উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কয়েকজন মহান কথাসাহিত্যিক রুশ সাহিত্যের চেহারা আগাগোড়া বদলে দিয়েছিলেন। সাহিত্যে যে অসামান্য সব সৃষ্টি তাঁদের হাত দিয়ে হয়েছিল, রাশিয়ার সীমানা ছাপিয়ে সেসব সারা বিশ্ববাসীকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০), ফিওদর দস্তয়েভস্কি (১৮২১-১৮৮১) আর আলেক্সান্দার পুশকিন (১৭৯৯-১৮৩৭) তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তলস্তয় বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তাঁর পুরো নাম লেভ নিকোলায়েভিচ তলস্তয়। ১৮২৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার তুলা প্রদেশে তাঁর জন্ম। তাঁর লেখা ওয়ার অ্যান্ড পিস, আন্না কারেনিনা, রেজারেকশন এখনো বিশ্বসাহিত্যে সেরা সম্পদ।
তলস্তয় শুধু উপন্যাসের মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখেননি; গল্প, নাটক ও প্রবন্ধেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর রচনাসমগ্র ৯০ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। রাশিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশ তলস্তয়কে নিয়ে চর্চা করেছে, তাঁকে নিজেদের মধ্যে অমর করে রেখেছে। ডাকটিকিট প্রকাশ তার মধ্যে অন্যতম।
তলস্তয়কে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নই ১৯৩৫ সালে প্রথম তিনটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। তলস্তয়ের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ওই ডাকটিকিটগুলোর মূল্যমান ছিল যথাক্রমে ৩, ১০ ও ২০ কোপেক (রাশিয়ার মুদ্রা, ১০০ কোপেকে ১ রুবল)। সোভিয়েত চিত্রশিল্পী জাভিয়ালোফের নকশায় তিনটি ডাকটিকিটে উঠে আসে তলস্তয়ের বিভিন্ন বয়সের প্রতিকৃতি। ডাকটিকিটগুলোর ক্যাটালগ নম্বর: স্কট-রাশিয়া ৫৭৭-৫৭৯। এই তিন ডাকটিকিট ছাড়াও রাশিয়া তলস্তয়কে স্মরণ করেছে আরও সাতটি ডাকটিকিট ও একটি স্যুভেনির শিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
তলস্তয়কে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বার ডাকটিকিট প্রকাশ করে ১৯৫৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, তাঁর ১২৫তম জন্মদিন উপলক্ষে। এক রুবল সমমূল্যের কালচে বাদামি রঙের ওই টিকিটে দেখা যায় লিও তলস্তয় নিবিড় মনোযোগে লিখে চলেছেন।
তিন বছর পর আবারও সোভিয়েত ইউনিয়নের ডাকটিকিটে অন্য সাহিত্যিকদের সঙ্গে উঠে আসেন তলস্তয়। ‘রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক’ শিরোনামে ১৯৫৬-৫৭ সালে প্রকাশিত ওই সেটে লিও তলস্তয় ছাড়াও স্থান পেয়েছেন জর্জিয়ার কবি সোতা রুস্তাভেলি (১১৬০-১২২০), কথাসাহিত্যিক মিখাইল লামানোসফ (১৭১১-১৭৬৫), কবি আলেক্সান্দার পুশকিন (১৭৯৯-১৮৩৭), সাহিত্য সমালোচক ভিসারিয়ন বেলিনস্কি (১৮১১-১৮৪৮), কবি মিখাইল লেরমেন্তফ (১৮১৪-১৮৩১) ও ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩৭)। প্রতিটি ডাকটিকিটের মূল্যমান ছিল ৪০ কোপেক।
৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬০ সালের ১৪ নভেম্বর আবারও একসঙ্গে তিনটি ডাকটিকিটে উঠে আসেন তলস্তয়। লেখকের বিভিন্ন প্রতিকৃতির পাশাপাশি এবার ডাকটিকিটে দেখা যায় তাঁর স্বাক্ষর। ডাকটিকিটগুলোর মূল্যমান ছিল যথাক্রমে ২০, ৪০ ও ৬০ কোপেক। ১৯৬৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিখ্যাত ভাস্কর আন্না গোলবকিনার শততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে চার কোপেক মূল্যের একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। ওই টিকিটে ভাস্করের প্রতিকৃতি ছাড়াও উঠে আসে তাঁর করা লিও তলস্তয়ের ভাস্কর্যটি।
১৯৭৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তলস্তয়ের ১৫০তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে সোভিয়েত ডাক বিভাগ প্রকাশ করে আরও একটি স্মারক ডাকটিকিট। চার কোপেক সমমূল্যের ওই টিকিটই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্ব থেকে তলস্তয়কে নিয়ে প্রকাশিত শেষ ডাকটিকিট। এরপর রাশিয়া ফেডারেশন থেকে একটি স্যুভেনির শিট প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের ১০ জুন তলস্তয়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি জাদুঘরে রূপান্তরের শতবর্ষকে কেন্দ্র করে।
রাশিয়া ছাড়াও হাঙ্গেরি, সাবেক চেকোস্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, ফ্রান্স, ভারত, মলদোভা, ভ্যাটিকান ও সার্বিয়া থেকে তলস্তয়কে নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পর হাঙ্গেরিই প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১৬ অক্টোবর একটি ডাকটিকিটে তলস্তয়কে নিয়ে আসে। এরপর চেকোস্লোভাকিয়া ১৯৫৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর দুটি ডাকটিকিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে স্মরণ করে এই রুশ সাহিত্যিককে।
১৯৬০ সালের ২ আগস্ট রুমানিয়ার ডাকটিকিটেও উঠে আসেন তলস্তয়। ১৫০তম জন্মবর্ষকে ঘিরে ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি তলস্তয়কে নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশ করে আরও তিনটি দেশ—২৮ মার্চ বুলগেরিয়া, ১৪ এপ্রিল ফ্রান্স এবং ২ অক্টোবর ভারত।
২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা প্রকাশ করে তলস্তয়কে নিয়ে একটি ডাকটিকিট। ২০০৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মলদোভার একটি ডাকটিকিটেও দেখা মেলে তলস্তয়ের। ভ্যাটিকানের ডাকটিকিটে তিনি উঠে আসেন ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর। তলস্তয়কে নিয়ে সর্বশেষ ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে সার্বিয়া থেকে। ২০২২ সালের ৬ অক্টোবর প্রকাশিত সার্বিয়ার দুটি ডাকটিকিটের প্রথমটিতে তলস্তয়ের প্রতিকৃতি এবং দ্বিতীয় টিকিটে তলস্তয়ের প্রতিকৃতির পাশাপাশি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস আন্না কারেনিনার লেভিনকে দেখা যায়।
তলস্তয়কে নিয়ে বিশ্বজুড়ে ডাকটিকিট প্রকাশের পাশাপাশি উদ্বোধনী খাম, বিশেষ সিলমোহর, পোস্ট কার্ডসহ রয়েছে আরও অসংখ্য ডাক প্রকাশনা।