চা-বাগানের অনেক গল্প দলিল-দস্তাবেজে থাকে। আবার অনেক গল্প টিকে থাকে স্মৃতির ভেতর—চা-কারখানার গন্ধে, শৈশবের কোনো ঘুমপাড়ানি গানে বা সেই আয়ার মুখে, যিনি একসময় ছোট্ট ছেলেটিকে কোলে নিয়ে ঘুরতেন।
এ লেখা মাইকেল স্টোরিয়ারের। ৫০ বছর পর তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসার গল্প।
হঠাৎ জানতে পারলাম, ডানকানের পুরোনো প্ল্যান্টার জিম স্টোরিয়ারের ছেলে মাইকেল আলীনগর চা-বাগানে এসেছেন। তাঁর বাবা ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এখানে ম্যানেজার ছিলেন। মাইকেল তখন মাত্র আট বছর বয়সে দেশ ছেড়েছিলেন। চা-ইতিহাসে আমার আগ্রহ আছে, তাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম, তাঁর বাবা সম্পর্কে একটি ছোট লেখা লিখব। কিন্তু কথা বলতে বলতে গল্পটি আরও গভীর হয়ে উঠল।
মাইকেল তখন বাংলাদেশ ঘুরছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৬২ সালে, ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। অনেক বছর পর নিজের জন্মভূমিতে ফিরে এসে তাঁর ভেতরে নানা আবেগ জেগে উঠেছিল। ফোনে বললেন, এই সফরটা তাঁর কাছে ‘অবিশ্বাস্য রকম আবেগপূর্ণ’। মানুষ যেভাবে তাঁর মা–বাবাকে মনে রেখেছেন আর যেসব বাগানে তিনি ছোটবেলায় দৌড়াতেন, এসবই তাঁকে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
এরপর এল সবচেয়ে ছোঁয়াচে মুহূর্তটি।
আলীনগরে এক নারী এলেন, দূর পথ পাড়ি দিয়ে।
তিনি ছিলেন মাইকেলের ছোটবেলার আয়া।
হঠাৎ জানতে পারলাম, ডানকানের পুরোনো প্ল্যান্টার জিম স্টোরিয়ারের ছেলে মাইকেল আলীনগর চা-বাগানে এসেছেন। তাঁর বাবা ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এখানে ম্যানেজার ছিলেন। মাইকেল তখন মাত্র আট বছর বয়সে দেশ ছেড়েছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৬২ সালে, ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে।
তেলিয়াপাড়া থেকে আলীনগরে আসার সময় মাইকেলের বয়স ছিল মাত্র দুই। তবু সেই বন্ধন ৫০ বছর পরও টিকে আছে। মাইকেল তাঁকে বললেন, তিনি একটা ঘুমপাড়ানি গান মনে করতে পারেন—‘নিনি বাবা নিনি...’
আয়া সঙ্গে সঙ্গে গানটা পুরোটা গেয়ে শোনালেন।
দুজনের চোখেই পানি চলে এল। দুজনই বসে বসে কাঁদছেন।
চা-বাগানের ইতিহাসে মানুষের এমন গভীর সম্পর্ক খুব কমই দেখা যায়—এক প্ল্যান্টারের ছেলে আর তাঁকে একসময় কোলে নিয়ে মানুষ করা আয়া, এত বছর পর আবার একই সুরে মিলিত।
আলীনগর কারখানায় ম্যানেজার রফিউল আলমের সঙ্গে হাঁটার সময় তাজা চায়ের গন্ধ মাইকেলকে ১৯৬০-এর দশকে ফিরিয়ে নিল। বাংলা, হিন্দি, উর্দু—যে ভাষাগুলো একসময় তিনি সাবলীল বলতেন, সেগুলো ভুলে যাওয়ার আক্ষেপও প্রকাশ করলেন।
তবু যাঁদের তিনি পেলেন, যেসব পথ আবার হাঁটলেন—সব মিলিয়ে তিনি যেন নতুন করে নিজের শৈশবকে ফিরে পেলেন। সুরমা উপত্যকা যেন চুপচাপ তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছিল।
বিদেশে ফিরে যাওয়ার আগে তিনি তাঁর আয়ার সঙ্গে তোলা একটি ছবি পাঠালেন—ইতিহাস আর বর্তমান কীভাবে নরম ভাঁজে মিলেমিশে যায়, তার এক নিদর্শন।
আজ বিকেলে লো মেরিডিয়েন হোটেলের লবিতে তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা হলো—আমার ও ন্যাশনাল টি কোম্পানির সাবেক কর্মকর্তা মানজুর হোসেনের সঙ্গে। অনেক বিষয়ে কথা হলো—চা, স্মৃতি আর সময়ের তৈরি অদ্ভুত সব যোগসূত্র।
মাইকেল বললেন, আগামী সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে ফিরে স্কটল্যান্ডে ফিনলের সাবেক ‘নাম্বার ওয়ান’ বিল পেট্রির বাসায় এক আড্ডায় যাচ্ছেন তাঁর ৮৭ বছরের মাকে নিয়ে।
আরও জানালেন, তিনি একসময় ডানব্লেনে থাকতেন, যে শহরে ফিনলের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা থাকতেন। আমি নিজেও বহুবার গেছি সেখানে।
তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে মনে হলো, চা-ঐতিহ্যের আরেকটি হারানো অংশ যেন জায়গামতো বসে গেল।
এ গল্প আসলে বড় একটি আখ্যানের শুরু।
আগামী সপ্তাহগুলোতে তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁর বাবা ও চাচা সম্পর্কে আরও তথ্য, ছবি ও স্মৃতি পাঠাবেন।
সেখান থেকে তৈরি হবে আরেকটি গল্প।