মুরুব্বি মুরুব্বি, উঁহুহু—এ বছরের প্ল্যান কী

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

২০২৫ সাল ঘিরে কতজনের কত পরিকল্পনা, কত আশা। সবকিছু নিয়েই আমাদের জীবনে নতুন বছর আসে

‘বন্দী, তুমি আমার কাছে কীরূপ ব্যবহার আশা করো?’

‘রাজার প্রতি রাজার ব্যবহার।’

‘এত বড় দুঃসাহস!’

প্রজার প্রতি রাজার ব্যবহারও তো পাচ্ছি নে। ‘পাওয়ার’ আর আছেই-বা কী! ও শব্দটা পর্যন্ত আপনাদের দখলে চলে গেছে! ‘আওয়ার’ বলতেও আর কিছু বাকি নেই। ওতে দুঃখ নেই, আমরা নাহয় ‘মাই’, ‘মাই’ করেই আপন প্রাণ বাঁচাব। আরে ভাই! তা-ও যদি ‘মিউ’, ‘মিউ’ করে বলতে হয় তাহলে প্রজার আর রইল কী? 

সত্য এই, সংসারে কিছুই থাকে না। থাকবি না ভালো কথা; যাবি যদি যা, তাই বলে ফিরে আসবি না? 

চিরসত্য এই, জ্যামুক্ত তির, দোহন করা দুগ্ধ, মুখের কথা, ঝেড়ে ফেলা সর্দি এবং সময় কদাপি আপন স্থানে প্রত্যাবর্তন করে না। 

যেমন ধরুন, চব্বিশ চলে গেল; আপনি তো কোন ছার, পৃথিবী জীবদ্দশায় তাকে আর পাবে না। অথচ কত আশা নিয়ে সে এসেছিল। বরণের সেকি বাহার! মোড়ে, পাড়া-মহল্লায়, বাড়ির ছাদে আকাশটা চিরে, নক্ষত্রগুলোকে ভড়কে দিয়ে একেবারে তারায় তারায় রটিয়ে দেওয়া ব্যাপার! সামাল দিতে তেড়ে উঠে পুলিশের বড়বাবুকে পর্যন্ত হুংকার ছাড়তে হয়েছে। তিনি বারবার স্মরণ করিয়েছেন, মুরুব্বি মুরুব্বি, উঁহুহু—নো পটকা, নো ফানুস। 

কে শুনছে সে কথা! ডাইনিং টেবিলে বাবা ছেলের কাছে জানতে চান, ‘এ বছরের প্ল্যান কী, ভেবেছ কিছু?’ 

ছেলে যে সারা দিন ভাবনার কথাই ভাবে বাবা জানবে কোত্থেকে? সে মুখ বুজে খায়, ঘাড় গুঁজে ফোন টেপে। মাথা না তুলেই বলে, ‘এবার সেমিস্টার ফাইনাল মিস করব না। আই প্রমিজ।’ 

বাবা বিস্ময়ে বিষম খান! মনে পড়ে, ছেলে গতবারও একই কথা বলেছিল। পানির গ্লাস খোঁজার আগে তিনি সান্ত্বনা খুঁজে পান, যাক্, ছেলে অন্তত ভদ্র হয়েছে। ভদ্রলোকের এককথা!

ওদিকে ভাবনা মেসেঞ্জারে নক করছে, ‘কী হলো, প্ল্যানটা বলবে তো?’

ধারাভাষ্যকারও এ সময় বোলহারা হতে বাধ্য। বাবা বাঁয়ে বসে। ছেলের হঠাৎ অনলাইন ক্লাসের কথা মনে পড়ে। সে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। 

‘এই বলো না, নতুন বছর তুমি আমাকে কী দেবে?’ ভাবনা জানতে চায়।

‘তুমিই বলো কী চাও, ছেলে না মেয়ে?’

এরপর ভিখারির ডাকাত হওয়ার সাধ—অ্যাংরি ইমেজে উবে যায় ঠিকই, কিন্তু মেসেঞ্জারের সবুজ বাতিটা দপ করে নিভে যায় না। 

‘কাল আসতে পারব না, যাও।’ 

‘অসম্ভব, এক বছর তোমাকে না দেখে থাকতে পারব না।’

‘মানে?’

‘৩১ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি—এক বছরই হয়।’ 

‘ওলে আমার বাবুসোনাটা!’

এরপর বন্ধ ঘরে সময় দ্রুত বেগে ধায়। লাল শাড়ি, উঁহু নীল, না না না স্কাই ব্লু, সাদা টিপ, হাতিরঝিল, না না বসুন্ধরা সিটি—কথার ফুলঝুরি ফুটতেই থাকে। তবু কথা ফুরায় না। রাত ফুরিয়ে আসে। এর ভেতরেই চলতে থাকে ইভেন্টগুলোতে লাইক দেওয়া। থার্টি ফার্স্ট নাইট স্মরণীয় করে রাখতে আমরা যাচ্ছি ছেঁড়াদ্বীপ। জয়েন আস হারি আপ। হইহুল্লোড় মাস্তি।

এ ধরনের ইভেন্টে লাইক না দিলে বন্ধুরা কী ভাববে! মন নাচুনে বুড়ি, তার ওপর ঢোলে বাড়ি।

‘মাম্মা, যাইবা নাকি কও।’ 

‘যামু না মানে! তোরা যাবি?’

‘আবার জিগায়!’

পরিকল্পনা প্রাণীরাও করে। মাকড়সাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘পঁচিশে কী করবে ভাবছ?’

মাকড়সা বলল, ‘ভাবছি ফেসবুকে এ বছর অন্তত দিনে পাঁচ ঘণ্টা সময় কম কাটাব।’

এমন শত পরিকল্পনা নিয়েই আমাদের জীবনে নতুন বছর আসে। সেই কল্পনা কতটা পাকে, আর কতটা পোকা খায়, সে হিসাব সময়ের কাছে থাকে। কিন্তু যে পরিকল্পনা থেকে ‘পরি’ উড়ে যায় তার থাকে কেবল ‘কল্পনা’; মানে ‘পরি’ বিযুক্ত ‘কল্পনা’র ঘটে অকালমৃত্যু। সে আর ফেরে না। চব্বিশও ফিরবে না। এ সময় ‘বছরটা দেখতে দেখতে চলে গেল’ যাঁরা বলেন, তারাই খাঁটি ভদ্রলোক। স্মরণ করে দেখুন, ফি বছর তাঁরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একই কথা বলছেন। এখন তাঁদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কেমন গেল চব্বিশ?’ তাঁরা বলবেন, ‘তেইশের চেয়ে খারাপ কিন্তু পঁচিশের চেয়ে ভালো।’ 

এ হলো আশা। এই আশাতেই মানুষ বাঁচে, যতক্ষণ সে বেঁচে থাকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তা-ই বলেছেন। একবার তিনি গাড়িতে বসে আছেন। দেহে জটিল রোগ বাসা বেঁধেছে। জীবনের শেষ ধাপ। হঠাৎ এক বৃদ্ধ হকার এসে বললেন, ‘বাবু কিছু নিন। ঘরে খাবার নেই।’  

শরৎচন্দ্র দুই টাকা বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এক টাকা তোমার। আরেক টাকা তোমার খোদার নামে।’

খুশি হয়ে বৃদ্ধটি বললেন, ‘জিন্দা রহো বাবুসাব!’

শুনে শরৎচন্দ্র মৃদু হাসলেন। আপনমনেই বললেন, ‘বেঁচে থাকার কথাই তো এ বলছে। জীবনের শেষ ক্ষণটি পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকব।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘যা অনিবার্য তা দ্রুত ঘটে যাওয়াই ভালো।’ চব্বিশ যাবে, পঁচিশ আসবে—এই বিধান। সুতরাং পঁচিশের দ্রুত আসাটাই ভালো। কিন্তু এ এমনই এক ভবঘুরে সরদার যে সময়ের আগে কিছুতেই আসবে না, আসেও না। অতএব প্রজার উচিত সময়ের প্রস্তুতি সেরে রাখা। এখন সরল মনে কেউ যদি জানতে চান, ‘দেশটা কোন দিকে যাচ্ছে, বলুন তো?’

আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, ‘কেন, দুই হাজার পঁচিশের দিকে।’ 

সবশেষে একটা আলেক্সেই আন্দ্রেয়েভের কৌতুক। দুজনের কথোপকথন:

‘কবে থেকে আমরা সুখে থাকব, বলতে পারেন?’

‘আমরা কারা?’

‘ধরুন আমি।’

‘আপনার বয়স কত?’

‘চল্লিশ।’

‘স্বপ্ন দেখা বাদ দেন।’

‘যদি আমার সন্তানদের কথা বলি?’

‘তাদের বয়স কত?’

‘দশ আর পনেরো।’

‘দুরাশা!’

‘নাতি-নাতনিরা?’

‘আহ! কেন ঘ্যান ঘ্যান করছেন!’

‘আচ্ছা, আপনার কথাই বলুন না।’

‘অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা করছেন।’

‘তাহলে কী নিয়ে চিন্তা করব?’

‘কিছু নিয়েই নয়। কাজ করুন কাজ।’

‘কেন?’

‘ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের কথা ভেবে।’

‘কার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি?’

‘উফ! এত স্বার্থপর আপনারা!’