আবুল হাসনাত নেই, আবুল হাসনাত আছে

আবুল হাসনাত (১৭ জুলাই ১৯৪৫—১ নভেম্বর ২০২০)
ছবি: প্রথম আলো

বন্ধু আবুল হাসনাত নেই, বন্ধু আবুল হাসনাত আছে। হাসনাতের জন্য ভালোবাসা আর আনন্দের কথা বলতেই এই কথামালা। এখানে আমরা তার জন্য দুঃখ–বেদনার কথা বলতে আসিনি।

কিছুদিন আগে প্রথমা প্রকাশনের একটি অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী, লেখক ও মনোবিদ আনোয়ারা সৈয়দ হক বলছিলেন, সৈয়দ হকের মৃত্যুর পর তাঁকে আরও বেশি করে জানতে–বুঝতে পেরেছেন তিনি। আমাদেরও এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদকে নিয়ে। আর আমার ৬০ বছরের বেশি সময়ের বন্ধু আবুল হাসনাত সম্পর্কেও আমার একই রকম অনুভূতি কাজ করছে এখন।

১৭ জুলাই ছিল কালি ও কলম সম্পাদক, কবি আবুল হাসনাতের জন্মদিন। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর তিনি মারা যান। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কালি ও কলম সাহিত্যপত্রিকা আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাঁর বন্ধু–সহযাত্রী মতিউর রহমান এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে আবুল হাসনাতের স্মৃতির পরম্পরায় উঠে এসেছিল বাংলাদেশের আন্দোলনমুখর উত্তাল সময়ের কথাও। আবুল হাসনাতকে স্মরণ করে ছাপা হলো সেই বক্তৃতা।
লেখার টেবিলে মগ্ন যুবক আবুল হাসনাত

প্রতিদিন কত কিছু যে মনে হয়, একটি মানুষকে জানার কত কিছু যে থেকে যায়! হাসনাতের জীবনের বহুমুখী কর্মকাণ্ড নিয়ে ভাবতে গিয়ে বলা যায়, কত অজানারে! তার কথা মনে হলেই একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ, উদার বন্ধু এবং অনেক আনন্দস্মৃতির কথা মনে আসে।

আমরা আবুল হাসনাত অথবা মাহমুদ আল জামানের সফল জীবন, অসংখ্য স্মৃতি, কাব্যময় কবিতারাজি, গল্প, উপন্যাস, সংবাদ–এর সাহিত্য সাময়িকী, কালি ও কলম সাহিত্যপত্রিকা, তার শিল্পকলা ভাবনা ও সংগ্রহশালা এবং আরও যেসব কিছুর সঙ্গে তার ছিল গভীর সখ্য, সেসব গভীরভাবে স্মরণ করি।

আমাদের সময়ের একজন সেরা মানুষ আবুল হাসনাত, সবার প্রিয় মানুষও। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এবং লেখক–শিল্পীদের ঘনিষ্ঠজনই শুধু সে নয়, সে ছিল সজ্জন ও বিনয়ী। কোনো সময় কারও প্রতি ক্ষোভ বা বিরাগ প্রকাশ করতে দেখিনি। আর সব সময় সবকিছু সে করত পেছন থেকে, যেন কিছুটা সংকোচ নিয়ে।

বাংলাদেশের সেরা লেখক–শিল্পী বা বিশিষ্ট ব্যক্তি শুধু নন, কলকাতা অথবা পশ্চিমবঙ্গের সেরা কবি–লেখক, শিল্পী এবং গুণী অধ্যাপকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল হাসনাতের। প্রবীণ বা নবীন—কেউ বাদ ছিলেন না।

আবুল হাসনাতের কথা মনে হলেই বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা তখন সবে বাম পন্থার রাজনীতির পথে চলতে শুরু করেছি। সেই ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের শুরুর দিন থেকে মিছিলে মিছিলে চলেছি স্লোগানমুখর রাজপথে। শুরু থেকেই হাসনাতও যুক্ত ছিল এই যাত্রাপথে। এর বছরখানেক আগে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর নানা অনুষ্ঠান দেখেশুনে নতুনভাবে বাংলা ভাষা ও গান নিয়ে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম নতুন চিন্তাচেতনায়।

সেই সময় থেকেই কবিতা রচনায় আমাদের হাতেখড়ি। সারা দিন সভা–সমিতি, মিছিলের কাজে ব্যস্ত থাকি এবং সকাল আর রাতে কবিতাচর্চা করি। সে সময় আমরা সুকান্ত ভট্টাচার্য আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার বড় ভক্ত হয়ে পড়ি। রণেশ দাশগুপ্তের ভাষায়, সুকান্তের কবিতা ছিল প্রকাশোক্তি, আর সুভাষের কবিতা স্বগোক্তি।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেরা কবিতার বই যত দূরে যাই পড়ে সে সময় আমরা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। পরে হাসনাতের অনেক কবিতায় তাঁর ছায়া দেখা যায়। সে সময় থেকেই হাসনাত প্রবীণ বিষ্ণু দে এবং তরুণ সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা পড়ত এবং অনেক বেশি কবিতাচর্চায় মগ্ন ছিল। এই দুই কবিই ছিলেন বাম পন্থার সমর্থক।

সে সময় আমরা তিনটি কবিতাগ্রন্থ খুব বেশি করে পড়েছি, প্রভাবিত হয়েছি। এর একটি ছিল বিষ্ণু দে সম্পাদিত একালের কবিতা, দ্বিতীয়টি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা, আর অন্যটি হলো বিশ্বের সেরা কবিদের কবিতার অনুবাদের বিশাল সংকলন শঙ্খ ঘোষ ও আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত। পরে তো বিষ্ণু দে এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে হাসনাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আর শঙ্খ ঘোষ ও আলোকরঞ্জনের সঙ্গেও তার ছিল আন্তরিক সম্পর্ক। এসব বইয়ের অনেক কবিতা নিয়ে আমাদের কথা হতো, আলোচনা হতো, আবৃত্তিও করতাম। হাসনাত কবিতা পাঠ করত গভীর কণ্ঠস্বরে।

একটি কবিতার কথা খুব মনে পড়ে। কবিতাটি হাসনাতের খুব প্রিয় ছিল। এ কবিতা নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব মজাও হতো। এর শিরোনাম ছিল, ‘ইজেল ও বুনো পারাবত’। কবি জগন্নাথ চক্রবর্তী। পুরো কবিতায় আছে কলকাতার আমীর আলী অ্যাভিনিউর একটি গল্প। সেখানে ‘এক তরুণ শিল্পী একলা ইজেল নিয়ে বসে/ মনে ভাবে তরুণ ছেলেটি... সমুদ্রের মতো থৈ থৈ, ভবানীপুরের সিক্ত সুন্দর জুলাই’ ইত্যাদি।

সেই তরুণ শিল্পী ভাবছে, জগন্নাথ চক্রবর্তীর কবিতা থেকে উদ্ধৃত করি:

‘শান্তাদি সুন্দরী নয়, তবু তার দেহের ভঙ্গিতে

কোথায় কোথায় যেন ভাস্কর্যের

স্পষ্ট ছাপ আঁকা—

...

রবীন্দ্রসংগীত গায় কেন যে শান্তাদি,

কেন যে বাংলা পড়ে এমএ ক্লাসে,

কেন যে এমন রোদে বৃষ্টিতে বর্ষায়

ইজেলের সামনে এসে না দাঁড়িয়ে

অনর্থক গল্প করে, নীল স্টেট বাসে,

সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে

কে জানে?

কবিতাটির কথা মনে হলেই হাসনাতের কথা মনে পড়ে যায়। কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই। এই শান্তাদির মতো হাসনাতের কবিতায় আমরা দেখি সবিতা হালদার, মল্লিকাদি বা মালতীকে। হাসনাত লেখে: ‘আমি মধ্যরাতে সবিতা হালদারের জন্য/ এখনো কাঁদি’; ‘ভুবনডাঙায় এখনো সে হাঁটে, এলার মতো, নন্দিনীর মতো’; ‘আমি খুঁজে চলেছি সবিতা হালদারের স্তব্ধ স্মৃতি’ অথবা ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ সবিতা হালদার?’

কে এই সবিতা হালদার? হাসনাত সারা জীবন খুঁজেছে সবিতা হালদারকে, তার প্রেমকে, ভালোবাসাকে। হাসনাত তার কবিতায় মিছিলের কোন মুখকে স্মরণ করেছে? কবিতায় সে বলেছে মায়ের কথা, দেশের জন্য গভীর ভালোবাসার কথাও বলেছে। হাসনাতের কবিতায় আছে বাংলার মুখ, সর্বত্র।

জগন্নাথ চক্রবর্তীর কবিতাটির শুরুতে প্রথম চরণ ছিল, ‘আমীর আলী অ্যাভেন্যুয়ে গুলমোরের হলুদ ছড়ানো।’

কী আশ্চর্য, ১৯৭১ সালে কলকাতায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল ১৬/১ আমীর আলী অ্যাভিনিউয়ে। আর সেই কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্বে ছিল হাসনাত। এই দায়িত্ব পেয়ে উচ্ছ্বসিত ছিল হাসনাত, আগরতলায় চিঠি লিখে আমাকে সে কথা সে জানিয়েও ছিল।

একাত্তরের পুরো আট মাস কলকাতার আমীর আলী অ্যাভিনিউয়ে থেকে কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের বহুমুখী কর্মকাণ্ড হাসনাত পরিচালনা করেছে অত্যন্ত সফলভাবে। প্রতিদিন নানা ব্যস্ততার মধ্যে কলকাতা শহরকে ধীরে ধীরে গভীরভাবে জেনেছে। নানা কাজের সূত্রে কবি–লেখক–শিল্পী ও রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। অনেকের সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। নাটক–সিনেমাও দেখেছে। পরের কয়েক দশকে তা আরও বিস্তৃত হয়েছে, বহুমুখী হয়েছে।

কলকাতাপ্রেমী হাসনাত ঢাকা থেকে কি কলকাতাকে বেশি ভালোবাসত? এই প্রশ্নের জবাবে কখনো কোনো নেতিবাচক উত্তর পাইনি তার কাছ থেকে। তার স্বপ্নপূরণে সহায়ক কবিতা, গান, নাটক, সিনেমা এবং প্রবীণ–নবীন গুণী মানুষগুলো—সব ছিল কলকাতায়। সে জন্য যেকোনো সময়ে ছোট–বড় যেকোনো প্রয়োজনে হুটহাট সে চলে যেত কলকাতায়। কলকাতা কখনো তাকে ক্লান্ত করেনি।

হাসনাতের কথা মনে হলেই ষাট দশকের উজ্জ্বল দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। আমরা চোখের সামনে দেখেছি, ছাত্র–জনতা, নারী–পুরুষ, কবি–লেখক–শিল্পী—সর্বোপরি দেশের মানুষ কীভাবে জেগে উঠছে। একটি দশক ধরে দেশের মানুষ কীভাবে মরণপণ প্রতিজ্ঞা নিয়ে মিছিলে মিছিলে প্রাণ দিয়েছে। এসব কিছুর পেছনে ছিল ছোট ছোট কত কাজ—লিফলেট লেখা ও ছাপানো, দেয়ালে পোস্টার লাগানো, ছোট–বড় সভার প্রস্তুতির নানা কাজ এবং প্রেস রিলিজ তৈরি—আরও কত কী! বড় বড় কাজের মধ্যে ছিল ছাত্র ও রাজনৈতিক সমাবেশ, মিছিল ও হরতাল সংগঠিত করা এবং নিয়মিত অংশ নেওয়া।

আবার কবিতা লেখা, একুশের সংকলন প্রকাশ, দেশাত্মবোধক গান ও নাটকের ব্যবস্থাপনা— আমরা এগুলোও করেছি বছরের পর বছর। আরও ছিল দেশের সেরা কবি–লেখক ও শিল্পীদের জড়ো করে প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের উদ্যোগ নেওয়া এবং সেসব পরিচালনা করা। এসবের মধ্য দিয়েই আমরা উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের সব সাহসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়েছিলাম।

বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলো তখন খুব প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে। আর এই সবকিছুতে হাসনাতের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। পড়াশোনার পাশাপাশি হাসনাত সে সময় দৈনিক সংবাদ–এ রাতের পালায় কাজ করত। বছরের পর বছর এত কিছু করা তার পক্ষে কীভাবে সম্ভব হলো, সেটাও এক বিস্ময়।

একটি ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে চাই। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শহীদ মিনারের পাদদেশে সে সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের বড় একটি ছাত্রজনসভায় সভাপতিত্ব করেছিল আবুল হাসনাত। ওই সভায় ছাত্র ইউনিয়ন প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। হাসনাত তখন ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি। এর আগে সে একই সংগঠনের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ছিল। আরেকবার ছিল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

আবুল হাসনাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি ছিল। তার সময়টাই ছিল সংস্কৃতি সংসদের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। দুই দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে হাসনাত। আফ্রো–এশীয় লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিল সে। ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে আফ্রো–এশীয় গণসংহতি পরিষদ ও বাংলাদেশ–সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সঙ্গেও।

এখানে আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখি, ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক অক্টোবর বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে পল্টন ময়দানে দুই দিনের যে বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল, তাতে হাসনাতের বড় ভূমিকা ছিল। আর পুরো অনুষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন একাত্তরের দুই শহীদ শহীদুল্লা কায়সার ও আলতাফ মাহমুদ।

এই তথ্যের সূত্রে কৌতূহলোদ্দীপক একটি বিষয় অল্প করে বলতে চাই: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পরিচালিত মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদ ইনস্টিটিউটে সিপিবির তরুণ নেতাদের দশজনের প্রথম যে দলটি দশ মাসের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিল, সেই দলে ছিল হাসনাত। এখানে তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি হাসনাতসহ সবাই–ই নিয়েছিল ট্যাংক ধ্বংস করার অস্ত্রসহ গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ।

আজ ভাবতে অবাক লাগে, কবি–সম্পাদক আবুল হাসনাত মস্কোর নিকটস্থ গভীর অরণ্যের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে! এ নিয়ে আমরা দুজনে খুব মজা করতাম। কৌতুক করে আনন্দ পেতাম অনেক। বিস্ময় যায় না। কোথায় সমাজতন্ত্র, কোথায় বিপ্লব? তবে নিশ্চয়ই পরিবর্তন হবে, বিপ্লব হবে। এ জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

এটা ভেবেও এখন বিস্মিত হই যে জীবদ্দশায় কী বিপুল পরিমাণ লেখালেখি করেছে হাসনাত! এত বহুমুখী কর্মযজ্ঞের মধ্যেও কবিতা, শিশু–কিশোর ও জীবনীসাহিত্য, চিত্রসমালোচনাসহ তার ২২টি মৌলিক বই প্রকাশিত হয়েছে। একক ও যৌথভাবে সম্পাদনা করেছে ৪২টি বই।

২০১৭ সালে প্রকাশিত তার নির্বাচিত কবিতা বইটি উৎসর্গ করেছিল মালেকা (মালেকা বেগম) ও আমাকে। উৎসর্গপত্রে আমাদের বন্ধু লিখেছিল, ‘আমার দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে/ স্মৃতি, স্মৃতিকাতরতা ও স্মৃতিমেদুরতার পথ থেকে’। তার স্মৃতিকথা হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে বইয়ে আমাদের নিয়ে অনেক কথা লিখেছে হাসনাত। প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য গ্রন্থেও নিবন্ধ লিখেছে আমাকে নিয়ে। তার কাছে আমরা ঋণী। কবে, কীভাবে এত ঋণ শোধ করব?

আসলে হাসনাত আমাদের জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল, অনেক ঘটনা ও বহু স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এবং আমৃত্যু থাকবে। এখন তো প্রতিদিন মনে হয়, অনেক কথা বলার ছিল, কত কিছু জানার–শোনার ছিল তার কাছ থেকে। সেসব তো জানা হলো না, শোনা হলো না।

আমাদের সময়ের একজন সেরা মানুষ আবুল হাসনাত, সবার প্রিয় মানুষও। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এবং লেখক–শিল্পীদের ঘনিষ্ঠজনই শুধু সে নয়, সে ছিল সজ্জন ও বিনয়ী। কোনো সময় কারও প্রতি ক্ষোভ বা বিরাগ প্রকাশ করতে দেখিনি। আর সব সময় সবকিছু সে করত পেছন থেকে, যেন কিছুটা সংকোচ নিয়ে। কখনো কখনো অনেকটা বাধ্য হয়ে সভামঞ্চে উপস্থিত থেকেছে, কথা বলেছে কিছুটা বিব্রত হয়ে। তবে দৈনিক সংবাদ ও মাসিক কালি ও কলম–এর লেখা সংগ্রহে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না।

যাঁদের লেখা চেয়েছে, সবারটাই পেয়েছে। লেখা ও লেখক সংগ্রহে তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। এখনো নেই। পরে কেউ হবে কি না, জানি না। কবি ও লেখক মনজুরে মওলা আবুল হাসনাতকে নিবেদন করে ‘আকাশই শুধু’ কবিতায় লিখেছিলেন: ‘মানুষ তো সম্পাদক—/ অনেক ওপর থেকে দেখতে পায়/ গাছ পাতা ফুল/ কোন ফুলে গন্ধ আছে/ চিনে নিতে পারে।’

আজ মনজুরে মওলাও নেই। কিন্তু তাঁর কবিতার কথাগুলো আমাদের স্মরণে থাকবে।

এই মানুষ তো সম্পাদক, হাসনাত তো সম্পাদকই ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাসনাত কবি ছিল, কবিতাই ছিল তার প্রাণ। কবিতা দিয়েই তার জীবনের কথা, মনের কথা—সব বলেছে। এখন আমি হাসনাতের কবিতা বারবার পড়ি। আঁতিপাঁতি করে তাকে খুঁজি তার কবিতার স্তবকে স্তবকে, চরণে চরণে। একান্ত ব্যক্তিগত সব কথা আর অনুভূতি, গভীর আবেগ নিয়ে কত কিছু হাসনাত বলে যায় কবিতায়! ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সেসব কথা চলে যায় আরও অনেক দূরে। দ্বন্দ্ব–সংঘাতের জীবন ছাড়িয়ে অনেক দূরে নিয়ে যায় আমাদের, আনন্দ–ভালোবাসার অসীমের দিকে।

বন্ধু হাসনাতকে স্মরণ করি, প্রতি সকাল–সন্ধ্যায় স্মরণ করি। সেই জন্যই বলি, বন্ধু আবুল হাসনাত নেই, বন্ধু আবুল হাসনাত আছে।

আবুল হাসনাতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর কালি ও কলম আয়োজিত স্মরণ সভায় মতিউর রহমানের বক্তৃতা।