এক নান্দনিক জীবনের কথকতা 

আহমদ রফিক

অনেক পরিচয় তাঁর। তবে তাঁর বেশি পরিচিতি ভাষা আন্দোলনের সংগঠক ও রবীন্দ্রগবেষক হিসেবে। এর বাইরে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, সাহিত্য সমালোচক, কবি হিসেবেও তিনি পাঠকের কাছে সুবিদিত। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি একজন পূর্ণকালীন লেখক। রচনা করেছেন শতাধিক মননশীল-গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। বছর তিনেক হলো বয়সজনিত বাস্তবতা ও অনাহূত অসুখবিসুখে তিনি আর কর্মক্ষম নন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষাজীবন শেষ করলেও ‘ইন্টার্ন’ করার সুযোগ না পাওয়ায় চিকিৎসাকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। এককালে বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁকে প্রগতিশীল লেখক-চিন্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। মার্ক্সবাদী চিন্তাকে ধারণ করে তিনি গ্রন্থ প্রণয়নে অগ্রসর হন। তাঁর গ্রন্থ প্রণয়নের বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গি বিচিত্র। স্বজন-সন্তানহীন এই মনীষীর দৃষ্টিশক্তি ও শারীরিক সামর্থ্য দ্রুত পড়তির দিকে। ফলে সৃষ্টিমুখর দীর্ঘ জীবনও যে একসময় দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে, তাঁর কাছাকাছি না গেলে উপলব্ধি করা যায় না। কোভিডের চোখরাঙানি এবং চোখের ক্ষয়রোগ জেঁকে বসার পর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনী দুই মৃত্যুর মাঝে: নান্দনিক একাকিত্বে (২০২১)।

ঘটনাবহুল তাঁর দীর্ঘ জীবনের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। এক ঝোড়ো রাতে মেঘনার বুকে নৌকাডুবির কবলে পড়ে পিতৃবিয়োগ তাঁদের পরিবারকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। পিতাকে নিয়ে তাঁর কোনো স্মৃতি নেই। তিনি লিখেছেন, ‘এত অল্প বয়সী শিশুর তা থাকার কথা নয়। পিতা আবদুল হামিদ আমার চেতনায় একজন অস্তিত্বহীন মানুষ, একটি নামমাত্র, আবার জন্মদাতা। আমার জীবনে তাঁর কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই। যা আছে, তার সবটাই নেতিবাচক।’ এক দিন পর জানা গিয়েছিল নৌকাডুবির খবর। সহযাত্রীর মরদেহ পাওয়া গেলেও তাঁর পিতার হয়েছিল সলিলসমাধি। এই নেতিবাচকতা নিয়ে, নানা চড়াই–উতরাই সত্ত্বেও তিনি নিজেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০০৬ সালে স্ত্রীবিয়োগের ঘটনা তাঁর শেষজীবনকে করে তুলেছে অসহনীয়। পিতা ও স্ত্রীর মৃত্যুর মাঝখানে তাঁর প্রতিকূল অথচ কর্মমুখর যে জীবন, তা-ই মূলত বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামমুখর এক নান্দনিক জীবন।

তাঁর সান্নিধ্য যেকোনো জ্ঞানপিপাসুকে অপার আনন্দ দেয়। তিনি বিশ্বাস করেন, ঘটনাই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। দৃষ্টিশক্তি ও শারীরিক শক্তির ক্ষয়প্রাপ্তি এখনো তাঁর স্মৃতিশক্তিকে আক্রান্ত করতে পারেনি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠায়। স্কুলবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি তীব্র আগ্রহ ছিল তাঁর; সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতেই পড়ে ফেলেন শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, মনোজ বসুর ভুলি নাই, রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি ও গোরা, সিলেক্টেড পোয়েমস অব শেলি অ্যান্ড ওমর খৈয়াম প্রভৃতি। এসব বই পাঠ তাঁকে চিন্তার দিক থেকে অগ্রগামী করে তোলে। ফলে তিনি যা দেখেছেন, তার চেয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন বেশি।

বইটি প্রকাশ করেছে এই সময় পাবলিকেশন্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল থেকেই তিনি রাজনীতিসচেতন হয়ে ওঠেন। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু তাঁর শিশুমনকে আলোড়িত করে। তবে স্কুল বা পাড়া-মহল্লার হৈ–হুল্লোড়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাঁকে টানত না। এর চেয়ে ‘বরং বাড়িতে একা সময় কাটানো ছিল পছন্দসই।’ ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হবে, বিষয়টি তিনি মানতে পারেননি কিশোর বয়সেই। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে তিনি লিখেছেন আস্ত বই—দেশবিভাগ: ফিরে দেখা। তাঁর মতে, একটা নিবার্য বিষয়কে অনিবার্য করে তোলা হয়েছে অদূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। গ্রন্থটিতে তাঁর সময়ের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা এবং সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক মন্তব্য রয়েছে। যেমন ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে নড়াইলের এক আসনে কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী সৈয়দ নওশের আলীকে কীভাবে মুসলিম লীগের উগ্র সমর্থকেরা অহেতুক অশালীন ভাষায় আক্রমণ করেছিল এবং ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বুথ দখল করা হয়েছিল; সেই সব বর্ণনা তুলে ধরেছেন তিনি। তবে এ–ও বলেছেন, ‘এ কথাও সত্য যে বঙ্গদেশের নির্বাচনে হাওয়া মুসলিম লীগের পক্ষেই ছিল। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনেও তাঁদের ছিল জয়ের সম্ভাবনা।’ পঞ্চাশের দাঙ্গা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, কেবল অমুসলিম হলেই কীভাবে দাঙ্গাবাজ উর্দুভাষী বিহারিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরীহ মানুষদের ওপর।

১৯৫০ সালকে তিনি নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক বিচারে ছিল বীভৎস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ভয়াবহ রকম রক্তাক্ত। রেলওয়েতে ছিল উর্দুভাষী বিহারিকুলের প্রাধান্য। তাই সম্ভব হয়েছিল ভৈরব সেতুর ওপর ট্রেন থামিয়ে কামরা থেকে অমুসলিম যাত্রীদের কেটেকুটে মেঘনায় ভাসিয়ে দেওয়া।’ ব্যক্তিগতভাবেই তিনিও পড়েছিলেন খুনিদের কবলে। সৌভাগ্যক্রমে নিয়মিত পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে সেদিন শার্ট-প্যান্ট পরা থাকায় বেঁচে যান। মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই আক্রমণ করে বিহারিরা, ‘কোই শিকার হ্যায়।...পাশের কামরা থেকে আর্তচিৎকার ভেসে আসে।...এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভাবি, ধুতি পরে এলে কী পরিণতি হতো আমার। কোনো প্রতিবাদ সেদিন আমাকে বাঁচাতে পারত না। খুনিদের উন্মাদ চাহনি আর শিকার খোঁজা দীর্ঘদিন আমাকে ঘুমের মধ্যে তাড়া করে ফিরেছে।’

শেরেবাংলা এ কে ফজুলল হককে নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন চমকপ্রদ। ইতিহাস যে সরলরৈখিক নয়, তার প্রমাণ শেরেবাংলার রাজনৈতিক পরিণতি। আহমদ রফিক তাঁকে পরাজিত নায়ক বলেছেন, ‘পরাজিত বলেই জিন্নাহর পাকিস্তানে তিনি পূর্ববঙ্গ সরকারের অধীনে অ্যাটর্নি জেনারেল পদ গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি, তা–ও নাজিমুদ্দীনের মুখ্যমন্ত্রিত্বে।...গোটা পাকিস্তান আমলে হক সাহেবের রাজনীতি ১৯৫৪-এর কিছুটা সময় বাদে পুরোটাই স্ববিরোধী ও আত্মঘাতী, সেই সঙ্গে প্রগতিশীল বাংলার স্বার্থবিরোধী।’ এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন, প্রথম শহীদ মিনার, সমাজে একুশের সর্বজনীন প্রভাব, মুক্তিযুদ্ধকালের ঢাকা, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, বিজয়, শোকাবহ আগস্ট প্রভৃতি থেকে শুরু করে ব্যক্তি ও সমাজজীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও বিশ্লেষণ উঠে এসেছে তাঁর এ বইয়ে। তাই গ্রন্থটি আহমদ রফিকের আত্মজীবনী হলেও ঐতিহাসিক নানা উপাদানে ভরপুর।

আত্মজীবনী হলেও আত্মসমালোচনাও করেছেন বইয়ের শেষ দিকে। জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতার সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অন্তর্মুখিতার সূত্র খুঁজতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমার যুক্তিসংগত বিশ্বাস, আমার অন্তর্মুখী স্বভাব, দুর্বল ব্যক্তিত্ব প্রধানত পিতৃজিন প্রভাবিত বলে মনে হয়।...যে কারণে পরবর্তী জীবনে স্বভাবে জন্ম নিয়েছে একধরনের উদাসীনতা বা একাকিত্ববোধ।’

এই ‘নান্দনিক একাকিত্ব’ সত্ত্বেও নতুন লেখক ও তরুণদের জন্য তাঁর দুয়ার বরাবরের মতো এখনো উন্মুক্ত। তাঁর প্রত্যাশা, তারুণ্যের ওপর ভর করে বাংলাদেশ একসময় অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। জন্মদিনে তাঁর নীরোগ জীবন কামনা করি।