যত কিছু দেখি বইমেলায়
লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব বইমেলায় যান প্রায় দিনই। তাঁর চোখে এবারের বইমেলাটি কেমন? ধীরে ধীরে এ মেলার কি চারিত্রিক বদল ঘটছে?—এসব প্রশ্ন মাথায় রেখে এই লেখায় তিনি লিখেছেন বইমেলার রঙ্গ–কথন।
মেলায় ঢুকতে গেলেই রিপোর্টারদের মুখে পড়তে হয়। তাঁদের সঙ্গে সাধারণত এ ধরনের কথাবার্তা হয়—
: এবার কটা বই লিখেছেন?
: (আমি) একটাও না।
: একটাও না?
: না।
: একটাও না...(রিপোর্টার হতভম্ব) কিন্তু পত্রিকায় তো দেখলাম আপনার তিনটা বইয়ের বিজ্ঞাপন।
: ওগুলো আমি লিখিনি।
: আপনি লেখেননি??!
: না, আমি পিসিতে টাইপ করেছি। হাতে লিখিনি।
অর্থাৎ আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আজকাল বেশির ভাগ লেখকই হাতে লেখেন না। সবাই পিসিতে টাইপ করেন। অবশ্য আমার লেখক বড় দুই ভাই সব সময় হাতেই লিখত। একজন এখনো লেখে।
তো সেই রিপোর্টারের দ্বিতীয় প্রশ্ন—
: আচ্ছা মেলায় তো মানসম্মত বই বেরোচ্ছে না।
মানসম্মত বই নিয়ে প্রতি মেলায় তারা সব সময় বিশেষ চিন্তিত।
: আপনি কী করে বুঝলেন যে মানসম্মত বই বেরোচ্ছে না? আপনি পড়ে দেখেছেন?
: না; পড়িনি, তবে...
তাদের তৃতীয় প্রশ্ন আবশ্যিকভাবে, ‘আচ্ছা, মেলার এই যে অব্যবস্থা...ধুলা উড়ছে, পানি দেওয়া হচ্ছে না...ইত্যাদি ইত্যাদি’ অর্থাৎ তিনি শুনতে চাচ্ছেন, আমি কঠিন, নেগেটিভ কিছু বলি। আমি অবশ্য বলি না।
: (আমি) কোথায় ধুলা?
: কিন্তু পানি?
: এই যে মাটি তো এখনো ভেজা। নিশ্চয়ই সকালে পানি দেওয়া হয়েছে...
রিপোর্টার হতাশ হয়ে অন্য লেখকের কাছে ছোটে, এই লেখক মানসম্মত ইন্টারভিউ দিতে পারছেন না।
তবে আমি অবশ্য নিজেকে লেখক বলতে একটু ইতস্তত করি। নিজেকে কার্টুনিস্ট ভাবতেই ভালো লাগে। রিপোর্টারদের সেটা বোঝানোরও চেষ্টা করি। আমি কমিকস আঁকি, গ্রাফিক নভেল আঁকি...লিখি না। তারপরও প্রশ্ন—
: তাহলে বই লেখেন কেন?
: লিখি, কারণ, আমার বাবা লিখতেন, মা লিখতেন, আমার বড় দুই ভাই লিখতেন, এক বোনও লিখতেন। যে বোন লিখতেন না, তিনিও একটা বই লিখেছেন আমার বাবাকে নিয়ে গত মেলায়। বাসায় লেখালেখির বিষয়টা ছিল, তাই মাঝেমধ্যে লিখে ফেলি। তবে আপনারা চাইলে আর লিখব না।
: না না, কেন লিখবেন না? অবশ্যই লিখবেন। আপনারা না লিখলে...আপনার বড় ভাই...এই পর্যায়ে রিপোর্টার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে...আর সেই ফাঁকে আমি সটকে পড়ার চেষ্টা করি।
তবে বাচ্চা বাচ্চা রিপোর্টারদের আমার বেশ ভালোই লাগে, তাঁরা মাঝেমধ্যে এমন সব কঠিন প্রশ্ন করে বসেন যে যেকোনো লেখককে হকচকিয়ে যেতে হয়, ‘মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতে স্বাধীনতা–উত্তর বাংলা সাহিত্যের নান্দনিকতায় যে আবহমান বাংলা...’
এই প্রশ্ন বুঝতে বুঝতে...থাক কী আর বলব! অন্য প্রসঙ্গে যাই বরং।
এবার একটা জিনিস খেয়াল করলাম। তরুণ লেখকেরা থ্রিলার লেখার দিকে বেশ ঝুঁকেছেন। বেশ কয়েকজন নারী লেখককেও পেলাম। তাঁরাও থ্রিলার লিখছেন। আমার ধারণা, এটা হয়েছে করোনার কারণে। করোনার সময়টায় আমরা সবাই ঘরে বসে বসে নেটফ্লিস্কে থ্রিলার, সাইকো টাইপ মুভি, সিরিয়াল দেখতে দেখতে কখন যে নিজেরাই থ্রিলারলেখক হয়ে উঠেছি, নিজেরাই জানি না। এটা মন্দ না; আমাদের সাহিত্যে নতুন একটা জনরার আবির্ভাব হয়েছে এবং আমাদের নাটক–সিনেমায়ও তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
আমি এক নারী থ্রিলার লেখককে চিনি, যাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় রোমহর্ষ খুন...ভয়ংকর সব বর্ণনা। মাঝেমধ্যে তাঁকে মেলায় দেখি, স্বামীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্বামী বেচারা মাঝেমধ্যেই ভয়ে ভয়ে সুন্দরী থ্রিলার লেখক স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছেন। আমার ধারণা, বইয়ের পাতার বর্ণনার সঙ্গে স্ত্রীর মেজাজ মেলানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে বিশেষ চিন্তায় আছি আমি। তবে গুজব শুনতে পাচ্ছি যে এই লেখিকা আমাকে একটি বই উৎসর্গ করেছেন। বইটা অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে।
আসলে আমরা জাম্প করেছি, ডিটেকটিভ না লিখে জাম্প করে থ্রিলারে চলে গেছি; আমার তা–ই মনে হয়। বরং এই জাম্পের একটা উদাহরণ দিই। আমার এক লেখক বন্ধু ছিলেন। তিনি ঠিক করলেন, একটা ভিসিপি কিনবেন। তখন সদ্য ভিসিপি এসেছে দেশে; পাড়ার দোকান থেকে ক্যাসেট ভাড়া করে এনে ক্যাসেট ভরে ভরে দিব্যি সিনেমা দেখা যায়। যখনকার কথা বলছি, তখন সবার ঘরে ঘরে ছিল ভিসিপি (ভিডিও রেকর্ডিং প্লেয়ার)। দামও মন্দ নয়। লেখক বন্ধু টাকাপয়সা জোগাড় করে যখন দোকানে গেলেন, তখন দেখা গেল, ভিসিপি আর মার্কেটে নেই। চলে এসেছে ভিসিআর। তিনি হতাশ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘একটা টেকনোলজি আমি ধরতেই পারলাম না...আরেকটা চলে এসেছে!’ বইয়ের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে তেমনটাই হয়েছে। একটা জনরার বই না লিখেই আমরা জাম্প করে আরেকটা জনরায় চলে গেছি।
তবে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং যেটা হয়েছে এই মেলার ক্ষেত্রে, সেটা হচ্ছে...না, সেটা কিন্তু মেলার ভেতরের কোনো ঘটনা না। সেটা ঘটছে মেলার বাইরে। হ্যাঁ, মেট্রোরেল! আগে মেলার ভেতরে লেখকদের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ হতো। এখন হচ্ছে মেট্রোরেলের ভেতরে। আগেই দেখা হয়ে যাচ্ছে। এক বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে আমার তো প্রায় প্রতিদিনই দেখা হচ্ছে। তিনি ওঠেন কারওয়ান বাজার থেকে, আমি পল্লবী থেকে। বিশ মিনিট আর সাত মিনিটে আমরা মেলায় পৌঁছে যাই।
এই তো সেদিন মেলায় ঘুরতে বের হয়ে পরিচিত এক তরুণ প্রকাশককে জিজ্ঞেস করলাম—
: কী, বিক্রি কেমন?
সে হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকায়।
: কেন তোমার স্টলে তো সব সময় ভিড় দেখি!
: সব টুক-টাক আর টিক-টক!
: মানে?
: মানে টুকটাক বিক্রি হয়। বাকি সব টিকটক করতে স্টলে আসে। এ–ই চলছে...
তরুণেরা আজকাল বই কেনে না, বই পড়ে না। এ রকমটা আমরা শুনতে পাচ্ছি, তারা দিন দিন নানা গ্যাজেটে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশের এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও লেখক কোনো একটা সভায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমাদের দুই–দুইটা প্রজন্ম বই না পড়েই বড় হয়ে গেছে।’ কী ভয়ানক কথা! একবার আমি এক তরুণকে পেলাম, সে নাকি বই পড়ে। বই পড়াই নাকি তার হবি। শুনে ভালো লাগল। তাকে বললাম, শেষ কী বই পড়েছ, নাম বলো তো। সে গম্ভীর হয়ে বলল, স্যার, পিডিএফ।
এক পৃথিবীবিখ্যাত দার্শনিকের বাক্য ধার করে লেখাটা বরং শেষ করি।
‘একসময় আমি নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবতাম, ভাবতাম আমার চিন্তাভাবনা দিয়ে পৃথিবীটাকে বদলে দেব। তারপর প্রচুর বই পড়তে শুরু করলাম...ধীরে ধীরে নিজেকে জ্ঞানী করে তুললাম...এখন আমি জ্ঞানী, আমি এখন নিজেকে বদলাচ্ছি!!’