস্যের এই কমিটিতে রাখা হয়েছে, তাঁদের কয়েকজন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে রয়েছেন। বাকি দু-চারজনের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে সুযোগসন্ধানী অযোগ্যদের বৈধতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই সমিতি বা কার্যনির্বাহক সভাকে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য। ফলে জোড়াতালির এই লোকদেখানো উদ্যোগ ও কর্মযজ্ঞের ঐতিহ্য থেকে জাতির মুক্তির উপায় সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির নিচে চাপা পড়ে গেল! স্বৈরাচার গেল বটে, তার যন্ত্রপাতি আর অভ্যাসগুলো টিকে রইল।
কমিটি গঠনে রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফরহাদ মজহার, মোহাম্মদ আজম ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মতো প্রভাবশালীর প্রিয়পাত্ররা গুরুত্ব পেয়েছেন বলে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে।
যেকোনো কাজে বা সংস্থায় জোড়াতালি দেওয়া যায় তখনই, উপযুক্ত রিসোর্স যখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। বাংলা একাডেমি সংস্কার কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এমন অজুহাতের সুযোগ নেই। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থানে যেসব লেখক-সাংবাদিক-শিক্ষক-গবেষক-সংস্কৃতিকর্মীর সমর্থন ও অংশগ্রহণ প্রশ্নাতীতভাবেই ছিল, তাঁদের মধ্য থেকে কমিটির সদস্য নির্বাচন জরুরি ছিল। বিবেচনায় রাখা দরকার ছিল এমন ব্যক্তিদের, চিন্তাশীল ও সৃজনসক্ষম হিসেবে সমাজে যাঁরা পরিচিত ও মান্য। কিন্তু তাঁরা সরকারি নন; বিগত সরকারের সুবিধাভোগীও নন। কিন্তু আলোচ্য কমিটির সভাপতি করা হয়েছে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সচিবকে। যেখানে সদস্যসচিব বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। এই দুটি পদে বাইরে থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো লেখক কিংবা গবেষককে নিয়োগ দেওয়াটাই ছিল সমীচীন। তবে অন্যান্য সংস্কার কমিটির বেলায় তা–ই করা হয়েছে।
জুলাইয়ের আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থানে সক্রিয় এবং আওয়ামী লীগের দস্যুতা-নির্যাতন-হত্যা-গুম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখককে এই কমিটি উপেক্ষা করেছে। বিগত শাসনকালে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা যেসব লেখক বাংলা একাডেমি কিংবা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশকে এই কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলা একাডেমি যাঁদের পুরস্কৃত করেছে, তাঁদেরও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাঁরাও উপেক্ষার শিকার।
কমিটির ১৯ জনের মধ্যে ছয়-সাতজন ছাড়া অধিকাংশই সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি—এটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সলিমুল্লাহ খান, ব্রাত্য রাইসু, আহমাদ মোস্তফা কামাল, সাখাওয়াত টিপু ও জাভেদ হুসেনকে নেওয়া হয়েছে কমিটিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। কৌশলটি স্বৈরাচারজাত সংস্কৃতি থেকে গৃহীত বলা যায়। বৈধতায় ব্যবহৃত কয়েকজনকে বাদ দিয়ে অন্যদের নামের তালিকার দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
কমিটি গঠনে রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফরহাদ মজহার, মোহাম্মদ আজম ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মতো প্রভাবশালীর প্রিয়পাত্ররা গুরুত্ব পেয়েছেন বলে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে। অর্থাৎ অবদানের ভিত্তিতে নয়, সম্পর্ক বা সংযোগের জাদুবলে বাছাই করা ব্যক্তিরা এই কমিটিতে জড়ো হয়েছেন। কাজের বেলায় তাঁরা কেমন জড়সড় হবেন, সেটাই এখন দেখার বাকি।
প্রশ্ন ওঠে, কারা অন্তর্ভুক্তির যোগ্য বাংলা একাডেমির সংস্কার কমিটিতে? সংস্কারের মতো সংবেদনশীল, সময়োপযোগী ও ভবিষ্যমুখী কাজে কাদের রাখা হলে মিলতে পারে সাফল্য? এই তালিকা থেকে বাছাই করে গঠন করা যেত বাংলা একাডেমি সংস্কার কমিটি, যেমন বেগম আখতার কামাল, আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, নাসরীন জাহান, ওয়াসি আহমেদ, আন্দালিব রাশদী, জি এইচ হাবীব, রফিকুম মুনীর চৌধুরী, সাজ্জাদ শরিফ, শাহীন আখতার, সেলিম মোরশেদ, রাজু আলাউদ্দিন, জাকির তালুকদার, আকিমুন রহমান, রায়হান রাইন, পাপড়ি রহমান, জেনিস মাহমুন, সিরাজ সালেকীন, সুমন সাজ্জাদ, মাসউদ ইমরান মান্নু, টোকন ঠাকুর, কামরুজ্জামান কামু, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, বিধান রিবেরু, শুভাশিস সিনহা প্রমুখ। উল্লিখিত প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সমকালীন মননচর্চা ও সৃষ্টিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন—সংস্কৃতির অগ্রগমনে এঁদের ভূমিকা প্রশ্নাতীত। অধিকন্তু, এঁদের প্রত্যেকের অন্তর্ভুক্তি জ্ঞানমুখ্য যেকোনো সংস্থা বা উদ্যোগের জন্য কল্যাণকর ও গৌরবজনক হতে পারে। এদিক থেকে ধরলে, বাংলা একাডেমি সংস্কার কমিটি নিরীহ একটি সমিতির মতো হয়েছে। জাতির জন্য এটা অশেষ লজ্জার ঘটনা।
অথচ শ্রেয়তর এই ব্যক্তিদের বাইরে রেখে গঠিত কমিটি থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় আশা করছে, তিন মাসের মধ্যে পাওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলা একাডেমির কার্যক্রমে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)