জনপদ
লাঙ্গলবন্দের স্নান: তীর্থ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির মহামিলন
লাঙ্গলবন্দ কেবল একটি তীর্থস্থান নয়; বরং যুগে যুগে মহান ব্যক্তিত্বদের পদস্পর্শে পবিত্র হয়ে ওঠা এক অনন্য ঐতিহাসিক স্থান।
ঢাকা জেলার সোনারগাঁর নিকটবর্তী লাঙ্গলবন্দ, শতাব্দীজুড়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে সুপরিচিত। চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করলে জীবনের সব পাপ মোচন হয়—এমন বিশ্বাস লাখো তীর্থযাত্রীকে প্রতিবছর এই নদীর তীরে আহ্বান জানায়। এই অষ্টমী তিথিতে স্নান আয়োজন শুধু ধর্মীয় নয়, এটি একটি ব্যাপক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপ নেয়, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি ও মানুষের মিলন ঘটে। বিশেষত অষ্টমী তিথি যখন বুধবার ও পুনর্বসু নক্ষত্রের সঙ্গে মিলে যায়, তখন এই স্নানকে ধরা হয় আরও পুণ্যময়।
শ্রী প্রমথনাথ বসু রচিত ‘স্বামী বিবেকানন্দের জীবন-চরিত’ গ্রন্থে স্বামী বিবেকানন্দের লাঙ্গলবন্দে আগমনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে বুধাষ্টমীর দিনে। এ ছাড়া ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থে পাওয়া যায়, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য বিক্রমপুরের নূরপুর থেকে সুবর্ণগ্রাম হয়ে লাঙ্গলবন্দে পৌঁছেছিলেন। এই যাত্রাপথে তাঁর আগমন লাঙ্গলবন্দের তীর্থ মাহাত্ম্যকে আরও গৌরবান্বিত করেছে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ঘনিষ্ঠ শিষ্য বাবুরাম মহারাজ, যিনি পরে স্বামী প্রেমানন্দ নামে পরিচিত হন, তাঁর লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্রস্নানের একটি ঐতিহাসিক বর্ণনা পাওয়া যায় ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য রচিত ‘প্রেমানন্দ-প্রেমকথা’ গ্রন্থে। এ ঘটনা ঘটে ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল। ওই সময় তিনি লাঙ্গলবন্দে এসে ব্রহ্মপুত্র নদে পবিত্র স্নান করেন এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন বহু ভক্ত।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, এটি কেবল একটি তীর্থস্থান নয়; বরং যুগে যুগে মহান ব্যক্তিত্বদের পদস্পর্শে পবিত্র হয়ে ওঠা এক অনন্য ঐতিহাসিক স্থান।
বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ লাঙ্গলবন্দ। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে শ্রী গৌরচন্দ্র গোপ রচিত ‘ত্রিপুরা জেলার কথ্য ভাষা’ গ্রন্থে লাঙ্গলবন্দের প্রসঙ্গ এসেছে:
‘হিনান যাইবা নাহি নাঙ্গলবন্দ?’
এ ছাড়া ‘ছাদ–পিটানি’ গানের মতো লোকসাহিত্যে এর উপস্থিতি মানুষের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে:
‘যে–জন আমারে ভালোবাইসাছে—লাঙ্গলবন্দ নিয়া আমার দফা সাইরাছে।’
১৯৪০ সালের ১৬ অক্টোবর সংখ্যায় ‘বেতার জগৎ’-এ লাঙ্গলবন্দকে নিয়ে কথিকার উল্লেখ আছে।
এমনকি এই স্থান বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের এক পরোক্ষ প্রতিচ্ছবিও বহন করে। ১৭৬০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফকির ও সন্ন্যাসী দুটি সম্প্রদায় কখনো সম্মিলিতভাবে, আবার কখনো বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল। খালেকদাদ চৌধুরী তাঁর ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’ (১৯৬৬) উপন্যাসে লিখেছেন:
‘অষ্টমী স্নানের মেলা উপলক্ষ্যে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানের জন্য সন্ন্যাসীরা সমবেত হতেন রংপুরের চিলমারী, ময়মনসিংহের সিংজানী ও বেগমবাড়ী ও ঢাকা জেলার লাঙ্গলবন্দে। ফকিরেরা আবার সমবেত হতেন গারো পাহাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে শাহ কামালের দরগায়।’
শ্রী প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী তাঁর আত্মজীবনী ‘বিপ্লবীর জীবন দর্শন’-এ লাঙ্গলবন্দের স্নান সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, তীর্থযাত্রীদের সেবা ও রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করতেন অনুশীলন সমিতির সদস্যরা, যাঁরা ছিলেন বাংলার গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনগুলির সদস্য। সমিতির কঠোর শিক্ষায় দীক্ষিত এই সদস্যরা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও পদ্মা পার হতে পিছপা হতেন না।
ঢাকা গেজেট অনুযায়ী, ১৯০১ সালে প্রায় তিন লাখ মানুষ অষ্টমী স্নানে অংশগ্রহণ করেন। এসব মানুষ ঘিরে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জও ছিল উল্লেখযোগ্য—প্রতিবছর ১০-১২ জন নারীর অপহরণের খবর পাওয়া যেত। লাঙ্গলবন্দের তীর্থযাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিল আরও কিছু সামাজিক দিক। ১৯৪০ সালের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি প্রসিডিংসে (ভলিউম ৫৬, পার্ট ৫) উল্লেখ আছে—তীর্থযাত্রার সময় লাঙ্গলবন্দ, নবদ্বীপ ও সীতাকুণ্ডের মতো স্থানে গাঁজা সেবনের প্রচলন ছিল সাধারণ ব্যাপার।
লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী মেলা
আধ্যাত্মিক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রতিবছর স্নান উৎসবকে কেন্দ্র করে আয়োজিত প্রাণবন্ত মেলাও যুগে যুগে পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে। ইতিহাসবিদ যতীন্দ্রমোহন রায় তাঁর ঢাকার ইতিহাস (১৯১২) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:
“লাঙ্গলবন্দে ‘অশোকাষ্টমীর মেলা’ নামক একটি মেলা ২-৩ দিন ধরে চলত।”
একই তথ্য পাওয়া যায় মুনশী রহমান আলী তায়েশ রচিত ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ (১৯১০) গ্রন্থে। তবে এটি নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হতো না। ‘সাপ্লিমেন্ট অব দ্য ক্যালকাটা গেজেট, ডিসেম্বর ৬, ১৮৯৯’–এর তথ্যানুযায়ী ওই বছর লাঙ্গলবন্দের মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি।
লাঙ্গলবন্দের স্মৃতি ধরা পড়ে বাসন্তী গুহঠাকুরতার শৈশব-স্মৃতিকথা ‘কালের ভেলায়’ গ্রন্থে। ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ফতুল্লা গ্রাম ও তার আশপাশের অঞ্চলের জীবনের নিপুণ এক চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। লাঙ্গলবন্দের মেলা নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেই সময় মেলা বসত আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায়। কত ভিড়, কত খেলনা, আর খাবার-ফুলুরি, তিলরি, নোনতা, মিষ্টি, ঝুরি!’
‘মেলায় যাওয়া ছিল খুব সহজ—বাড়ির ঘাট থেকে এক নৌকায় চড়ে সোজা লাঙ্গলবন্দের ঘাটে। সেই নৌকাটা ছিল যেন নিজের বাড়ির অংশ আর ব্রহ্মপুত্র নদীটা যেন একটি খাল।’ তাঁর স্মৃতিতে মেলাটাই প্রধান নয়, প্রধান ছিল এই তিথিতে ব্রহ্মপুত্র নদের লাঙ্গলবন্দে স্নানের মাহাত্ম্য। তিনি লেখেন, ‘পরশুরাম পিতার আদেশে মাকে হত্যা করে যে পাপ করেছিলেন, সেই পাপ খণ্ডন হয় এই পুণ্যতিথিতে এই ঘাটে স্নান করে।’
১৩৯৬ বঙ্গাব্দে একই দিনে পালিত হয়েছিল বাসন্তীপূজা, অষ্টমীর স্নান ও নববর্ষ উদ্যাপন। সেই দিনটিতে তাঁরা শিশুরা ‘জলছত্র’ দিতেন তীর্থযাত্রীদের জন্য—তাদেরই দায়িত্বে বড়রা এই কাজ দিয়েছিলেন। অনেক তীর্থযাত্রী স্নান শেষে হেঁটেই ফিরে যেতেন ঢাকায়, ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত হয়ে। তখন তাঁদের জল ও বাতাসা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো, বিশ্রামের স্থান দেওয়া হতো। তখন তো ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ বাস চলাচল শুরু হয়নি। আর সেদিন নারায়ণগঞ্জের সব স্কুলে ছুটি থাকত—একটি উৎসবময় স্মৃতি হয়ে থাকত লাঙ্গলবন্দের পূর্ণিমা।
অষ্টমী মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার জনস্বাস্থ্যও। ১৮৯৫ সালে ‘সময়’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মেলার সময় কলেরার প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। তীর্থযাত্রীদের নৌকায় বসবাস, গোসল ও রান্নার জন্য নদীর জল ব্যবহার—সব মিলিয়ে রোগ ছড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করত। কলেরা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে টিকাদান ও মেডিকেল টিম পাঠানো হতো। খাজা ইউসুফের মতো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের উদ্যোগে এলাকাটিতে সুপেয় পানির স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। তিনি ছিলেন নওয়াব আহসান উল্লাহর ভগ্নিপতি এবং দীর্ঘদিন ঢাকা পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ফর ১৮৬৭-৬৮’-তে দেখা যায়, মেলার সময় সরকার কীভাবে রাজস্ব আদায়ে ভূমিকা রাখত। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, ঢাকা বিভাগের কমিশনার নির্দেশ দেন—যেসব জমিদারের জমিতে বার্ষিক লাঙ্গলবন্দ মেলা বসে, তারা যেন মেলার জন্য জমি ভাড়া বা ফি আদায় করতে পারেন। এই ফি সংগ্রহ করা হতো মেলায় অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ী ও দর্শনার্থীদের কাছ থেকে, যাঁরা জমি ব্যবহার করতেন বা নৌকা ভেড়াতেন। তবে একটি শর্ত ছিল—এই আয়ের ২৫ শতাংশ ব্যয় করতে হবে স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতাব্যবস্থার উন্নয়নে। অনেক জমিদার সরাসরি এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিলেন, যাতে তাঁদের আয়ের নির্দিষ্ট অংশ দিতে না হয়। প্রশাসন পরে সিদ্ধান্ত নেয়, যতক্ষণ তাঁরা কার্যকরভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবেন, ততক্ষণ অতিরিক্ত অর্থ দাবি করার প্রয়োজন নেই। একই ব্যবস্থা দেখা যায় ঢাকা বিভাগের বারুণী মেলার ক্ষেত্রেও।
তীর্থযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কার্যক্রমও ছিল উল্লেখযোগ্য। ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন সম্মেলন ১৯২৬’ অনুযায়ী ঢাকা শাখা রামকৃষ্ণ মিশন ১৯১৫ সাল থেকে লাঙ্গলবন্দে অষ্টমী স্নান মেলায় ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ১৯৩৭ সালে আহমদিয়া সম্প্রদায় মেলায় ১৫ হাজারের বেশি ইশতেহার বিতরণ করে ধর্মীয় প্রচারে অংশ নেয়।
সব মিলিয়ে লাঙ্গলবন্দের মেলা শুধু একটি ধর্মীয় আয়োজন নয়—এটি ছিল ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং প্রশাসনের এক জটিল অথচ চমৎকার সমন্বয়। এই তীর্থস্থান এবং মেলা আজও আমাদের অতীতের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে, যেখানে ইতিহাস, বিশ্বাস, লোকজ সংস্কৃতি ও সামাজিক বাস্তবতা এক সূত্রে গাঁথা।
বিশ শতকের শুরুতে, ব্র্যাডলি বার্ট তাঁর অমর গ্রন্থ ‘দ্য রোমান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’-এ ‘চৈত্র মাসের অষ্টমী’ শীর্ষক একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় উৎসর্গ করেছেন লাঙ্গলবন্দের স্নান-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে। ১৬ পৃষ্ঠার এই সাহিত্যকর্মের সমাপ্তিতে তিনি লিখেছেন:
‘আস্তে আস্তে দিন শেষ হয়ে যায়। জনস্রোত এবার গৃহাভিমুখী হয়। অস্ত আকাশে আগুন ছড়িয়ে সূর্য ডুবে যায়। আকাশে আর নদীতে প্রতিবিম্বিত হয় তার জ্বলন্ত আভা। নদী পরিষ্কার হয়ে ওঠে। অশ্রান্ত মর্মরধ্বনি তুলে বিশাল ব্রহ্মপুত্র ছুটে চলে। বছরের এই একটি দিনে-চৈত্রের শুক্লাষ্টমীতে তার প্রশস্ত বুকে লক্ষ লক্ষ মানুষের সর্বপাপ বয়ে নিয়ে সমুদ্রে নিমজ্জিত করে সে।’
লাঙ্গলবন্দ কেবল হিন্দু ভক্তির এক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই নয়; বরং পূর্ববঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শ্রদ্ধাভরে হোক বা কৌতূহলভরে, এটি আজও তার বিশ্বাস ও উৎসবের চিরন্তন ছন্দে মানুষের বিস্ময় জাগিয়ে তোলে। একদিকে এটি পাপমোচনের পুণ্যস্নানের প্রতীক, অন্যদিকে এটি জনসমাগম, বাণিজ্য এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার একটি চ্যালেঞ্জও বটে।