যুদ্ধের পৃথিবীতে গান

বগা তালেবের কণ্ঠে কোক স্টুডিও বাংলার ‘কূল নাই’ গানটি বেশ আলোচিত হয়েছিল

দিনান্তে আমাদের হিসাব করতে হয়, কেমন গেল দিনটা। বছরের শেষান্তে তেমনই ভাবনা আসে, কেমন কাটল বছর? খুব বেশি দিন হয়নি অতিমারি পেরিয়েছি। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া তো চলছেই। খাদ্যসংকট, পৃথিবীর অর্থনৈতিক বেশামাল অবস্থা, সঙ্গে গোটাকতক যুদ্ধ। নতুন করে শুরু হলো ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধ; এবং গণহত্যাও, যা আজও চলছে। এসবের ভেতর বসে সাধারণ মানুষ বা শিল্পী বড় একা। কবি শহীদ কাদরীর একটা চমৎকার কথা আছে, ‘এত হানাহানি এত বিপর্যয়ের মাঝে মানুষের শেষ আশ্রয় কবির (শিল্পী) হৃদয়।’ এ কথার নানা বিশ্লেষণ হতে পারে। কিন্তু একটা কথা তো স্বীকার করে নিতেই হবে যে এই ‘শিল্পসাহিত্য–সংগীত’ বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ আসলে যাবে কোথায়? ব্যক্তির অন্তর্দহনটুকু কে জুড়াবে? ‘গান দিয়ে কি বোমাকে রুখে দেওয়া যায়?’—পিট সিগার বলেছিলেন। তাই এই পৃথিবীতে গান আর বোমা সমান্তরালে চলছে। মানুষ আশাবাদ রাখছে তার নান্দীপাঠের ওপর। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সংগীতচর্চায় কী কী জিনিস যুক্ত হলো, সেসব ভেবে খুব আলাদা করার মতো কিছু পাইনি। 

এ বছর গানের জগতে বাংলাদেশে—এবং কলকাতাতেও—সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানের বিকৃতি। বলা যায় ভারত-বাংলাদেশ তো বটেই বাংলাভাষীদের বাইরেও গানটি নিয়ে হয়েছে বিপুল সমালোচনা। 

সংগীতে আরেকটি একটি বিষয় নজরে পড়ার মতো, সেটি হলো ওপেন এয়ার কনসার্টের সংখ্যা বেড়েছে। হয়তো রেকর্ডসংখ্যক নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ের বিচারে তা উল্লেখ করার মতোই। জয় বাংলা কনসার্ট, চলো বাংলাদেশ, কোক স্টুডিও বাংলা লাইভের মতো মেগা কনসার্টে তারুণ্যের বিপুল উপস্থিতি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আশাবাদী করেছে। একটা বিষয় বলা দরকার, ইনডিপেনডেন্ট ধারার শিল্পীরা বরাবরের মতো করপোরেট স্পনসরশিপের বাইরে গিয়েও নিজেরা সলো শো আয়োজন করে তাঁদের কাজের গতিধারা বজায় রেখেছেন। করোনায় মানুষের যে ঘরবন্দী থাকার পরিস্থিতি ছিল, তার থেকে উত্তরণের যে মানসিকতা, সেখানে ব্যান্ডগুলোকেই হয়তো সবচেয়ে এগিয়ে রাখতে হবে। লাকি আলী, অঞ্জন দত্ত, অনুব জৈন, চন্দ্রবিন্দু, অনুপম রায়, ফসিলসের মতো ভারতীর শিল্পী ও ব্যান্ডকে ঢাকায় এসে কনসার্ট মাতাতে দেখা গেছে এ বছর, আমাদের শ্রোতাদের কাছে যা ছিল অসাধারণ অভিজ্ঞতা। তবে দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পরিমাণ আরও বাড়ানো দরকার এবং ক্রিকেটের মতো গানের ক্ষেত্রেও এই বিনিময় আরও বাড়লে দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদান–প্রদানের ক্ষেত্রে তা সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয়। ব্যক্তিগতভাবে ‘মেঘদল’ ব্যান্ডের সঙ্গে দুবার ভারত সফর করে সেখানকার শ্রোতাদের সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি, দুই বাংলার রাজনৈতিক ফারাক থাকতে পারে, তবে বাংলা গানের শ্রোতা আসলে এক। কলকাতার বাংলাভাষীরা বাংলাদেশের শিল্পীদের গানের জন্য এখন উন্মুখ। 

আর নতুন বাংলা গানের কথা যদি বলি, সেই খরা এবারও লক্ষ করা গেছে। ব্যান্ডগুলোর বাইরে মৌলিক গানের চর্চা প্রায় দেখাই যায় না। 

বর্তমান সময়ের শিল্পীদের এক সংকট গানের সঙ্গে ভিজ্যুয়াল দিয়ে গান প্রকাশের জটিলতা। যদিও স্পটিফাইয়ের মতো বড় মাধ্যমগুলো সেই শ্রুতিনির্ভর গানচর্চাকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে এবং সফলও হচ্ছে।

বাংলাদেশে গত দুই বছরে কোক স্টুডিও বাংলার মতো আন্তর্জাতিক গানের প্ল্যাটফর্ম সগৌরবে তাদের দুটি সিজন সম্পন্ন করেছে। সেসব গান একদিকে বাংলা আবহমান কালজয়ী সুর ও কথাকে যেমন তুলে ধরেছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একদম অচেনা প্রতিভাদের হাজির করার মতো দুরূহ কাজ। মানুষ জেনেছে জোহরা বাউল, আলেয়া বেগম, অনিমেষ রায়, হাশিম মাহমুদের মতো গুরুত্বপূর্ণ অথচ আড়ালে রয়ে যাওয়া শিল্পীদের। এর সমান্তরালে এসব গান নিয়ে চলেছে নানা আলোচনা–সমালোচনাও, যাকে আমরা শ্রোতাদের স্বতঃস্ফূর্ততার প্রকাশ হিসেবে দেখতে পারি।

সিনেমার গান নিয়ে মানুষের বিপুল আগ্রহের কথা আমরা জানি। বর্তমান ওটিটি মাধ্যমে নির্মিত ওয়েবফিল্ম বা সিরিজে সফলভাবে গানের প্রয়োগ হতে দেখা যাচ্ছে। সেখানকার গান রীতিমতো ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দুনিয়ায়। সিনেমার গানের জনপ্রিয়তার যে সংস্কৃতি, হাওয়া চলচ্চিত্রে হাশিম মাহমুদের ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি সেই ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। যার ধারাবাহিকতায় ‘ট্যাকা পাখি’, ‘তই তই’–এর মতো গানগুলো ফিরেছে মানুষের মুখে মুখে। 

চলতি বছর ইনডিপেনডেন্ট শিল্পীদের গান প্রসঙ্গে বলতে গেলে মধ্যে ‘হাতিরপুল সেশন’–এর নাম বলতেই হবে। যারা এর মধ্যেই একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে একগুচ্ছ শিল্পীর গানকে মানুষ সামনে হাজির করেছে; এবং তা করেছে বেশ সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে। টাইনি ডেস্ক, মাহগনি, সোফারের মতো বিদেশি আন্তর্জাতিক গানের প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আমরা একইভাবে দেখতে পাই, ইনডিপেনডেন্ট শিল্পীদের গানকে কেবল ইউটিউব চ্যানেলের মধ্য দিয়েই শ্রোতা-দর্শকদের সামনে হাজির করা হচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো অনেক আগেই আমাদের মেইনস্ট্রিম মাধ্যমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। কোনো নির্দিষ্ট লেবেল বা কোম্পানির বাইরে গিয়ে নতুন বাংলা গানের একটা স্বাধীন ধারা আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি। এর সঙ্গে শিল্পীর কপিরাইট ইস্যুটি শ্রোতা বা সরকার যদি আমলে নেয়, তবে সত্যিই একটা পজিটিভ পরিবর্তন আসতে পারে বাংলাদেশের অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে। এই কপিরাইট ইস্যুর সঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, সেটি হলো এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সারা দুনিয়া এই এআই নিয়ে বিচলিত। এআই বদলে দিতে পারে সামনের দিনের পৃথিবীকে। উন্নত দেশগুলোয় তাদের শক্ত কপিরাইট আইনের কারণে বলা যায়, এআই ইস্যুতে তারা সোচ্চার হয়ে উঠতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের কী হবে? যেখানে চাইলে যেকোনো শিল্পীর কণ্ঠে যেকোনো গান গাইয়ে নেওয়া যাবে! আমাদের মতো দেশগুলোয় এসব নিত্যনতুন প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার অনেক বিপদ ডেকে আনতে পারে সামনের বছরগুলোয়। এই কঠিন সময়কে কীভাবে মোকাবিলা করবেন আগামী দিনের শিল্পীরা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

শিবু কুমার শীল: ‘মেঘদল’ ব্যান্ডের ভোকাল