দেশি–বিদেশি সাহিত্যে হাঁস নিয়ে তুলকালাম
হাঁস বা রাজহাঁস পাখি হিসেবে যেমন স্থল ও জল দুই জায়গাতেই বিচরণ করতে পারে, তেমনি বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যে এই পাখিকে নিয়ে রূপকার্থে বা রূপক হিসেবে ব্যবহার করে লেখা হয়েছে বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাস, কবিতাও। প্রখ্যাত ডেনিশ লেখক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ‘কুৎসিত হাঁসের ছানা’ রূপকথার গল্পটি আমাদের অনেকেরই শৈশবে পড়া আছে। আবার জীবনানন্দ দাশের ‘বুনো হাঁস’ কবিতায় হাঁসকে প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং যাযাবরজীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে খুঁজে পায় কবিতাপ্রেমী পাঠক।
বাংলা উপন্যাসে রাজহাঁসকে একটি প্রতীকী উপাদান হিসেবে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো এটি সৌন্দর্য, আভিজাত্য বা রূপকথার গল্পের অংশ, আবার কখনোবা জীবনের দুঃখ-কষ্ট, লোভ-লালসা বা ভাগ্যের পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে এসেছে।
বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে উপন্যাসে রাজহাঁসের উপস্থিতি বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। রাজহাঁস প্রায়ই রূপকথার গল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে আসে। এটি জাদু, ঐশ্বর্য বা রূপান্তরের প্রতীক হতে পারে।
রাজহাঁস কখনো কখনো প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং জীবনের সরলতাকে উপস্থাপন করে। উপন্যাসে এর উপস্থিতি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বা জীবনের গভীরতা বোঝাতে পারে।
কিছু গল্পে, রাজহাঁস অতিরিক্ত লোভ বা আকাঙ্ক্ষার পরিণতি হিসেবে আসে। যেমন, ‘ঈশপের গল্পের রাজহাঁস’ বা ‘সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস’–জাতীয় গল্পে অতি লোভের ফলস্বরূপ মানুষ যে বেশির ভাগ সময়ের ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়ে, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
কিছু গল্পে, রাজহাঁস অতিরিক্ত লোভ বা আকাঙ্ক্ষার পরিণতি হিসেবে আসে। যেমন, ‘ঈশপের গল্পের রাজহাঁস’ বা ‘সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস’–জাতীয় গল্পে অতি লোভের ফলস্বরূপ মানুষ যে বেশির ভাগ সময়ের ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়ে, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এভাবেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজহাঁস বিদ্রূপাত্মকভাবে সমাজের কিছু দিক বা মানুষের চারিত্রিক দুর্বলতা ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহৃত হয়।
কিছু ক্ষেত্রে রাজহাঁস রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা ক্ষমতা, পরিবর্তন বা সমাজের অস্থিরতাকে নির্দেশ করে।
জীবনানন্দ দাশের ‘বুনো হাঁস’ কবিতায় হাঁস প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং যাযাবরজীবনের প্রতিচ্ছবি। কবিতাটিতে বুনো হাঁস ‘অজস্র-অপার’ হয়ে রাত্রির আকাশে ওড়ে, যা পাঠককে প্রকৃতির বিশালতা এবং প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের সঙ্গে একাত্ম করে তোলে। এখানে হাঁসের ওড়াউড়ি প্রকৃতির এক ছন্দময় দৃশ্য তৈরি করে, যা জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য।
অন্যদিকে জয় গোস্বামীর কবিতায় হাঁস গ্রামীণ জীবনের চিত্রকল্প তৈরি করে। ‘শুভ জন্মদিন কবি’ ও ‘হাঁস’ কবিতায়, হাঁসকে ‘চই-চই’ বলে ডাকার মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবেশে নারীর হাঁস ডাকার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা নস্টালজিক ও আবেগঘন অনুভূতি তৈরি করে।
বিশ্বসাহিত্যে হাঁসের চেয়ে রাজহাঁস বা সোয়ান নিয়েই অনেক বেশি কাজের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিতি পেয়েছে সম্ভবত ই বি হোয়াইটের ‘দ্য ট্রাম্পেট অব দ্য সোয়ান’ উপন্যাসটি।
ই বি হোয়াইটের ‘দ্য ট্রাম্পেট অব দ্য সোয়ান’ এক অনন্য শিশুতোষ উপন্যাস, যার প্রধানতম চরিত্র ধরা যায় লুই নামের এক বোবা রাজহাঁসকে। জন্ম থেকেই কথা বলতে না পারলেও লুইর ভেতর জেগে থাকে স্বপ্ন ও জীবনের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। ওর মা–বাবা ওকে রক্ষা করতে সর্বদা উদ্বিগ্ন, কিন্তু প্রকৃত শক্তি লুই নিজের ভেতর থেকেই খুঁজে নেয়। একদিন ছোট্ট মানবশিশু স্যাম বিবার তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, আর সেই বন্ধুত্ব লুইর জীবনে খোলে নতুন দিগন্ত।
রাজহাঁস লুইর প্রেমও আসে, সেরিনা নামের এক সুন্দর রাজহংসীর প্রেমে পড়ে ও। ওকে কাছে পেতে হলে লুইকে নিজের স্বর খুঁজে পেতেই হয়। তখনই ট্রাম্পেট আসে তার জীবনে, যার সুর হয়ে ওঠে তার ভাষা। সংগীতের মাধ্যমে সে অর্জন করে ভালোবাসা, স্বাধীনতা ও মর্যাদা।
উপন্যাসে কেবল লুইর সংগ্রাম নয়, বরং স্যামের সহমর্মিতা, সেরিনার মায়াময় উপস্থিতি এবং পিতামাতার যত্ন মিলেমিশে তৈরি করে এক আবেগঘন চিত্রপট। হোয়াইট দেখিয়েছেন, প্রকৃতি, সংগীত ও আন্তরিকতার মেলবন্ধনে প্রতিটি প্রাণ খুঁজে নিতে পারে তার নিজস্ব সুর।
‘দ্য ট্রাম্পেট অব দ্য সোয়ান’ শেষ পর্যন্ত শেখায়, সীমাবদ্ধতা নয়, বরং স্বপ্ন ও অধ্যবসায়ের দীপ্তিই প্রতিটি জীবের আসল পরিচয়।
চীনা বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক জুং চ্যাংয়ের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘ওয়াইল্ড সোয়ানস: থ্রি ডটারস অব চায়না’ একদিকে ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, অন্যদিকে বিশাল এক ঐতিহাসিক ক্যানভাস। বইটিতে তিন প্রজন্মের নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন লেখক চ্যাংয়ের নানি ইউ-ফাং, মা ডে-হং এবং লেখক নিজে। এখানে তাঁদের জীবনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে বিশ শতকের চীনের নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে।
এমনকি হাঁসের ছানারাও ওকে দেখে উপহাস করত, মিশতে চাইত না কেউ। এটা নিয়ে সেই ‘কুৎসিত হাঁসের ছানা’টিরও দুঃখের শেষ ছিল না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ও ধীরে ধীরে পরিণত হয় সুন্দর এক রাজহাঁসে, যে কিনা ছিল সেই এলাকার সবচেয়ে সুন্দর রাজহাঁস।
ইউ-ফাং ছিলেন এক সামন্ত প্রভুর উপপত্নী, যাঁর জীবনে শিকলবদ্ধ নিয়তি ও অবমাননা যেন একই সঙ্গে নির্মমভাবে বিরাজ করছিল। তাঁর মেয়ে ডে-হং, চ্যাংয়ের মা, কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং বিপ্লবী উত্থানের সঙ্গী হন, যদিও সেই পথও ছিল বেদনাদায়ক। আর লেখক জুং চ্যাং নিজে বেড়ে ওঠেন মাও সে–তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভয়াবহ সময়ে, যেখানে স্বপ্ন ও স্বাধীনতা বারবার দমিত হয়েছে।
এই তিন নারীর গল্প কেবল পরিবারকেন্দ্রিক কাহিনি নয়, বরং আধুনিক চীনের সংগ্রাম, নিপীড়ন ও আশার প্রতিচ্ছবি।
জুলিয়েট মেরিলিয়ারের মনোমুগ্ধকর ফ্যান্টাসি উপন্যাস ‘ডটার অব দ্য ফরেস্ট’ আসলে সোরচা নামের এক সাহসী তরুণীর গল্প। ক্ল্যাসিক রূপকথার গল্প ‘দ্য সিক্স সোয়ানস’ কাহিনিকেই নতুন করে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে উপন্যাসে রূপ দেওয়া হয়েছে এখানে। সোরচা সাত ভাই—লিয়াম, ডিয়ারমিড, কাথাল, কোনর, ফিনবার, প্যাড্রিক ও শনের কনিষ্ঠ বোন এবং তাদের স্নেহেই তার পৃথিবী গড়ে ওঠে। কিন্তু সৎমা লেডি ওনা এক ভয়ংকর জাদু প্রয়োগ করে ছয় ভাইকে রাজহাঁসে রূপান্তরিত করে। তাদের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো সোরচার অবিশ্বাস্য আত্মত্যাগ—নীরব থেকে কাঁটাঝোপ দিয়ে শার্ট বুনতে হবে, যতক্ষণ না অভিশাপ ভাঙে।
এই দুর্বিষহ যাত্রায় সোরচা পরিচিত হয় ব্রিটিশ যোদ্ধা রেডের সঙ্গে, যে পরে হয়ে ওঠে তার জীবনের অবলম্বন। এই প্রেম ও দায়িত্বের দ্বন্দ্ব, কষ্টকর নীরবতা এবং অমানবিক পরীক্ষার ভেতর দিয়েই সোরচার চরিত্র গড়ে ওঠে দৃঢ় ও দীপ্তিময়।
‘ডটার অব দ্য ফরেস্ট’ কেবল জাদুর গল্প নয়, বরং পরিবার, প্রেম ও আত্মত্যাগের এক হৃদয়স্পর্শী উপাখ্যান।
সবার শেষে অবশ্যই বলতে হবে, ডেনমার্কের বিশ্বখ্যাত রূপকথার গল্পকার হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ‘দ্য আগলি ডাকলিং’ বা ‘কুৎসিত হাঁসের ছানা’ গল্পটির কথা। এটি ছোট একটি গল্প, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী এর বক্তব্য। এখানে দেখা যায়, একটা হাঁসের ছানা জন্মের পর দেখতে ‘অসুন্দর’ ছিল বলে আশপাশের সব হাঁস, এমনকি হাঁসের ছানারাও ওকে দেখে উপহাস করত, অপছন্দ করত, মিশতে চাইত না কেউ। এটা নিয়ে সেই ‘কুৎসিত হাঁসের ছানা’টিরও দুঃখের শেষ ছিল না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ও ধীরে ধীরে পরিণত হয় সুন্দর এক রাজহাঁসে, যে কিনা ছিল সেই এলাকার সবচেয়ে সুন্দর রাজহাঁস, যাকে দেখে মুগ্ধ ও চমৎকৃত হয় মানুষ ও বাকি হাঁসেরাও।
এটি আমাদের যেন অজান্তেই সেই অনুপ্রেরণাই দেয় যে আমাদের অতীত ও বর্তমান যা–ই হোক না কেন, আমাদের ভবিষ্যৎ হতে পারে দারুণ সুন্দর। আমিই একসময় পরিণত হতে পারি ‘আমার সেরা আমি’-তে। কাজেই কে কী বলছে, কে কী করছে, সেটা কানে না তুলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে সামনে!