উসমানীয় জেরুজালেমের স্মৃতিবিজড়িত খালিদি লাইব্রেরি

উদ্বোধনের পর খালিদি লাইব্রেরি, সর্বডানে এর প্রতিষ্ঠাতা রাগিব আল-খালিদি, ১৯০০ছবি: উইকিপিডিয়া

জেরুজালেমের ‘ওল্ড সিটি’তে পাথরে বাঁধানো অলিগলির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে সময়ের এক নীরব সাক্ষী—খালিদি লাইব্রেরি। ১৯০০ সালে পুরোনো জেরুজালেমে আল–আকসা মসজিদের কাছে বাব আল-সিলসিলা রোডে অটোমান শাসনামলে এটি গড়ে তোলা হয়। প্রতিষ্ঠাতা হাজি রাগিব আল-খালিদি ও তাঁর পরিবার। পরিবারের নিজস্ব উদ্যোগে সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিগুলো একত্র করে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করেন খালিদি। শুরু থেকেই এ সংগ্রহ—গবেষক, ইতিহাসবিদ ও বিশিষ্ট পাঠকের জন্য উন্মুক্ত ছিল।

উসমানীয় যুগে খালিদি পরিবারের বহু সদস্য বিচারপতি, আলেম ও প্রশাসকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা সে সময় জেরুজালেমের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের নেতৃত্ব দিতেন। এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঐতিহ্য ও জ্ঞানচর্চাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করেছেন।

লাইব্রেরির সংগ্রহে আছে হাজার বছরের পুরোনো—দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কবিতা ও ইতিহাসের অমূল্য সব হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। কিছু কপি সোনালি কালিতে অলংকৃত। এখানে সংরক্ষিত হাতে লেখা ১২ শতাধিক পাণ্ডুলিপি ফিলিস্তিনি ও আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে ধারণ করছে। একই সঙ্গে জেরুজালেমের বৌদ্ধিক সংস্কৃতিরও প্রমাণ বহন করে চলেছে। অবশ্য এককভাবে শুধু ফিলিস্তিনিদের বা আরবি সাহিত্যের গৌরবেরই নয়, একই সঙ্গে এটি ফারসি ও তুর্কি ভাষাভিত্তিক জ্ঞানচর্চারও মিলনস্থল।

উসমানীয় যুগে খালিদি পরিবারের বহু সদস্য বিচারপতি, আলেম ও প্রশাসকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা সে সময় জেরুজালেমের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের নেতৃত্ব দিতেন। এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঐতিহ্য ও জ্ঞানচর্চাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করেছেন।
খালিদি লাইব্রেরি, সাম্প্রতিক ছবি
ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৭ সালের জুন মাসে ইসরায়েল-আরব ছয় দিনের যুদ্ধের পর লাইব্রেরিটি জেরুজালেমের রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। দখলের পর কিছু সময়ের জন্য লাইব্রেরিটি বন্ধ হয়ে যায়। এর তত্ত্বাবধানে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ শুরু হয়। তারা লাইব্রেরিটি সরাসরি বাজেয়াপ্ত করেনি; কিন্তু প্রবেশ, পুনর্নির্মাণ ও প্রশাসনিক কাজ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। ভৌগোলিকভাবে এখন ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত হলেও, এর আইনি মালিকানা ও পরিচালনা ফিলিস্তিনি আল-খালিদি ফ্যামিলি ট্রাস্টের অধীনেই হয়ে থাকে। ১৯৮০-১৯৯০ সালে ইউনেসকো ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের সহায়তায় এর ভবন ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু হয়। তখন থেকে পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার ভল্টে সংরক্ষণ শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে গবেষকদের জন্য গ্রন্থাবলির নির্ধারিত কিছু অংশ ডিজিটাল আর্কাইভে রূপান্তর করা হয়েছে।

খালিদি লাইব্রেরির সংগ্রহে থাকা একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি
ছবি: সংগৃহীত

খালিদি লাইব্রেরির কিছু বই খুবই দুর্লভ এবং ঐতিহাসিকভাবে অমূল্য। ‘রিসালা ফি আল-হিসাব’ গণিত ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে প্রাথমিক রচনাগুলোর একটি। লেখকের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায় না, সম্ভবত তিনি ফিলিস্তিনি বা দামেস্কের পণ্ডিত ছিলেন। এই পাণ্ডুলিপিতে আরবি সংখ্যা পদ্ধতি, জ্যামিতি ও বাণিজ্যিক হিসাবের ব্যবহারিক দিক বর্ণিত হয়েছে। মধ্যযুগে আরব বিশ্বের প্রায়োগিক গণিতচর্চার দুর্লভ দলিল এটি। জেরুজালেম ও আশপাশের সামাজিক ইতিহাস, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কর–ব্যবস্থা নিয়ে রচিত গ্রন্থ ‘আখবার আল-কুদস’। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, শিক্ষা ও প্রশাসনিক কাঠামোর তথ্য পাওয়া যায়। এটি ফিলিস্তিনের নগর সমাজের প্রাচীনতম দলিলগুলোর একটি। ‘আল-আদব আল-ফিলিস্তিনি আল-মু’আসির’ গ্রন্থটি উনিশ শতকের ফিলিস্তিনি কবিতা ও গদ্যের সংকলন। স্থানীয় বিভিন্ন লেখকের লেখা সংগ্রহ করে খালিদি পরিবার এটি সংকলন ও সংরক্ষণ করেছে। ফিলিস্তিনের সাহিত্যিক ও ভাষাগত ঐতিহ্যের সন্ধান দেয় এসব রচনা—যেখানে ভূমি, রাজনৈতিক সংগ্রাম, প্রেম ও নির্বাসনের স্মৃতি একত্র হয়েছে। ফিলিস্তিনের মধ্যযুগের ইতিহাস জানার অন্যতম প্রাচীন উৎস ‘তরিখ আল-মামলুক’, এখানে মধ্যযুগের মিসর ও সিরিয়ার মামলুক রাজবংশের রাজনৈতিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। তৎকালীন শাসনব্যবস্থা, রাজনীতি, সেনাবাহিনী ও বাণিজ্যের বিস্তারিত বিবরণ আছে এতে।

ভৌগোলিকভাবে এখন ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত হলেও, এর আইনি মালিকানা ও পরিচালনা ফিলিস্তিনি আল-খালিদি ফ্যামিলি ট্রাস্টের অধীনেই হয়ে থাকে। ১৯৮০-১৯৯০ সালে ইউনেসকো ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের সহায়তায় এর ভবন ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু হয়।
পুরোনো পার্সিয়ান পাণ্ডুলিপিতে ঐতিহ্যবাহী মিনিয়েচার আর্ট
ছবি: সংগৃহীত

লাইব্রেরিতে আছে কোরআন শরিফের কয়েকটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, যেগুলোর কিছু ১১–১২ শতকের এবং কিছু ১৩–১৪ শতকের। এগুলো মূল আরবি ক্যালিগ্রাফিতে হাতে লেখা, এখন বিশেষ নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার ভল্টে সংরক্ষিত থাকে। সময় ও পরিবেশের কারণে কিছু পৃষ্ঠা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ লেখা এখনো স্পষ্টভাবে পড়া যায়। সবচেয়ে পুরোনো কপিগুলোর কিছু লেখা হয়েছে কুফিক লিপিতে। এটি ইসলামি ইতিহাসের প্রাচীনতম ক্যালিগ্রাফি রীতি, যেখানে অক্ষরগুলো চওড়া, কোণাকৃতি ও গাঢ় কালিতে লেখা হয়। পরবর্তী কিছু পাণ্ডুলিপি লেখা হয়েছে নাসখ ও মাগরিবি লিপিতে। অনেক পাণ্ডুলিপিতে সোনালি, নীল বা লাল রঙে সুরা, নাম ও আয়াত বিভাজন করা হয়েছে। কিছু কপিতে পৃষ্ঠা প্রান্তে জ্যামিতিক অলংকরণ ও ফুলেল নকশা আছে। ধারণা করা হয়, এই কোরআনগুলো দামেস্ক, কায়রো ও জেরুজালেম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। খালিদি পরিবারের পূর্বপুরুষেরা ব্যক্তিগতভাবে এসব পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করেন। কিছু কপিতে তাঁদের পরিবারের হাতে লেখা নোট ও মালিকানার সিল দেখা যায়।

১৬ শতকের কোরআন শরিফ
ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক বিশ্বের পড়ুয়া সংস্কৃতিতে খালিদি লাইব্রেরির ঐতিহ্যগত খ্যাতি দিনকে দিন বাড়ছে। লাইব্রেরির হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, সোনালি অক্ষর, পুরোনো কাগজ, মামলুক যুগের স্থাপত্য ও এখানকার পাণ্ডুলিপির ক্যালিগ্রাফি শিল্প ইসলামি নান্দনিকতার সাক্ষ্য বহন করছে। আধুনিক পৃথিবীতে ক্যালিগ্রাফিকে শিল্পের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রেখেছে লাইব্রেরিটি। আজ তাই বিশ্বব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত টাইপোগ্রাফি ও ক্যালিগ্রাফি শিল্প সংশ্লিষ্টদেরও তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে উসমানীয় জেরুজালেমের স্মৃতি বহনকারী এই খালিদি লাইব্রেরি।