‘চরিত্ররা কেউ কথা বলে না, শুধু হাঁটে আর চিন্তা করে!’

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই, ১৯৮৫

বুদাপেস্টের এক বিষণ্ন বিকেল। শহরের বুকজুড়ে নীরবতা, বৃষ্টি পড়ছে অনবরত, আর এক তরুণ লেখক কাঁধে একটি ছেঁড়া ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছেন প্রকাশনা অফিসের দিকে। ব্যাগে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সাতানট্যাঙ্গো’র পাণ্ডুলিপি। ১৯৮৩ সাল। হাঙ্গেরিতে তখন কঠোর সমাজতান্ত্রিক শাসন, সাহিত্যে কেবল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশানা দেখানো ছাড়া অন্য বয়ান সরকারের কাছে ‘অনুচিত’ মনে করা হয়।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই তখনো একেবারেই অজানা নাম। প্যারিস রিভিউকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাসলোর ভাষায়, ‘আমি কেবল চেয়েছিলাম মানুষকে তার নিজের ভয়টার সামনে দাঁড় করাতে। প্রকাশক পাণ্ডুলিপি দেখে দ্বিধায় পড়েছিলেন। তিনি বলেন, এই বইয়ে তো কেউ কথা বলে না, শুধু হাঁটে আর চিন্তা করে! পাঠক কি ঘুমাবে না?’

লাসলো শান্তভাবে জবাব দেন, ‘তারা ঘুমাবে না, তারা ভয় পাবে।’ সংলাপটি প্রথম উল্লেখ করেন লেখকের জীবনীকার জর্জ শির্তেশ (George Szirtes), যিনি ‘সাতানট্যাঙ্গো’র ইংরেজি অনুবাদকও।

সাতানট্যাঙ্গো বইয়ের প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে হাঙ্গেরির মগভেত্যু কিয়াদো (Magvető Kiadó) থেকে। প্রথমে খুব সীমিত সংস্করণে প্রকাশ পেলেও কয়েক মাসের মধ্যে এক অদ্ভুত সাড়া জাগে। তখনকার পাঠক ও সমালোচকেরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। কেউ বলেন, ‘এটা বোঝা যায় না’, কেউ বলেন, ‘এটা যেন বৃষ্টির ভেতর ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর অন্ধকার সিম্ফনি।’

সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটে বুদাপেস্টের একটি ছোট বইয়ের দোকানে। হাঙ্গেরিয়ান লিটারেচার অনলাইনকে ২০১৪ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্রাসনাহোরকাই বলেন, ‘একদিন ফোন পেলাম, দোকানের সামনে সারা রাত পাঠকেরা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা দোকান খোলার অপেক্ষায়, শুধু আমার বই কিনবেন বলে। আমি গিয়ে দেখি, সত্যিই তা–ই। কেউ ছাতা ধরে আছেন, কেউ ভিজে একাকার।’

পরে লাসলো বলেন, ‘তখন বুঝেছিলাম, যে গল্পে ভয় আছে, নিঃসঙ্গতা আছে, অথচ মানুষ সেটি পড়তে চায়, তাহলেই তা সত্যি গল্প।’

এই প্রথম সাফল্যের পর থেকেই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় একধরনের অস্তিত্ববাদী রসবোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর চরিত্ররা যেমন অনন্ত অন্ধকারে পথ খোঁজে, লেখক নিজেও যেন হারিয়ে যান নিজের গল্পের ভেতর। এ যেন জীবনেরই এক অবিরাম নৃত্য, ‘সাতানট্যাঙ্গো’ নামের মতোই। ২০১৮ সালে বিবিসি হাঙ্গেরিয়ান সার্ভিস এক সাক্ষাৎকারে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করে, কেন তাঁর লেখা এত বিষণ্ন অথচ তিনি হাসছেন? ক্রাসনাহোরকাই তখন বলেন, ‘কারণ আমি জানি, সব ট্র্যাজেডির ভেতরও কৌতুক লুকিয়ে থাকে।’

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর লাসলোর সেই পুরোনো হাসিই যেন আবার ফিরে এসেছে শুরুর দিককার সেই বৃষ্টিভেজা বিকেলের স্মৃতি হয়ে।

গ্রন্থনা: বোদরুল হেকীম