প্রযোজনার প্রারম্ভে আমরা মঞ্চে দেখতে পাই ব্রাহ্মণ কুমার সিদ্ধার্থের মনে জীবনবোধের বহু প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য আচার ও শাস্ত্রে তার কোনো দিশা সে খুঁজে পায় না। মানুষের মধ্যে, জীবনের মধ্যে সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পিতার অমতে একদিন ঘর ছেড়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করে সিদ্ধার্থ। তিন বছর দীর্ঘ তপস্যার পর সন্ন্যাসব্রতের কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের অসারতা উপলব্ধি করে সন্ন্যাসজীবন ত্যাগের মাধ্যমে আবারও সে পথে বেরিয়ে পড়ে। পথে বেরিয়ে সিদ্ধার্থ এবার শ্রাবস্তীনগরে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ লাভ করে এবং তাঁর উপদেশ গ্রহণের মাধ্যমে জীবনের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পায়।
কিন্তু কোনো এক আশ্চর্য কারণে বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ না করে আবারও সে ঘরছাড়া হয়। পথে বেরিয়ে পড়ে তার নিজের জীবনের বিচার সে নিজে করবে বলে। পথিমধ্যে দেখা হয় নগরের শ্রেষ্ঠ বারাঙ্গনা কমলার সঙ্গে। এখানে ‘কমলা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন জিনাত জাহান নিশা। নগরের পথে যখন সুউচ্চ পালঙ্কে করে কমলা গমন করছিল তখন সিদ্ধার্থের সঙ্গে তার দৃষ্টি বিনিময় ঘটে, পরিচয় হয় নতুন এক জীবনের। সে জীবন তাকে ক্রমেই নিয়ে যায় সংসার-সন্তানলাভের খেলায় মত্ত এক জীবনের কাছে। দীর্ঘ কুড়ি বছর জীবনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার পর সিদ্ধার্থের মনে হয়, এ খেলা শেষ হয়েছে। এ জীবন তাকে মহাকালের পথ দেখাতে অপারগ।
বর্ণনা ও সংলাপের দ্বৈতসত্তার ভেতর দিয়ে নাটকটিতে সিদ্ধার্থের প্রশ্ন সর্বজনীন বোধের প্রশ্ন হিসেবে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত হয়। সিদ্ধার্থ সংসারজীবন ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় নদীর কাছে। নদীর কূলে মাঝি বাসুদেবের সঙ্গে সখ্য হয় তার। নদীর কাছে ভাষা শিখে নিয়ে সে জানতে ও বুঝতে পারে জীবনের গূঢ় মানে। কারণ, নদী সব জানে। সে ভাবনা সিদ্ধার্থের সংলাপের ভেতর দিয়ে দর্শক মননে গিয়েও আঘাত হানে। সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করে, পাপ ও পুণ্য, জীবন ও মৃত্যু, জ্ঞান ও নির্বুদ্ধিতা—সবকিছুরই প্রয়োজন আছে জীবনে। এসব অভিজ্ঞতা জীবনকে পূর্ণ করে। এ অভিজ্ঞতার নামই জ্ঞান, যা কাউকে শেখানো যায় না, নিজের চেষ্টায় তা অর্জন করতে হয়।
বাসুদেব চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন রেফাত হাসান সৈকত। নাটকের শেষাংশে সিদ্ধার্থের সংসারজীবনের ছাপ দর্শকের সামনে দৃশ্যমান হয় বারাঙ্গনা কমলার এগারো বছর বয়সী পুত্র চরিত্রের মধ্য দিয়ে। পুত্র চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দর্শকের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে আরিফুল ইসলাম নীল। এই পুত্র চরিত্রটি যেন বহু বছর পূর্বে পিতার অমতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া সিদ্ধার্থের ঠিক বিপরীতমুখী চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের পিতৃপ্রদত্ত নাম সিদ্ধার্থ। তবে হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ সরাসরি গৌতম বুদ্ধ নয়; আবার একই সঙ্গে গৌতম বুদ্ধও। বুদ্ধের ঔজ্জ্বল্যে আড়াল হয়ে পড়া গৌতমের ব্যক্তিগত মনোজগতের রঙে সিদ্ধার্থকে আঁকা হয়েছে।
নাটকটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত দর্শককে ভাবনার গভীর জগতে ঘুরিয়ে আনে। সংগীত ও আলোর পরিমিত দ্যোতনা অভিনেতাদের সংলাপ ও বর্ণনাকে করে তোলে মাধুর্যময়। মঞ্চের পেছন সারিতে সাদা রঙের পাতলা পর্দার আড়ালে থেকে সংগীত ও বাদক দল ঝংকার তুলেছে নাটকটিতে। অভিনেতাদের বিভিন্ন সংলাপ ও বর্ণনা নানা ঢঙের কোরিওগ্রাফের ভেতর দিয়ে উচ্চকিত করা হয়েছে। অভিনেতার সংলাপ ছাড়াও বর্ণনার মধ্যে দর্শকদের ভাবনার বীজ বপন করেছেন নির্দেশক। নাটকটির পাণ্ডুলিপি সম্পাদনায় যেমন দর্শকদের ভাবনার ফুরসত রয়েছে, তেমনি মঞ্চ ভাবনায়ও নতুনত্ব প্রকাশের প্রয়াস রেখেছেন নির্দেশক।
তিন দিক খোলা মঞ্চে নাটকটি মঞ্চস্থ হলেও সব দৃশ্য একই সমতলে মঞ্চস্থ হয়নি। নদীর তীরে বাসুদেব ও সিদ্ধার্থের মধ্যকার কথোপকথনের অংশ ছাড়া আরও কিছু অংশ মঞ্চস্থ হয়েছে আপস্টেজে কিছুটা উঁচু স্থানে, যা দর্শককে স্থানের দ্বৈত দ্যোতনা দিতে পারে। মঞ্চে সেটের তেমন উল্লেখযোগ্য ব্যবহার নেই, তবে অভিনেতাদের সঙ্গে সহজে ব্যবহারযোগ্য প্রপস কিছু চোখে পড়ে। মঞ্চে ব্যবহৃত দর্শনীয় আলোর পাশাপাশি নীল, সবুজ ও লাল রঙের আলোর ব্যবহার লক্ষণীয়। যেমন নদীর তীরবর্তী অংশ দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে নীল আলোর প্রাচুর্য চোখে পড়ে। সে সময় ডাউন স্টেজে সাদা ফিনফিনে কাপড়ের ভেতরে অভিনেতাদের অবস্থান ও হস্ত প্রক্ষেপণের ভেতর দিয়ে নদীর ঢেউ নির্মাণের কোরিওগ্রাফটি দর্শকের নজর কেড়েছে। নুসরাত জাহান জিসা, প্রান্তিক দেব ও আকাশ সরকারের যৌথ নির্মাণে নাটকটিতে কোরিওগ্রাফি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ ছাড়া আলোক পরিকল্পনায় অনিক কুমার পৃথকভাবে প্রশংসার দাবি রাখেন।
তবে এই সবকিছু ছাপিয়ে ‘সিদ্ধার্থ’ হয়ে উঠেছে জীবনের অমোঘ ‘বোধে’র নাটক। এখন অবধি ১৬টি প্রদর্শনীতে ‘সিদ্ধার্থ’ ঢাকার মঞ্চে যারপরনাই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। শেষ পাঁচটি প্রদর্শনীতেও ছিল দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। প্রযোজনা প্রসঙ্গে নির্দেশক রেজা আরিফ জানান, প্রযোজনাটির অভিনয়কৌশল মুখ্যত চরিত্রাভিনয় রীতির হলেও কখনো কখনো বর্ণনাত্মক অভিনয় রীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। মঞ্চ নিরাভরণ। পোশাক নাট্যধর্মী। আলোর প্রয়োগ সামান্য। প্রযোজনাটির চূড়ান্ত মনোযোগ সিদ্ধার্থের জীবনোপলব্ধির প্রতি, বাহ্যিক আভরণে নয়।
জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের নবীনবরণ নাট্য উৎসব ২০২৫–এর অংশ হিসেবে গত ২২ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘আরশিনগর ঢাকা’র এই চতুর্থ প্রযোজনা ‘সিদ্ধার্থ’। জাফর আলমের অনুবাদে নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক হেরমান হেসের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’র নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রেজা মোহাম্মদ আরিফ। এর আগে ১৯, ২০ ও ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে নাটকটির চারটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সিদ্ধার্থ বলতে সাধারণ অর্থে জনপরিসরে ‘গৌতম বুদ্ধ’কে নির্দেশ করলেও এই নাটকে সিদ্ধার্থ স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ নন। এখানে সিদ্ধার্থ একজন সাধারণ ব্রাহ্মণ কুমার। নাটকটিতে সিদ্ধার্থ চরিত্রে পর্যায়ক্রমে কাজী নওশাবা আহমেদ, সাজ্জাদুল শুভ, নাজমুল সরকার নিহাত ও মাঈন হাসান অভিনয় করেছেন।
নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে মঞ্চে অভিনয় করেছেন পার্থ প্রতিম হালদার, কাজী নওশাবা আহমেদ, জিনাত জাহান নিশা, ওয়াহিদ খান সংকেত, ইসনাইন আহমেদ জিম, শাহাদাত নোমান, সাজ্জাদুল শুভ, প্রিন্স সিদ্দিকী, সাকিনা ইসলাম ঈষিকা, পলি পারভীন, ফারজানা জলি, আজমেরী জাফরান রলি, প্রজ্ঞা প্রতীতি, ক্যামেলিয়া শারমিন চূড়া, জেরিন চাকমা, জিতাদিত্য বড়ুয়া, রাদিফা নারমিন, রেফাত হাসান সৈকত, নাজমুল সরকার নিহাত, ইমাদ ইভান, বর্ণময় হৃদয়, মাইনউদ্দিন বাবু, আলী আক্কাছ আকাশ, মাঈন হাসান, আরিফুল ইসলাম নীল, নাসিম পারভেজ প্রভাত, নাফিসা নূর নোভা, অদ্বিতীয়া ধর পদ্য, অভিজ্ঞান ধর কাব্য, শাকিল মাহমুদ মিহির, উৎপল নীল ও জাহিদুল ইসলাম জাহিদ।
আরশিনগর ঢাকা প্রসঙ্গে
ঢাকার মঞ্চে তারুণ্যনির্ভর নাট্যদলগুলোর মধ্যে আরশিনগর অন্যতম। একাডেমিক থিয়েটারের পরিসর থেকে আসা একদল তরুণ নাট্যকর্মীর উদ্যোগ হিসেবে আরশিনগর ঢাকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দলটি বাংলা নাটকের চিরায়ত রূপকে সমকালীন প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ক্রমেই অসংখ্য শিল্পমনস্ক সহযাত্রীর সম্পৃক্ততায় আরশিনগর ঢাকা পরিণত হয়েছে একটি সুসমৃদ্ধ নাট্যদলে। এ পর্যন্ত দলটির চারটি প্রযোজনা মঞ্চে এসেছে। এর মধ্যে শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’, অভিজিৎ সেনের উপন্যাস ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ এবং নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক হেরমান হেসের উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’ অন্যতম। আরশিনগর ঢাকার সবগুলো প্রযোজনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দর্শকমহলে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। নিয়মিত নাট্য প্রযোজনার পাশাপাশি আরশিনগর ঢাকা গবেষণা, কর্মশালা, সেমিনার, পাঠচক্র এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আয়োজন করে থাকে।