রেলের আবিষ্কারে কেমন ছিল বিশ্বসাহিত্যের প্রতিক্রিয়া?

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ঊনবিংশ শতক ছিল প্রযুক্তিগত বিপ্লবের যুগ। শিল্পবিপ্লবের পর যে আবিষ্কার মানবজীবনকে সবচেয়ে দ্রুত বদলে দিয়েছিল, নিঃসন্দেহে তা হলো রেলপথ। ১৮২৫ সালে ইংল্যান্ডের স্টকটন-ডার্লিংটন রেলপথে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হয় আর সেখান থেকেই মানবসভ্যতার এক নতুন গতি-অভিযাত্রার সূচনা হয়। বিশালাকার ইঞ্জিন, শিস, ধোঁয়া, কাঁপন—সব মিলিয়ে রেল শুধু যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে থাকেনি; হয়ে উঠেছিল আধুনিকতার প্রতীক। 

ইউরোপের কবি-লেখকেরাও রেলের আবির্ভাবে গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন। ভিক্টর হুগো তাঁর ভ্রমণ নিবন্ধে রেলের গতি ও প্রকৃতির সঙ্গে গতির সংঘর্ষকে এক রোমান্টিক বিস্ময়ের রূপ দিয়েছেন। চার্লস ডিকেন্স একাধিক উপন্যাসে রেলের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর ‘ডমবি অ্যান্ড সন’ উপন্যাসে আধুনিকতার প্রতীক রেলের ধ্বংসাত্মক শক্তিও ফুটে উঠেছে। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস রেলকে দেখেছিলেন শিল্পবিপ্লবের অর্থনৈতিক রূপান্তরের হাতিয়ার হিসেবে। 

জার্মান ও ফরাসি কবিরা রেলের ধোঁয়া, শব্দ ও দ্রুততার মধ্যে দেখেছিলেন সভ্যতার নতুন কবিতা। হাইনরিখ হাইনে রেলকে ‘ইস্পাতের পাখি’ বলেছিলেন আর বোদলেয়ার তাঁর Les Fleurs du Mal-এ যন্ত্রসভ্যতার অন্তর্লীন বিষণ্নতা ও রোমাঞ্চের প্রতিধ্বনি তুলে ধরেছিলেন। এককথায়, রেল ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকতাবাদের প্রথম আভাস জাগিয়ে তোলে।

আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলায় রেলবিষয়ক প্রথম কবিতা লেখেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত— তাঁর ১৮৫৫ সালে লেখা ‘শারদ্বর্ণন’ নামক কবিতাটি। নাটকেও স্থান পায় রেল প্রসঙ্গ। মুন্সী আজিমুদ্দিনের ‘কি মজার কলের গাড়ি’ (১৮৬৩) প্রহসনে দেখা যায়, স্বামীরা রেলের কল্যাণে দ্রুত বাড়িতে ফিরতে পারায় বউদের মুখে হাসি ফুটেছে।
১৮৫৪ সালে বাংলার কোনো এক রেল প্লাটফর্ম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বাংলায় রেলের আগমন ও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া

ভারতে প্রথম রেল চালু হয় ১৮৫৩ সালে, বম্বে থেকে থান পর্যন্ত। এক বছর পর, ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট, বাংলায় প্রথম রেলগাড়ি চলে হাওড়া থেকে হুগলি অবধি। নতুন এই আবিষ্কারকে ঘিরে শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বিস্ময় ও উন্মাদনা। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হতে থাকে রেলের প্রশস্তি, গানের সুরে ভেসে আসতে থাকে যন্ত্রের জয়ধ্বনি। 

ইংরেজি দৈনিক ‘বেঙ্গল হরকরা’য় প্রকাশিত হয়েছিল ‘ফার্স্ট ইমপ্রেশনস অ্যান্ড ফার্স্ট-ইম্পালসেস অব রেলওয়ে ট্রাভেলিং’ নামে একটি কবিতা। পথগায়কেরা রেল নিয়ে গান বাঁধেন, বিভিন্ন স্টেশনে শোনা যেত তাঁদের সুর। এইভাবে রেল মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার নতুন কল্পচিত্র হয়ে উঠেছিল। 

আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলায় রেলবিষয়ক প্রথম কবিতা লেখেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর ১৮৫৫ সালে লেখা ‘শারদ্বর্ণন’ নামক কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে রেলের গতি ও স্বস্তির বোধ—

‘টাকা ছেড়ে থাবড়ায়,             পার হোয়ে হাবড়ায়
                  চালিয়েছে রেলওয়ে পথে।
হুগলির যাত্রী যত,                  যাত্রা করি জ্ঞান হত
                  কলে চলে স্থলে জলে সুখ
বাড়ী নহে বড় দূর,                  অবিলম্বে পায় পুর,
                  হয় দূর সমুদয় দুখ।
তাদের পশ্চাতে দুখ,                 প্রথমে কিঞ্চিৎ সুখ,
                  যাদের নিবাস দূর দেশে।’

১৯৫৬ সালে রেলকে কেন্দ্র করে বর্ধমানের সমারোহ
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

নারীর কণ্ঠেও রেলের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ১৮৫৬ সালে কৃষ্ণকুমারী দাসীর কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তবিলাসিনী’তে রেলকে ঘিরে দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়—‘যমের ক্রন্দন’ ও ‘বিরহিনীর উল্লাস’। ‘বিরহিনীর উল্লাস’ কবিতায় তিনি ইংরেজ সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। কারণ, রেলের কল্যাণে মানুষের স্থানিক দূরত্ব দূর হয়েছে। ফলে প্রিয়জনের বিচ্ছেদে এখন আর ভারাক্রান্ত হতে হয় না।

রেল সাহিত্য

উনিশ শতকের বাংলা কাব্য, নাটক, গান, সাহিত্যে রেলের প্রতিচ্ছবি দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘রেলগাড়ি’ কবিতায় জাতীয় সংহতির স্বপ্ন দেখেছিলেন। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮০ সালে লেখা ‘রেলগাড়ি’ কবিতায় ইংরেজদের আনা পুষ্পকরথের জয়গান গেয়েছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জ্যোতিন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসুসহ প্রায় সবাই রেলকে ঘিরে কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রাতের রেলগাড়ি’ কবিতায় রেল হয়ে উঠেছে চিরকালীন যাত্রার প্রতীক। ‘জীবনস্মৃতি’তে একটা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন—

‘কোনো একটা বড় স্টেশনে গাড়ি লাগিয়াছে। টিকিট-পরীক্ষক আসিয়া আমাদের টিকিট দেখিলেন৷ একবার আমার মুখের দিকে চাহিল, কী একটা সন্দেহ করিল, কিন্তু বলিতে সাহস করিল না। কিছুক্ষণ পরে আর একজন আসিল—উভয়ে আমাদের গাড়ির দরজার কাছে উসখুস করিয়া চলিয়া গেল। তৃতীয়বারে বোধ হয় স্বয়ং স্টেশন মাস্টার আসিয়া উপস্থিত। আমার হাফ টিকিট পরীক্ষা করিয়া পিতাকে জিজ্ঞেস করিল, “এই ছেলেটির বয়স কি ১২ বছরের অধিক নহে?” পিতা কহিলেন, “না।” তখন আমার বয়স ১১। বয়সের চেয়ে নিশ্চয়ই আমার বৃদ্ধি কিছু বেশি হইয়াছিল। স্টেশনমাস্টার কহিল, “ইহার জন্য পুরা ভাড়া দিতে হইবে।” আমার পিতার দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। তিনি ব্যাগ হইতে তখনই নোট বাহির করিয়া দিলেন। ভাড়ার টাকা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট টাকা যখন তাহারা ফিরাইয়া দিতে আসিল, তিনি সে টাকা পাইয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। তাহা প্ল্যাটফর্মের পাথরের মেঝের উপর ছড়াইয়া পরাইয়া ঝনঝন করিয়া বাজিয়া উঠিল।’

এ ঘটনার সময় ১৮৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস।

লোকসাহিত্যেও পড়ে রেলের ছাপ। কবিয়াল রূপচাঁদ পক্ষীর গানে বারবার এসেছে রেলের প্রসঙ্গ—‘মানুষ চলে কলের বলে’। বাউলগানে রেলকে মেলানো হয় দেহতত্ত্বের সঙ্গে—দেহ হয়ে ওঠে কলের গাড়ি, গুরু হয়ে ওঠেন চালক। এভাবে রেল শুধু নগরের সাহিত্য নয়, গ্রামীণ লোকসাহিত্যেও জায়গা করে নেয়। 

১৮৯৮ সালে প্লেগ মহামারি ছড়িয়ে পড়লে সে সময় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়েরে লেখা উপন্যাস ‘ভয়ানক আংটি’তে দেখা যায় যে বিপন্ন সব মানুষ ট্রেনে করে পালিয়ে যাচ্ছে আর শহর হয়ে পড়ছে জনশূন্য।
১৮৭২ সালে জ্যোতিরিঙ্গণ পত্রিকায় প্রকাশিত রেল
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

নাটকেও গুরুত্ব সহকারে স্থান পায় রেল প্রসঙ্গ। মুন্সী আজিমুদ্দিনের ‘কি মজার কলের গাড়ি’ (১৮৬৩) প্রহসনে দেখা যায়, স্বামীরা রেলের কল্যাণে দ্রুত বাড়িতে ফিরতে পারায় বউদের মুখে হাসি ফুটেছে। অপর দিকে, কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘রেলওয়ে রচনা’য় তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের দুরবস্থা—যাদের থেকেই কিনা রেল সবচেয়ে বেশি আয় করে এবং ইংরেজ সরকারের অবহেলা ও বর্ণবৈষম্য ফুটিয়ে তুলেছেন। প্যারীচরণ ও দুর্গাচরণ রায়ের একাধিক রচনায় রেলের দুর্ঘটনা ও দুর্ভোগ প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে। 

বাংলা উপন্যাস-ছোটগল্পেও রেল প্রবেশ করে। যোগেন্দ্রনাথ বসুর ‘মডেল ভগিনী’, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূত ও মানুষ’ এবং প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে রেল নতুন চরিত্র হয়ে হাজির হয়। বিশেষত ১৮৯৮ সালে প্লেগ মহামারি ছড়িয়ে পড়লে সে সময় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়েরে লেখা উপন্যাস ‘ভয়ানক আংটি’তে দেখা যায় যে বিপন্ন সব মানুষ ট্রেনে করে পালিয়ে যাচ্ছে আর শহর হয়ে পড়ছে জনশূন্য।

ঊনিশ শতকে জামালপুরের রেলওয়ে ওয়ার্কশপ
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বিশ্বসাহিত্যে রেল প্রায়ই প্রতীক হয়ে উঠেছে আধুনিকতার, অগ্রগতির, আবার কখনো বিভীষিকার। ডিকেন্স যেখানে দেখেছেন নগরায়নের নির্মম রূপ, হুইটম্যান সেখানে দেখেছেন গণতান্ত্রিক সমবেত শক্তি। বোদলেয়ারের কাছে রেল ছিল নগরজীবনের অস্থিরতা ও শিল্পায়নের কবিতা।

বাংলা সাহিত্যে রেল একই সঙ্গে উচ্ছ্বাস ও বেদনার উৎস। একদিকে ঈশ্বরচন্দ্র, দীনবন্ধু, রবীন্দ্রনাথরা রেলের গতিকে কবিতায় অমর করেছেন; অন্যদিকে কালীপ্রসন্ন সিংহ বা প্যারীচরণ দেখিয়েছেন শোষণ, দুর্ঘটনা, বৈষম্য ও যন্ত্রণার চিত্র। যেখানে ইউরোপে রেল ছিল মূলত শিল্পবিপ্লবের প্রতীক, সেখানে বাংলায় রেল হয়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার অংশ। একদিকে তার বিস্ময় ঠিকই, অন্যদিকে অশেষ বঞ্চনা। বাংলার রেল সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের স্রোতে যুক্ত হলেও ভেতরকার ঔপনিবেশিক ব্যঞ্জনা ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।