আমি তাঁকে হক সাহেবই বলতাম
২৭ ডিসেম্বর সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে আয়োজন
শুভ জন্মদিন (২৭ ডিসেম্বর) হক সাহেব! আমি তাঁকে হক সাহেবই বলতাম। যদিও অন্যরা কেউ বলত হক ভাই, কেউ বলত সৈয়দ হক। আমাকে অবশ্য খুব কম সময়ই সরাসরি সৈয়দ শামসুল হককে সম্বোধন করতে হয়েছে। আমি যদিও তাঁকে হক সাহেব বলতাম, কিন্তু তাঁর প্রতি আমার আকাশচুম্বী শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা ছিল, এ কথা সত্য। থাকবে না কেন? তাঁর বাংলা তো সাধারণ লোকের সাধারণ বাংলা ছিল না। কঠিন বাংলায়, অপরিচিত সব শব্দ চয়ন করে অবলীলায় অনর্গল মিষ্টি করে কথা বলে যেতেন। তিনি কথা বললে খুব মন দিয়ে শুনতে হতো, যাতে কোনো রস থেকে বঞ্চিত না হই। কোনো একটা অনুষ্ঠানে সেই সময় আমার সঙ্গে ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ মিসেস নিলুফার মঞ্জুর। আমিই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার কিছুই মনে নেই, শুধু মনে আছে, হক সাহেব মঞ্চে উঠেই হাসিমুখে অল্প কয়েকটা কথা বললেন। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম, মিসেস মঞ্জুর তাঁর কথাগুলো খুব উপভোগ করছিলেন এবং আমাকে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন অনেকটা এমন, ‘উনি (হক সাহেব) যা-ই বলেন সবই কি এত সুন্দর, সুশ্রাব্য, সমৃদ্ধ আর রসময় হয়?’ আমি বলেছিলাম, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। ভাষার ওপর তাঁর অসামান্য দখল, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
আমি সৈয়দ শামসুল হকের অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পাই—বেশির ভাগই তাঁর কালজয়ী সুলিখিত কয়েকটি নাটকের মাধ্যমে।
ধরা যাক, থিয়েটারের অন্যতম মঞ্চসফল নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়–এর কথা। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা একটি অসাম্প্রদায়িক নাটক। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এতটাই দর্শকনন্দিত যে নাটকটি ২০০ বারের বেশি অভিনীত হয়েছে মঞ্চে। এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছরই ডিসেম্বর মাসে এ নাটকের আমন্ত্রণ আসে আমাদের কাছে এবং সমানভাবে এর আবেদন পরিলক্ষিত হয়।
যেহেতু সৈয়দ শামসুল হকের বেশ কয়েকটি নাটকে আমি মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছি, সে ক্ষেত্রে এসব নাটক ধরেই আমি এগিয়ে যেতে চাই। অকিঞ্চিৎকর এ রচনায় আর কিছুই নয়, হক সাহেবের জ্ঞানভান্ডার এবং নাটক লেখায় তাঁর অতুলনীয় বিস্ময়কর দক্ষতা তুলে ধরার চেষ্টা করব কিছুটা।
প্রথমে আমি জানতাম, তিনি একজন কবি। কবি হিসেবে তাঁর ‘আমার পরিচয়’ নামের যে কবিতা, সেটা পড়েই আমি বিস্মিত। এ কবিতার সঙ্গে আমি আরও পরিচিত হই যখন কবিতাটা আমার ছাত্রদের পড়াই। পড়াতে গেলে প্রচুর পড়তে হয়, সবাই জানে। তাই এ কবিতা আমি যে কতবার পড়েছি! নিজে বুঝেছি এবং ওদের বুঝিয়েছি। বাঙালির পরিচয় এত পরিষ্কার ও সঠিকভাবে কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হিম্মতের ব্যাপার বটে! ধীরে ধীরে দেখলাম, তিনি কত বড় গল্পকার, কত বড় ঔপন্যাসিক, কত বড় নাট্যকার আর কত বড় কাব্য–নাট্যকার আর তিনি যে অপূর্ব অনুবাদকও, সে কথা না বললেই নয়। যখন যা লিখেছেন, সবার অন্তরে তা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের আগে কাব্যনাট্য বিষয়ে বিশেষ স্পষ্ট ধারণা আমার ছিল না। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এ অভিনয় করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝলাম, কী দুরূহ এ কাজ। আর যিনি এ নাটক লিখেছেন, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, তাঁর কথা মনে হলে মাথা নত হয়ে আসে। আমার সাতজনমের ভাগ্য যে আমি সে নাটকে অভিনয় করতে পেরেছি। এর ভেতরে যেমন কাব্যময়তা আছে, তেমনি রয়েছে এর নাটকীয়তা। আমার মনে হয়, নাটকটি হক সাহেবের অমর সৃষ্টি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ নাটকের ভাষা বুঝতেই অনেক সময় লেগেছে আমাদের শিল্পীদের। তারপর সেটাকে অভিনয়ে পরিণত করা? বিস্তর সময় লেগেছে। তবে নাটকটি দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মধ্যে সিংহভাগ কৃতিত্ব ছিল নির্দেশক আবদুল্লাহ আল-মামুনের। হক সাহেব যেভাবে লিখেছেন, সেই কাব্যময়তা বজায় রেখেই গদ্যরীতিতে অভিনয় করা মহা কঠিন। আর উপমা ব্যবহার করার কথা কী বলব! ‘জিগ্যাসা করেন তারে, (মাতবর, অর্থাৎ আবদুল্লাহ আল-মামুনকে লক্ষ্য করে বলছি) এক রাত্রি পরে সাধের জামাই তার নাই ক্যান ঘরে? রাত্রি দুই পহরে ক্যান সে ফালাইয়া গেল—
আমার এ জীবন
হঠাৎ খাটাসে খাওয়া
হাঁসের মতন?’
‘হঠাৎ খাটাসে খাওয়া হাঁস’ কথাটার ভেতরকার অর্থ বোঝা কি এত সহজ? ‘খাটাস’ যে একটা হিংস্র প্রাণী, সেটাই তো আমরা অনেকেই জানি না। অনেক পরে ‘আমি’ রাজাকার নির্যাতিত মাতবরের মেয়ে পড়ে পড়ে উপলব্ধি করেছিলাম, কী নির্মম দুঃসহ এ যন্ত্রণা। এভাবে আরও কত কত উপমা—যেমন খালুই, ইচা মাছ। ‘য্যান কেউ নিয়া গেছে গাভিনের বাঁটে যতটুকু দুধ আছে, নিষ্ঠুর দোহন দিয়া’, গরুর দুধ দোহায়ানোর এ দৃশ্য কেউ যদি না দেখে থাকে, তবে বুঝবে কী করে সেটা কত নিষ্ঠুর। হক সাহেবের যে গ্রামীণ ভাষা, গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে মাখামাখি ছিল, সেটাও তাঁর রচনা পড়লেই স্পষ্ট বোঝা যায়। খাটাস কী এবং সেটা একটা হাঁসকে অর্ধেক খাওয়া অবস্থায় রেখে ফেলে গেলে ওই হাঁস তো অর্ধমৃতই হয়ে যায়। তবে আমার কাছে আজও অজানা–অচেনা আছে খাটাসটা। শুধু এটুকু মনে আছে, কেউ অপরিষ্কার থাকলে, নোংরা অর্থে আমার মা তাকে বলতেন, ‘দূর হ খাটাস কোথাকার!’ এ পর্যন্তই। না, আমি আর ব্যাখ্যা করব না। সব উপমার ব্যাখ্যা দিতে গেলে আমার এ লেখা একটা থিসিস হয়ে যাবে। অবশ্য হক সাহেবের আরও সুন্দর সুন্দর দিক উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সন্দেহ নেই।
ম্যাকবেথ–এর কথা একটু না বললে মহা অবিচার হয়ে যাবে। শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকটি তিনি অনুবাদ করেছেন। এ অনুবাদও অনবদ্য। এটাও কাব্যনাট্য। ভাষা ও সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ একটা নাটক। ম্যাকবেথ–এর কাহিনি রাজপরিবারকেন্দ্রিক। ফলে এতে আছে রাজা–রাজড়ার ব্যাপার। তো অনুবাদটাও তেমনি সহজ অথচ রাজকীয় হয়েছে। উচ্চাভিলাষী লেডি ম্যাকবেথ, ভীরু ম্যাকবেথকে অভিযুক্ত করে তিরস্কার করে বলছে, ‘তবে কি এ ঠিক, সে
বেড়ালের মতো/ যার আছে লোভ মাছে কিন্তু
পানি সে ছোঁবে না?’
দৃপ্ত অসম সাহসী এবং ব্যক্তিসম্পন্ন রানি, মারতে গিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ম্যাকবেথকে লক্ষ্য করে বলছে, ‘স্তন্যদান শিশুকে করেছি,/ জানি, স্তন্যপানরত শিশু কী সুন্দর হয়, স্নেহে কতখানি হয়, তবু সেই/ আমি সেই শিশুকেই দন্তহীন মাড়ি থেকে স্তনবৃন্ত সবলে ছাড়িয়ে/ নিয়ে আছাড় দিতাম, চূর্ণ করে দিতাম করোটি।’
কী সাংঘাতিক!
এ অনুবাদ করা কি চাট্টিখানি কথা! ম্যাকবেথ ইতস্তত করে যখন বলছিল, ‘যদি সফল না হই?’ তখন দৃপ্ত ভঙ্গিতে লেডি ম্যাকবেথের সাহসী উচ্চারণ ছিল, ‘সফল না হই, সাহসের ছিলা কর টান টান।’ এ সংলাপ কি ভোলা যায়?
ম্যাকবেথ–এর প্রযোজনাটাও খুব সমৃদ্ধ ছিল। আমার অর্জন এই যে এ নাটকের লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রে অভিনয় করে আমি লেখককে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি, তাঁর প্রশংসাও কুড়িয়েছি, তাঁর প্রিয়পাত্র হয়েছি। এ আমার পরম পাওয়া। সেদিন হক সাহেব বলছিলেন, ‘ফেরদৌসী, ম্যাকবেথ–এ লেডি ম্যাকবেথের “স্লিপ ওয়াক”টা আমার বড় প্রিয় জায়গা। ওটা আপনি মুখস্থ করে রাখবেন। প্রয়োজনে ওখান থেকে অভিনয় করবেন।’
হক সাহেবের অনুবাদে আমি টেম্পেস্ট নাটকেও অভিনয় করেছি। সেটা আর বললাম না। হক সাহেবের প্রতিভার সীমা–পরিসীমা নেই। আর সে প্রতিভার স্বাদ আমি যেটুকু পেয়েছি, সেটুকু নিয়েই আমি বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞ। হক সাহেবকেও আমি কৃতজ্ঞতা জানাই, তাঁর এ জ্ঞানভান্ডারের কিছু আহরণ করার ক্ষেত্রে আমাকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
২.
এবার একটু হালকা কথা বলে শেষ করব। হক সাহেব কিন্তু বেশ রোমান্টিকও ছিলেন। ২০১১ সালে হক সাহেব, তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক ভাবিসহ আরও কয়েকজন মিলে আমরা শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম একটা কর্মশালায়। আমি ভাবির জন্য একটা সুন্দর খোঁপার কাঁটা কিনেছিলাম। হক সাহেব কাঁটাটা দেখে এত উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে বললেন, ‘নাও না কাঁটাটা। ফেরদৌসীর মতো সুন্দর করে খোঁপায় কাঁটাটা লাগাও। তোমাকেও সুন্দর দেখাবে।’
এখানে এখন নামে একটা কাব্যনাটক লিখেছিলেন সৈয়দ হক, যেটা ১৯৮০ সালে থিয়েটার থেকে মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমি আর আবদুল্লাহ আল-মামুন মুখ্য চরিত্র করেছিলাম। নাটকটা আমাদের খুব ভালো লাগত। কিন্তু কোনো একটা কারণে সেটা দর্শক–শ্রোতাকে টানতে পারেনি। তবে নাটকটি খুব রোমান্টিক ছিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম, হক সাহেব যখন আমাকে বললেন, ‘ফেরদৌসী, এখানে আপনি নীল শাড়ি পরবেন। হাতে কাচের চুড়ি পরবেন।’ এত রোমান্টিকও ছিলেন হক সাহেব! এ বিষয়ে তাঁর প্রিয় স্ত্রী, আমাদের ভাবি ভালো বলতে পারবেন।
আমাদের শিল্পজগতে সৈয়দ শামসুল হকের আরও কিছুদিন বেঁচে থাকা উচিত ছিল। তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর লেখনীর দ্বারা উপকৃত হতে পারত। তবে এটুকু আমি স্বার্থপরের মতো বলতে পারি, সৈয়দ শামসুল হকের যেটুকু আমি পড়েছি এবং অভিনয় করেছি, সেটুকুই–বা কজন পায়? ধন্যবাদ হক সাহেব। আমি কৃতজ্ঞ। ভীষণ কৃতজ্ঞ আপনার কাছে! তবে আপনি তো জীবনে তেমন অলস মুহূর্ত কাটাননি। প্রচুর কাজ করেছেন, কাজ করাই তো আপনার অভ্যেস ছিল। বেঁচে থাকলে আরও সাহিত্যের সৃষ্টি তো হতোই।
সৈয়দ হকের মতো বিশাল ব্যক্তির আমাদের বড্ড প্রয়োজন ছিল। তাহলে তাঁর জ্ঞানের দ্যুতি আরও ছড়াত আমাদের মধ্যে। আমাদের সাহিত্যের জগৎ সমৃদ্ধ হতো। যাক, হলো না। সব কি চাইলেই পাওয়া যায়? ওপরওয়ালার ইচ্ছার ওপর তো আর কোনো কথা চলে না। আপনার আত্মার প্রশান্তি একান্তভাবে কামনা করি।