সংস্কার নয়, গঠনতন্ত্র মানলেই সমাধান

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

বাংলা একাডেমির অবিকৃত গঠনতন্ত্রটি হাতে পেলে একবার পড়ুন। তাহলেই বুঝবেন আলাদাভাবে সংস্কার করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, গঠনতন্ত্রে বাংলা একাডেমি পরিচালনার যে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে, সেগুলো মেনে চললে যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ চিন্তক, লেখক, মননশীল মানুষেরা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। গঠনতন্ত্র পুরোপুরি গণতান্ত্রিক এবং গতিশীল একাডেমি গঠনের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত ছিল। কিন্তু সেই গঠনতন্ত্রকে বারবার বিকৃত করা হয়েছে। যা-ও বা আছে, সেই পোকায় কাটা গঠনতন্ত্রটিকেও পাশ কাটিয়ে শাসক ও কর্মকর্তাদের ইচ্ছেমতো একাডেমি পরিচালনা করার ফলে ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান দুরবস্থা। 

একাডেমির স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে মহাপরিচালক এবং কার্যনির্বাহী পরিষদ ঠিকভাবে কাজ করতে পারেননি। অবশ্য সৎ এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহাপরিচালকেরা ঠিকই দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে পেরেছেন। অধ্যাপক হারুন অর রশীদ পরিষ্কারভাবে সব ধরনের হস্তক্ষেপ থেকে একাডেমিকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বাংলা একাডেমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সংলগ্ন প্রতিষ্ঠান, কিন্তু অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান নয়।

একাডেমির বাজেট অনুযায়ী সরকার অর্থ বরাদ্দ দেয়। সেই অর্থ আসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাহক বা মাধ্যমমাত্র। বরাদ্দকৃত টাকার কাটছাঁট বা খাত নির্ধারণ করার অধিকার মন্ত্রণালয়ের নেই।

একাডেমির বাজেট অনুযায়ী সরকার অর্থ বরাদ্দ দেয়। সেই অর্থ আসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাহক বা মাধ্যমমাত্র। বরাদ্দকৃত টাকার কাটছাঁট বা খাত নির্ধারণ করার অধিকার মন্ত্রণালয়ের নেই। শুধু সংস্কৃতি নয়, কোনো মন্ত্রণালয়েরই–বা কোনো আমলার খবরদারির সুযোগ নেই। মহাপরিচালক জবাবদিহি করবেন কেবল সাধারণ পরিষদের কাছে। সাধারণ পরিষদই সর্বোচ্চ ফোরাম। যেখানে একাডেমির সব সাধারণ সদস্য, ফেলো সদস্য, সম্মানিক সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত।

আর একাডেমির সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে কার্যনির্বাহী পরিষদের দ্বারা। এখানেই সমস্যার সব জট তৈরি হয়ে আছে। গত ২৫ বছর ধরে কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠিত হচ্ছে মহাপরিচালক এবং আমলাদের পছন্দ অনুযায়ী। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির পাশাপাশি তাঁদের পছন্দনীয় একজনমাত্র লেখক বা কবিকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। 

কিন্তু গঠনতন্ত্র কী বলছে? বলছে পরিচ্ছন্ন পদ্ধতিতে উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করতে হবে। সাধারণ সদস্যদের মধ্যে চারজন এবং ফেলো সদস্যদের মধ্যে দুজন বা তিনজন নির্বাচিত হবেন। সারা দেশের সব সদস্য ভোটার। তাঁরা তাঁদের পছন্দের যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন। সেই নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হবে কার্যনির্বাহী প্রতিষ্ঠান। 

এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে অসুস্থ ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মনোনীত সদস্যদের তুলনায় নির্বাচিত হয়ে আসা সদস্যদের মানসিক এবং নৈতিক মনোবল অনেক বেশি থাকে। মনোনীত ব্যক্তিদের মতো জি হুজুর পদ্ধতির ধার ধারার প্রয়োজন পড়ে না নির্বাচিত সদস্যদের।

মহাপরিচালক এককভাবে কী ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন বা তাঁর ক্ষমতার সীমা কোন পর্যন্ত, তা উল্লেখ করা আছে গঠনতন্ত্রে। মহাপরিচালক তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও পরবর্তী কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় সেই সিদ্ধান্তের অনুমোদন নিতে হবে। যৌক্তিক মনে না হলে পরিষদ মহাপরিচালকের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে। 

কার্যনির্বাহী পরিষদ নামে আছে জি হুজুরের দল। নির্বাচনের সুস্পষ্ট বিধান এবং বাধ্যতা থাকলেও তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দশকের পর দশকজুড়ে একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে এবং আমলাদের ম্যানেজ করে মহাপরিচালকেরা চালিয়ে যাচ্ছেন একনায়কত্ব। তাই সবকিছুতেই বিতর্ক। পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক, বই প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক, বইমেলা নিয়ে বিতর্ক।

বাংলা একাডেমি যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যে যে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে বইমেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পৃথিবীর কোনো দেশে বাংলা একাডেমির মতো কোনো প্রতিষ্ঠান বইমেলার আয়োজক ও পরিচালক হয় না।

বইমেলা নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলা দরকার। বাংলা একাডেমি যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যে যে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে বইমেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পৃথিবীর কোনো দেশে বাংলা একাডেমির মতো কোনো প্রতিষ্ঠান বইমেলার আয়োজক ও পরিচালক হয় না। সব দেশে প্রকাশকদের সমিতি বা গিল্ড বইমেলার আয়োজন করে। সরকারের সব সংস্থা তাতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা জোগান দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে জনমনে এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যেন বইমেলার আয়োজন করাটাই বাংলা একাডেমির প্রধান কাজ। পর্যবেক্ষণ করেছি, বইমেলার মাস তো বটেই, তার আগের অন্তত দুই মাস এবং পরের এক মাস, মোট চার মাস বাংলা একাডেমির আর কোনো কাজ থাকে না। আসলে কাজ করার কোনো সুযোগ থাকে না। একাডেমির সমস্ত লোকবল নিয়োজিত থাকে বইমেলায়। তাতে তাঁদের আগ্রহ আবার সুপ্রচুর। মোটা অঙ্কের বৈধ বোনাস তো পাওয়া যায়-ই। সঙ্গে আছে নানা রকম উপরি পাওনা। স্টল বরাদ্দ, স্টল নির্মাণের কাজ পাইয়ে দেওয়া, খাবার ও পানীয়ের স্টলগুলো পাইয়ে দেওয়া—এসব নিয়ে যে কত টাকার লেনদেন হয়, তা সাধারণ মানুষের ধারণাতেও আসবে না।

আর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার তো এখন প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। উপঢৌকন পেয়ে হোক, আর স্বজনপ্রীতি-বন্ধুত্বের খাতিরেই হোক, কাউকে পুরস্কার দেওয়ার সময় এইটুকু তো অন্তত খেয়াল রাখা দরকার যে পুরস্কার-প্রাপকের অন্তত একটি হলেও উল্লেখযোগ্য রচনা আছে। তাতে দেওয়ার দাবিটা জোর পায়। কিন্তু কে ভাবে এসব কথা। স্বাধীনতা পুরস্কার বাগানো রইজউদ্দিনের মতো অনেক রইজউদ্দিনই বাংলা একাডেমি পুরস্কার বগলদাবা করেছেন। 

গত রেজিমের শেষ দিকে একটি নতুন ঝামেলা চালু হয়েছে। বাংলা একাডেমিতে কর্মরতদেরও পুরস্কার দেওয়া। এই রেওয়াজ আগে তেমন ছিল না। সর্বোচ্চ আমলার কবিতার ওপর একটি আস্ত গ্রন্থ প্রণয়ন করে এক লোকগবেষক কর্মকর্তা পুরস্কার পেয়ে গেছেন। পরের কয়েক বছর সেই ধারাবাহিকতায় আরও কয়েকজন। ফেলো হচ্ছেন একাডেমির সর্বোচ্চ সম্মানীত ব্যক্তি। সব কর্মকর্তার ওপরে তাঁর সম্মান। একই ব্যক্তি সেখানে কর্মকর্তা এবং ফেলো হন কীভাবে!

অসংখ্য মৌখিক ও লিখিত প্রতিবাদ হয়েছে বাংলা একাডেমির অনিয়ম ও যথেচ্ছাচার নিয়ে। কখনো কানে তোলেন না কোনো মহাপরিচালক। তাঁদের খুঁটির জোর আলাদা। কারণ, কার্যনির্বাহী পরিষদের কাছে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। সর্বোচ্চ ফোরাম সাধারণ পরিষদেও জবাবদিহি করতে হয় না। জবাবদিহি করতে হয় না সারা দেশের মননশীল মানুষদের কাছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে বাংলা একাডেমি। 

তাই বলছি সংস্কার নয়, গঠনতন্ত্রকে সক্রিয় করার মধ্যেই বাংলা একাডেমির অধিকাংশ সমস্যার সমাধান নিহিত।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর সব জায়গাতেই সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। বাংলা একাডেমিকে সংস্কারের আগে মূল কাঠামোটিকে দাঁড় করানো দরকার। হযবরল অবস্থা দূর করার কিছু নিদান হয়তো সংস্কার কমিটি হাজির করবে। তাতে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হয় না। উল্টো একাডেমির স্বায়ত্তশাসন আরও খর্বিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে আমিও আছি।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)