আদিম জীবন

আদিম ছবির দৃশ্যে বাদশা ও সোহাগী

বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখু আর পাঁচী চরিত্র দুটি আজও আমাদের মনে দাগ কেটে আছে। যুবরাজ শামীমও সেই গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে কাম, ক্রোধ, লোভ, ক্ষুধা, আকাঙ্ক্ষা সর্বস্ব জৈবিক জীবনকে বিষয় করে তুলেছেন তাঁর প্রথম ছবি আদিম-এ।

আদিম-এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ঢাকার অদূরে রেললাইনের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক বস্তিতে। সোহাগী, কালা, ল্যাংড়ার মতো একগুচ্ছ চরিত্রের জীবনে সেই আদিম প্রবৃত্তিগুলোর স্বরূপই এ ছবির বিষয়। নিজের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত উপলব্ধি থেকে চরিত্রগুলোর জীবনের রসায়ন উপস্থাপনের চেষ্টা ছবিটিতে লক্ষণীয়। বস্তিবাসীর দিনানুদৈনিক টানাপোড়েন, সুখ, আনন্দ, কামনা, বাসনার সজীব অভিজ্ঞতা দর্শক হিসেবে আমাদেরও হয়।

জীবন ও চলচ্চিত্রের বাস্তবতার মধ্যকার নান্দনিক ফারাক সমন্বয়ের চেষ্টা চলচ্চিত্রের উষালগ্ন থেকেই লক্ষ করা যাবে। রবার্ট ফ্ল্যাহার্টির নানুক অব দ্য নর্থ থেকে আব্বাস কিয়ারোস্তামির ক্লোজআপ পেরিয়ে হাল আমলের বাংলাদেশের কামার আহমাদ সাইমন বা হুমায়রা বিলকিসের চলচ্চিত্রেও তা আছড়ে পড়েছে। কাহিনিচিত্রের অন্যতম উপাদান চরিত্র। সেই চরিত্র যদি নেওয়া হয় সরাসরি জীবন থেকে, আর চলচ্চিত্রটি যদি হয় সুনির্মিত, তাহলে সেটি হয়ে ওঠে জীবনের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি। যুবরাজ শামীমের এই প্রচেষ্টাই সাধুবাদ জানানোর মতো।

স্বাধীন চলচ্চিত্রের অনাড়ম্বর, বাস্তবানুগ, চরিত্রসংলগ্ন বৈশিষ্ট্য আদিম চলচ্চিত্রে স্পষ্ট। পরিচালক গণচাঁদা সংগ্রহ করে সেই টাকায় চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছেন। এই দায়িত্ববোধের চাপই বোধ করি আদিমকে এতটা প্রাণবন্ত, জীবন্ত আর আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

বয়ানের যে ছক কষে নির্মাতা চরিত্রগুলোর আদিম আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় ঘটিয়েছেন, তার মধ্যে কিছু অসামঞ্জস্যও অবশ্য চোখ এড়ায় না। জীবনের অজানা অতৃপ্তির মধ্যে সম্পর্কের আবর্ত মানুষের ভাগ্যকে যে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়, সোহাগী চরিত্রে আমরা তা দেখতে পাই। চটুল ও সুচতুর ল্যাংড়ার আহ্বানে কালাকে ছেড়ে সোহাগী অনিশ্চিত জীবনে পাড়ি জমায়। কিন্তু সোহাগীকে নিয়ে পরিচালকের চোর-পুলিশ খেলাটি ঠিকমতো দানা বাঁধেনি।

জানি না, যুবরাজ শামীম আগে থেকেই চলচ্চিত্রটির সাদা–কালোয় তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন কি না। জীবনের বাঙ্‌ময়তাকে রূঢ় বাস্তবতায় ঠেলে দেওয়ার জন্য সাদা–কালোর ব্যবহার ইদানীং চলচ্চিত্রের এক ক্লান্তিকর প্রবণতা হয়ে উঠছে।

কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আদিম প্রদর্শিত হয়েছে। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃতও হয়েছে। গণ–অর্থায়নে, স্বল্পতম বাজেটে, দিনের পর দিন বস্তি ও রেলস্টেশনে কাটিয়ে যুবরাজ শামীম এ ছবির রসদ জোগাড় করেছেন, ছবিটি বানিয়েছেন। সেই প্রচেষ্টারই প্রতিদান এ ছবির সাফল্য। যুবরাজ শামীমকে অভিনন্দন।

ছবিটি সম্প্রতি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকিতে মুক্তি পেয়েছে।