বেগম পত্রিকা নূরজাহান বেগমের আত্মজীবনীর সমতুল্য হয়ে উঠেছে। ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ এবং প্রায় ১০০ বছরের কাছাকাছি সময়ে তাঁর তিরোধান। বাংলাদেশের নারী প্রগতির, সাহিত্যসাধনার, সাংবাদিকতার উজ্জ্বল ইতিহাসকে শতাব্দীর পথে এগিয়ে যাওয়ার পথে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল এক তারকা। অবগুণ্ঠিত নারী সমাজকে আলোয় আনার পেছনেও এই মহীয়সীর বড় ভূমিকা রয়েছে।
১৯২৫ সালের ৪ জুন তাঁর জন্ম চাঁদপুরের মেঘনাপারের গ্রাম চালিতাতলিতে। বেড়ে উঠেছেন কলকাতায়। বেগম রোকেয়া পরিচালিত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে শুরু হয় নূরজাহান বেগমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। এ স্কুল থেকেই ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে পাস করেন স্নাতক। সওগাত-এর প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কন্যা তিনি। সেই সূত্রে ১৯৪০ সাল থেকেই সাংবাদিকতা ও সমাজকর্মে হাতেখড়ি হয় তাঁর।
মনে আছে, বেগম পত্রিকার সূচনাপর্ব ও নিজের সাংবাদিক জীবনে প্রবেশের কাহিনি সম্পর্কে ‘নারীদের অপূর্ব জাগরণ’ শিরোনামে নিজের এক লেখায় খুব সুন্দর করে স্মৃতিচারণা করেছিলেন নূরজাহান বেগম, ‘আমার বাবা সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সব সময় ভাবতেন যে মেয়েদের লেখা ও ছবি নিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হবে। তিনি প্রতিবছর সওগাত পত্রিকার একটি মহিলা সংখ্যা বের করতেন।
তিনি ভাবলেন, বছরে মাত্র একটি মহিলা সংখ্যা বের করে নারীদের এগিয়ে নেওয়া যাবে না। নারীদের জন্য এমন একটি পত্রিকার পরিকল্পনা নিয়ে তিনি কবি সুফিয়া কামালের কাছে গেলেন। সুফিয়া কামাল আমাদের পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমার মায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব ছিল।
সুফিয়া কামাল বাবার প্রস্তাবে এককথায় রাজি হলেন। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হলো। আমি হলাম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। সুফিয়া কামাল চার মাস পর ঢাকায় চলে এলেন। এর পর থেকে আমি পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি।’ (প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর ২০১৪)
১৯৪৭ সালে কলকাতায় প্রকাশিত হয় বেগম-এর প্রথম সংখ্যা। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে কালের প্রেক্ষাপটে বাংলার নারীদের ভেতর ঘর থেকে বাইরের জগতে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যেই পত্রিকাটির উদ্বোধন। আর সেই যে সূচনা ঘটল, এর মধ্য দিয়েই মূলত যাত্রা শুরু হলো নারীদের না–বলা কথাগুলো প্রকাশের একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্মের।
পরে ১৯৫৪ সালে নূরজাহান বেগম উদ্যোগ নিয়ে নারীদের জন্য গঠন করেছিলেন ‘বেগম ক্লাব’। এই ক্লাব গঠন প্রসঙ্গে ‘নারীদের অপূর্ব জাগরণ’ নামের ওই একই লেখায় তিনি লিখেছেন, ‘বেগম-এর মাধ্যমে ১৯৫৪ সালে আমরা বেগম ক্লাব গঠন করি। সে ছিল এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমাদের অবস্থা তখন খুব একটা ভালো নয়। নারী লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সে সময় খুব কঠিন ছিল। সহজে কোনো লেখা পেতাম না।
এখন ইন্টারনেটের সহজ যোগাযোগব্যবস্থার যুগে সে কষ্টের কথা বলে বোঝানো যাবে না। এ সময় একজন মার্কিন নারী সাংবাদিক এলেন বেগম-এর অফিস দেখতে। তিনি আমাদের এ অসুবিধা শুনে একটা মহিলা ক্লাব গঠন করার পরামর্শ দিলেন। সেখানে মেয়েরা আসবেন, কথা বলবেন, তাঁরাই বেগম পত্রিকার জন্য লিখবেন। সেই থেকে বেগম ক্লাবের সৃষ্টি।
‘সেটিই ছিল বাংলাদেশে নারী লেখকদের প্রথম কোনো ক্লাব। শামসুন্নাহার মাহমুদকে প্রেসিডেন্ট করে ক্লাবটি গঠন করা হলো। উপদেষ্টা ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, ফাতেমা সাদিক ও নীলিমা ইব্রাহিম। এই ক্লাব আমাদের পত্রিকা প্রকাশের কাজটি অনেক সহজ করে দিল। ক্লাবটির কল্যাণে আমরা বহু নতুন নারী লেখকের সন্ধান পেয়েছি। নানা অসুবিধার কারণে ১৯৭০ সালে ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যায়।’
বস্তুত সংসার, পরিজন, ব্যক্তিগত স্বার্থের জীবন তাঁর ছিল না, বরং তাঁর জীবন ও স্মৃতিকথা সমৃদ্ধ হয়ে আছে নারী প্রগতির জন্য আত্মত্যাগে। নারীদের সবাইকে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন স্বনির্ভর ও সাহসী হতে। বেগম পত্রিকা প্রকাশের সাল ১৯৪৭ থেকে ২০২৩—৭০ বছরের বেশি সময় পর আমরা যদি আজ নারীদের লেখালেখি ও নারীর অগ্রগতির দিকে চোখ রাখি, দেখতে পাব, ‘অবগুণ্ঠন ভেঙে একদিন নারী নিজের পায়ে দাঁড়াবে’—এমন যে স্বপ্ন দেখেছিলেন নূরজাহান বেগম, তার অনেকটুকুই পূরণ হয়েছে।
নূরজাহান বেগমের আরেকটি বড় কৃতিত্ব হলো, ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি মুসলিম মেয়েদের উন্মুক্ত মঞ্চে নৃত্যনাট্যের আয়োজন করেছিলেন এবং সেখান থেকে পাওয়া অর্থ ব্যয় করা হয় কবি নজরুল ইসলামের চিকিৎসার জন্য। একদা তিনি যেমন বেগম ক্লাব গঠন করেছেন, তেমনি বেগম ক্লাবের লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন, যদিও ১৯৬৯ সালে তা স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৫২ সালে নূরজাহান বেগমের বিয়ে হয় ‘দাদাভাই’ হিসেবে খ্যাত ছড়াকার রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে। বিয়ের পরও তিনি নারীর অগ্রগতি, নারীর উন্নয়নে সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন, বাংলার নারীদের নিয়ে ভেবেছেন আমৃত্যু।
আজীবন কর্ম-অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বেগম রোকেয়া পদক, বাংলাদেশ মহিলা সাংবাদিক ফোরাম পদক, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পদক, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি পদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পদক, কাজী মাহবুবউল্লাহ ও বেগম জেবুন্নেসা ট্রাস্টের স্বর্ণপদক, রোটারি ক্লাব পদক ইত্যাদিতে ভূষিত হয়েছেন। বিরামহীন পথচলায় নিরন্তরভাবে লিখে ‘কলমসৈনিক’ হিসেবে হয়ে আছেন চিরস্মরণীয়।
বেগম পত্রিকা যে সব সময় তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সে কথা অসংখ্যবার বলেছেন নূরজাহান বেগম, ‘বেগম-এর জন্য কাজ করতে আমার খুব আনন্দ লাগত। আমি প্রথম দিকে দেখেছি কলকাতায় মেয়েদের কী অবস্থা। এবং ঢাকায় এসে মেয়েদের কী অবস্থা, সেটাও দেখেছি। সবাই লেখা দিতে আসে। বলেছে, লেখাটি একটু দেখে দিন।’
নূরজাহান আপার সঙ্গে আমার পরিচয় কাজের সূত্রে। আমি যখন নারীদের তথা নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করেছি, প্রথম থেকেই আমাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন নূরজাহান আপা। তবে শুধু সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হননি, নানা সময়ে দিয়েছেন নানা পরামর্শও। তিনি যখন তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার গল্পগুলো বলতেন, বিস্মিত হতাম এই ভেবে যে সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বাস্তবতায় সেই বিরুদ্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে কীভাবে তিনি নারীদের এগিয়ে নিয়েছিলেন! আসলে প্রগতিবাদী মানুষের পথচলায় বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগম অন্য অনেক ধ্রুবতারার মধ্যে অন্যতম এক দিশারি।
কিন্তু তিনি ছিলেন বরাবর প্রচারবিমুখ। মনে করতেন, তাঁর যা দায়িত্ব, তা তিনি বেগম-এর মাধ্যমে পালন করেছেন। সময়ই বিচার করবে তিনি কী করেছেন। এমনকি তিনি অনুষ্ঠানাদিতেও তেমন একটা আসতেন না। তবে অনুষ্ঠানাদিতে এসে মঞ্চ আলোকিত করার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছেন অনেকটা নীরবেই। তা হলো, নারীকে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে সাহায্য করা।
২০২৫ সালে পালিত হবে নূরজাহান বেগমের জন্মশতবর্ষ। আজ থেকে অনেককাল আগে আলোকবর্তিকারূপী নূরজাহান আপা আমাদের জন্য কী করেছেন, তা যেন আমরা সব সময় স্মরণে রাখি। তিনিসহ আরও অনেকের বিচিত্রমুখী তৎপরতার কারণেই যে নারীরা এত দূর আসতে পেরেছে, এ সত্য আমরা যেন ভুলে না যাই।