বাংলার গরমে বিলেতির রসনায়

গত কয়েকটা দিন গরমে সবার প্রাণ হয়ে গিয়েছিল ওষ্ঠাগত। উপনিবেশের সাহেবদেরও গরমে নিদারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল এ দেশে। তাঁদের বঙ্গীয় অভিজ্ঞতার সাহিত্য থেকে

ক্যাপ্টেন জর্জ ফ্রাংকলিন অ্যাটকিনসনের আঁকা ছবিতে ভৃত্য পরিবেষ্টিত ইংরেজ ভোজসভা, ওপরে টানা পাখা দৃশ্যমান, ১৮৬০

১৯১৪ সালের কথা। ব্রিটিশ নাগরিক আর্থার লেই গডেন চাকরিসূত্রে থাকছেন নারায়ণগঞ্জে। তখন সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পরপর দুই মেয়ে জন আর রুমারকে বিলেত থেকে নিজ কর্মস্থলে নিয়ে এলেন বাবা গডেন। বিলেত থেকে হাজার মাইল দূরের সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জনপদে তাঁরা যখন এসে পৌঁছালেন, তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। আবহাওয়া তখনো পীড়াদায়ক হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ক মাস যেতেই উপস্থিত হলো গ্রীষ্মকাল। তাঁরা শীতের দেশের মানুষ; আর সবকিছু সামলে নিলেও গরমটা সামলানো যে বড় কঠিন! গডেন–কন্যাদের ভাষায় গরমের দিনগুলো ছিল দমবন্ধ চুল্লির মতো।

পরিণত বয়সে দু বোন মিলে লিখেছিলেন শীতলক্ষ্যার পারে দেখা শৈশবের দিনগুলোর স্মৃতিকথা টু আন্ডার দ্য ইন্ডিয়ান সান। সেখানে বাংলার গরমের প্রসঙ্গ আসে অনেকটা জায়গাজুড়ে, ‘গরম সহ্য করা কাকে বলে, সেটা আমরা বুঝেছিলাম সে বছর। চারদিকে কেবল ধুলা আর শুষ্কতা। শরীরের ত্বক শুকিয়ে গিয়েছিল, চোখের পাতাও কেমন কাগজের মতো মনে হতো। বারান্দায়, সিঁড়িতে যেখানে রোদ পড়ত, সেখানে পাথর এত উত্তপ্ত হয়ে উঠত যে খালি পায়ে সেখানে হাঁটা যেত না।’ গরমের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা জীবনযাত্রার ধরন পাল্টে নিয়েছিলেন। তাঁদের দিন শুরু হতো খুব ভোরে, সঙ্গ বদলে নিয়েছিলেন খাদ্যাভ্যাসও। প্রাতরাশের আয়োজন আর ছোট থাকেনি। দিনের শুরুতে পুরো পরিবারের সঙ্গে সকালের নাশতা করাটা হয়ে ওঠে সবচেয়ে উপভোগ্য সময়।

শুধু গডেন পরিবার নয়, ভারতবর্ষের তাপপ্রবাহে পাল্টে গিয়েছিল সুদূর বিলেত থেকে এ দেশে আগত বহু ইংরেজের জীবন। মোগল শাসনের অবসানে ভারতবর্ষজুড়ে ইংরেজ শাসকেরা জাঁকিয়ে বসেন। ১৭৭২ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতাকে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী ঘোষণা করেন। অল্প পরিশ্রমে ভাগ্য বদলানোর আকাঙ্ক্ষায় বহু ইংরেজ তরুণ ভিড় জমান বাংলায়। শীতপ্রধান বিলেতের তরুণদের জন্য জলাজঙ্গলে ঘেরা বাংলায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল আবহাওয়ার বৈপরীত্য। বিরূপ আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনে তাঁরা বদলে নিয়েছিলেন খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে পোশাক–আশাক পর্যন্ত প্রায় সবকিছু। সে অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাঁদের কলমে, রংতুলিতে। বিলেতি রসনায় কেমন প্রভাব ফেলেছিল বাংলার গরম? কেমনভাবে বদলে গিয়েছিল খাবারের প্রকার, রন্ধনপদ্ধতি, পরিবেশনার ধরন? এ লেখায় সেসবেরই আদ্যোপান্ত।

খাবারের আলাপ: মেমসাহেবের আগে, পরে

ইংরেজ ভোজনবিলাসের ঔপনিবেশিক ধারাকে লেখক ও গবেষক শালিনী দেবী হোলকার দুটি পর্যায়ে ভাগ করেন—প্রাক্‌মেমসাহেব যুগ এবং মেমসাহেব–পরবর্তী যুগ। প্রাক্‌মেমসাহেব যুগের বিস্তৃতি মূলত এ দেশে ইংরেজ আগমনের প্রথম থেকে শুরু করে আঠারো শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত। প্রথম যুগে আগত ইংরেজদের অধিকাংশই ছিলেন অবিবাহিত, পেশায় ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, ব্যবসায়ী কিংবা ধর্মপ্রচারক। সে সময়ের ইংরেজ স্মৃতিকথায় পাওয়া তথ্যমতে, তাঁরা প্রায় সবাই স্থানীয় খাবার গ্রহণে সচেষ্ট ছিলেন, সে খাবার তাঁরা পছন্দও করতেন। সতেরো শতকের শেষ ভাগে কোম্পানির লোকদের জন্য আয়োজন করা এক ভোজসভার বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে মোগল খানার প্রভাব তখনো ছিল ব্যাপক, ‘ভোজসভায় সাধারণত বিভিন্ন ধরনের খাবার থাকত, পরিমাণেও তা ছিল অনেক। কাবাব ছিল প্রিয় একটি খাবার, খেতে একদমই গুলাশের মতো নয়। আরও ছিল কিশমিশ, বাদামে ভরপুর মাখনে সেদ্ধ করা দমপোক্ত মুরগি এবং আমের আচার।’ মোগল স্বাদের খাবার খেয়ে এডওয়ার্ড টেরি নামের এক তরুণ ধর্মযাজকের মন্তব্য ছিল, ‘এমন সুস্বাদু মাংসের পদ আমি কখনো খাইনি।’

খাবারগুলো এ অঞ্চলের হলেও ভোজসভায় এদের পরিবেশনের কেতা ছিল পুরোটাই বিলেতি। কোম্পানি কুঠির প্রধান যখন খাবারঘরে প্রবেশ করতেন, তখন ট্রাম্পেট বেজে উঠত, খাবার গ্রহণের সময় মৃদু শব্দে বেজে চলত বেহালা। পরিবেশনের তৈজসপত্র ছিল রুপার তৈরি। শীতকালে বাগানে ভোজসভা চললেও গ্রীষ্মকালে ঘরের ভেতরে টানা পাখার নিচে পরিচারকবেষ্টিত অবস্থায় ভোজ আয়োজনের বিকল্প ছিল না।

খাবার নিয়ে এ সময়কার ইংরেজদের তেমন কোনো অভিযোগ চোখে পড়ে না। এর একটা বিশেষ কারণও ছিল। তাঁদের অধিকাংশই রান্না জানতেন না, অপর দিকে রান্না জানা ইংরেজ নারী পাওয়া ছিল দুষ্কর। তাই স্বাদ তুলনা করে বিকল্প খোঁজার কোনো সুযোগ ছিল না। আঠারো শতকের শেষ ভাগ থেকে উনিশ শতকের শুরু অবধি খুব অল্পসংখ্যক ইংরেজ নারীই ভারতে এসেছিলেন। ক্যাপ্টেন টমাস উইলিয়ামসনের লেখা দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া ভেড–মেকাম বইয়ে দেওয়া তথ্যমতে, ১৮১০ সালে এ দেশে ইউরোপীয় মেমসাহেবের সংখ্যা ছিল মাত্র আড়াই শ। 

উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে মেমসাহেবের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাঁদের আগমনে খাবার পরিবেশনার পদ্ধতিতে তেমন পরিবর্তন না এলেও পরিবর্তন আসে রান্নার পদ্ধতিতে। মাত্র বিলেত ছেড়ে এ দেশে পা রাখা বেশির ভাগ ইংরেজ মেম রান্না জানতেন। তাঁদের ভেতরে বাড়ির খাবারের জন্য একধরনের ব্যাকুলতা আর নস্টালজিয়া কাজ করত। অবিকল সেই স্বাদ না পেয়ে তাঁদের অনেকে এ দেশের খাবার, রান্নাঘর, রান্নাপদ্ধতি আর ভৃত্যদের নিয়ে সমালোচনা শুরু করেন। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত দ্য কমপ্লিট ইন্ডিয়ান হাউসকিপার অ্যান্ড কুক বইয়ে লেখিকা ফ্লোরা অ্যানি স্টিল নিজ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, সঙ্গে দিয়েছেন বেশ কিছু পরামর্শ আর সহজ রেসিপি। তিনি লিখেছেন এ দেশে পৌঁছে একজন ইংরেজ মহিলা প্রথম যে বিষয়টা দেখে চমকে ওঠেন, তা হলো এখানকার রান্নাঘর। ইংরেজ রান্নাঘরের খুব সাধারণ উপাদান যে চামচ আর কাঁটা চামচ, সে দুটিই এখানে অনুপস্থিত। এর বদলে এখানে থাকে মাটিতে গর্ত করা একটি চুলা, নারকেলের খোসা আর দুটি লাঠি। এখানে রান্না করতে হলে অনেক ধৈর্যশীল হওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় ভাষা জানা থাকলে ভৃত্যদের দিয়ে কাজ করানোটা সহজ হয়।

বোঝা যায় যে সেকালের ইংরেজ চিত্রকর্মে ভোজসভায় নারী–পুরুষের যেমন শান্ত মুখচ্ছবি আঁকা হতো, তা অনেক ক্ষেত্রে ছিল অতিরঞ্জিত। বরং খাবার পরিবেশনে খিদমতগারের আধিক্য, রান্নাঘরে পাচকের উদাসীনতা ইত্যাদি নানা কারণে মেমসাহেবরা সাধারণত খেতে বসেও বিচলিত থাকতেন। উল্লেখিত বইতে লেখিকা গরমের সময় ইংরেজ খানাপিনা কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়েও খানিকটা আলোচনা করেছেন, সঙ্গে আছে বরফসহ নানা রকম ঠান্ডা খাবারের রেসিপি।

গরমকালের খানাদানা

নিদ্রাহীন ঘামে ভেজা রাতের শেষে, ভোরের শীতল হাওয়ায়, বাংলায় ব্রিটিশদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল সকালের নাশতা। মেমসাহেবেরা এই সময়টা একান্ত পারিবারিক আবহে রাখতে পছন্দ করতেন, যে কারণে খেদমতগারের উপস্থিতি যথাসাধ্য কমিয়ে রাখা হতো। খেদমতগারেরা সাধারণত চা পরিবেশন করত। বিলেতি খাবার রুটি, মাখনের পাশাপাশি টেবিলে এ সময়ে দেশি খাবারের উপস্থিতিও লক্ষ করা যায়। উইলিয়াম টেইলরের আঁকা এক ছবিতে দেখা যায় মাছ ভাজা, সঙ্গে ভাত নিয়ে প্রাতরাশে বসেছেন এক ইংরেজ দম্পতি।

জন ও রুমার গডেনের স্মৃতিকথায় এসেছে, ‘বাগানে বা ডাইনিং রুমে বিরাট এক গোলটেবিল ঘিরে আমরা সবাই বসতাম। প্রতিদিন পরিষ্কার টেবিল ক্লথ থাকত—থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, আমাদের নিজস্ব ধোপা ছিল। টেবিলের মাঝে তাজা ফুল থাকত। গোবিন্দকে দিয়ে মা সে ফুল আনিয়ে নিতেন। লন্ডনের বিস্বাদ ডিম আর ভয়াবহ পরিজের তুলনায় এখানের খাবার ছিল অনেক সুস্বাদু। নারায়ণগঞ্জে আমাদের সকালের নাশতা ছিল খিচুড়ি বা ভাত-ডাল ও ডিম পোচ।’ সকালের নাশতার সঙ্গে দুপুর ও রাতের খাবারের সময়ও এগিয়ে আসত। তবে এসব খাবারে প্রাধান্য ছিল মাছ এবং মাংসের। পূর্ব বাংলায় মাংসের উৎস হিসেবে সবচেয়ে সহজলভ্য ছিল মুরগি। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর কোই হ্যায়? পূর্ববঙ্গে ইংরেজ সিভিলিয়ান বইয়ে ১৮৭৬ সালে পাবনা থেকে লেখা সিভিলিয়ান হারম্যান মাইকেল কিশ্চের একটি চিঠি সংকলন করেছেন। ওই চিঠি থেকে, ‘পাবনায় একটি অসুবিধা হলো গরুর গোস্ত পাওয়া যায় না। মুরগি আর খাসিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শেষোক্তটিও পাওয়া যায় সপ্তাহে এক দিন। ভারতে মুরগি খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়। এই একটি জিনিসই সবখানে পাওয়া যায়। সাধারণ একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে দিনে ৫ থেকে ১০টি মুরগি লাগে।’ মুরগি দিয়ে নানান পদের রান্নার কথা হারম্যান উল্লেখ করেছেন। তবে উনিশ শতকে মসলাদার রেসিপি থেকে সরে এসে দেশীয় পাচকদের হেঁশেলে তৈরি হয়েছিল ‘ডাকবাংলো চিকেন’–এর মতন অল্প মসলার সহজ কিছু রেসিপি।

গরমে টিকে থাকার জন্য ইংরেজরা দিন–রাতের সব আহারেই যত দূর সম্ভব মসলাদার গুরুপাক খাবার পরিহার করতেন। ১৮৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহের সেশন জজ হিসেবে নিযুক্তি পান উইলিয়াম টেইলর। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে যখন টেইলর ময়মনসিংহে পৌঁছান, তখন এপ্রিল মাস শুরু হয়েছে। গরম আর ভ্যাপসা আবহাওয়ার দিনগুলোতে তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন লাউয়ের, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে কদু। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে পুষ্টিকর এই সবজি যে শুধু পেটের জন্য ভালো তা–ই নয়, এর শুকনা খোল পানি রাখার কাজেও ব্যবহার করা হয়। লাউয়ের গুণমুগ্ধ টেইলর একে ইংরেজ কায়দায় খাওয়ার উদ্যোগ নেন।

ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা আব-দারের জলরং চিত্রকর্ম, সময়কাল অজানা

টেইলর ময়মনসিংহে অবস্থানকালে আরেকটি খাবারের বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন, তা হলো আম। বাংলার একটি প্রধান ফল হলো এই আম, কিন্তু এর ফলন বৃদ্ধিতে ইংরেজ সরকারকে তাঁর যথেষ্ট যত্নবান মনে হয়নি। ময়মনসিংহের আম খেয়ে অবশ্য টেইলর তৃপ্তি পাননি, কারণ আম কাটলেই বেরিয়ে আসছিল অসংখ্য পোকা। গ্রামবাসীর মতে, এটা ছিল কোনো ফকিরের অভিশাপের ফল। বাংলার আম নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন প্রায় সব ইংরেজ। দুই বিখ্যাত আম ল্যাংড়া আর ফজলি আবিষ্কারের কৃতিত্বও দেওয়া হয় দুই ইংরেজ কর্তাব্যক্তি—যথাক্রমে পাটনার ডিভিশনাল কমিশনার কর্কবার্ন এবং মালদহের কালেক্টর র‍্যাভেনশকে। গ্রীষ্মকালীন ফলের মধ্যে আম নিয়ে যত উৎসাহ, তার সিকি ভাগও অবশ্য অন্য ফলের ভাগ্যে জোটেনি। তবে গডেন–কন্যাদের স্মৃতিকথায় ফল প্রসঙ্গ সামান্য এসেছে,‘সবচেয়ে সেরা ছিল এখানকার ফল। পেঁপের রং ছিল সোনালি, ভেতরে কালো রঙের বিচি। ওই কালো বিচিতেই নাকি সব ভিটামিন জমা থাকত। অবশ্য আমরা কখনো বিচি খেতাম না। লিচু ও আম পাকত গরমের সময় কিন্তু সে সময় সাধারণত আমরা পাহাড়ে থাকতাম। বাবা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য ঝুড়িভর্তি আম-লিচু পাঠিয়ে দিত।’ 

বরফ ছাড়া গরমের খাবারের কোনো আলাপই সম্পূর্ণ হয় না। এবারে সেই আলাপ। 

যখন বরফ এল

বরফ সহজলভ্য হওয়ার আগে এ দেশে আগত ইংরেজরা কফি, চাতেই অভ্যস্ত ছিল। গরম জলবায়ুর জন্য এমন উষ্ণ পানীয় বেশি উপযুক্ত মনে করা হতো। খাওয়ার উপযুক্ত বরফেরও অভাব ছিল। পশ্চিম বাংলার হুগলিতে অগভীর গর্তে পানি জমিয়ে বরফ তৈরি করা হতো। তবে তা ছিল অপরিষ্কার, খাওয়ার অযোগ্য। ১৮৩৩ সালের মে মাসে ১৮০ টন হ্রদে জমা খাওয়ার উপযোগী প্রাকৃতিক বরফ নিয়ে বোস্টন থেকে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করে টাসক্যানি নামের জাহাজ। চার মাস পর যখন কলকাতার বন্দরে জাহাজটি নোঙর করে, তখন অক্ষত ছিল মাত্র ১০০ টন বরফ। তবে তাতে কলকাতাবাসী ইংরেজ আর বাঙালি বাবুদের আনন্দে কোনো কমতি ছিল না। জাহাজ পৌঁছানোর তিন দিনের ভেতরে চাঁদা তুলে তাঁরা বরফের গুদাম বানানোর উদ্যোগ নেন।

কলকাতানিবাসী এক ইংরেজের মতে, ‘বিলেত থেকে আত্মীয়-পরিজনের চিঠির জন্যও এখন আর অত উদ্‌গ্রীব থাকি না যতটা থাকি আমেরিকা থেকে বরফ আনা জাহাজের জন্য!’ এরপর প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত কলকাতা, বোম্বে আর মাদ্রাজ শহরের অধিবাসীরা ওই আমদানি করা বরফের ওপর নির্ভরশীল ছিল। নানা রকম পানীয়, আইসক্রিম, মদ তৈরি ও পরিবেশনায় এবং খাদ্য সংরক্ষণে বরফের ব্যবহার বাড়তেই থাকে। পানীয়র ধরন পাল্টে যায়, বরফ মেশানো ফলের রস, আইসড টি, জিন টনিকের মতো অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ঠান্ডা পানীয়র প্রয়োজনে ইংরেজ পরিবারে পরিচারকের দীর্ঘ তালিকায় যোগ হয়েছিল আরও একটি নাম—আব-দার, যার একমাত্র কাজ ছিল খাবার ও পানীয় ঠান্ডা রাখা। আব-দারেরা লবণের সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে পানি বরফের মতো ঠান্ডা রাখতেন। বড় ভোজসভার সময় পানি বরফ-শীতল করার জন্য এদের রাতভর কাজ করতে হতো। কারণ, ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসনের মতে, ‘একটি সফল ভোজ আয়োজনে আব-দার বা জল-শীতলকারীর ভূমিকা রাঁধুনির চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, তাঁর দক্ষতা ছাড়া, টেবিলের সমস্ত সুস্বাদু খাবারের কোনো মূল্য থাকে না।’ অন্যান্য খেদমতগারের থেকে দক্ষ আব-দারের পারিশ্রমিকও তাই বেশি হতো। উনিশ শতকের শেষ ভাগে সহজে প্রচুর পরিমাণ বরফ তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়। ফলে বরফ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়; ভারতবর্ষের সব প্রধান শহরে চালু হয় বরফকল। ঢাকার নবাবদের কুমারটুলীর বরফকলে ১৮৯২ সাল থেকে নিয়মিত বরফ উৎপাদন করা হতো। তবে নারায়ণগঞ্জের ডেভিড অ্যান্ড কোম্পানির বরফকলে তৈরি বরফের চাহিদা ছিল বেশি। বরফের সহজলভ্যতায় একসময় আব-দার পেশার বিলুপ্তি ঘটে।

পরিশেষে বলা যায়, ঔপনিবেশিক ভারতে ইংরেজরা একক কোনো গোষ্ঠী ছিল না। তবে সামাজিক অবস্থান, আবাস ও ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর ভিত্তি করে তাদের খাদ্যাভ্যাসে এসেছিল ভিন্নতা। গ্রীষ্মের খরতাপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সেই চেষ্টা জন্ম দিয়েছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রন্ধনপদ্ধতির, যেখানে এ দেশের নানা উপকরণের মিশ্রণে তাঁরা খুঁজে ফিরেছিল ফেলে আসা মাতৃভূমিকে, মায়ের হাতের হারানো রান্নার স্বাদকে।