স্থাপত্যের মাতৃভাষা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

কাজী খালিদ আশরাফ

স্থাপত্যের একটা ভাষা আছে বলে অনেক স্থাপত্যতাত্ত্বিকই দাবি করেন, যেমন করতেন আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম পথিকৃৎ মিস ভ্যানডার রোয়া। যিনি মনে করতেন, স্থাপত্যই একটা ভাষা এবং এর একটা ব্যাকরণও আছে। কী সেই ব্যাকরণ, তা নিয়েও পশ্চিমে, আমাদের দেশে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু মাতৃভাষা? যদি স্থাপত্যের মাতৃভাষা থাকে, তার ব্যাকরণের পাশাপাশি অর্থ, রূপ, প্রকৃতি ও প্রকাশটি কী হতে পারে, কেমন হতে পারে, এসব প্রশ্নও তাহলে উঠবে। স্থাপত্যতাত্ত্বিক, স্থপতি ও নগরবিদ কাজী খালিদ আশরাফ তাঁর দ্য মাদারটাং অব আর্কিটেকচার বইয়ে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন, এদের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য অনেক প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন এবং জল, জমি, কাদামাটি, জলময়তা ও নগরত্বের সদাজঙ্গম পটভূমি ফেলে এগুলো অর্থপূর্ণ করতে গিয়ে একটা স্থাপত্যদর্শনের সন্ধানও আমাদের দিয়েছেন, যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি লেখালেখি করছেন। এই বইয়ের আটটি অধ্যায়ে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে, বলা যায়, সেগুলোতে ‘মাতৃভাষা’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়ে রোপিত চিন্তাগুলোই নানাভাবে পত্রপল্লব মেলেছে, যদিও ভিন্ন অনেক অবলোকন এবং আখ্যান সেগুলোতে সংযোজিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘স্থানায়ন’ বা প্লেসিং,  যাতে নান্দনিকতা আর উপযোগিতার দ্বিত্বতা থেকে বেরিয়ে এসে স্থাপত্যের উপস্থিতির যথার্থতা কীভাবে নির্ণিত হতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। ‘জলময়তা’ ও ‘নগরত্ব’ নিয়ে লেখা দুটি অধ্যায়েও জল ও নগর নিয়ে নতুন চিন্তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জোর দিয়েছেন খালিদ আশরাফ। জলকে ডাঙা বিবেচনা করলে কেমন হয়, সে প্রশ্নও তুলেছেন; অর্থাৎ জল তো স্থানিক ও সামাজিক সংগঠনের শক্তিও হতে পারে, যা এই বঙ্গীয় বদ্বীপে অনেক আগে থেকেই হয়ে এসেছে, যদিও ‘আধুনিক’ শহরগুলো তা মুছে ফেলেছে। এই চিন্তাগুলো খালিদ আশরাফের মাতৃভাষা ডিসকোর্সের জন্য, মাতৃভাষার নানা অনুষঙ্গ, অর্থময়তা ও রূপতত্ত্বের জন্য জরুরি।

সর্বাগ্রে তাই মাতৃভাষা বলতে খালিদ ঠিক কী বোঝাচ্ছেন, তার কিছুটা হদিস নেওয়া যাক। এ চিন্তার সূত্রপাত করেছিলেন স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন, যিনি আক্ষেপ করে বলতেন, আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাপদ্ধতি বাংলা ভাষাকে এক মানহীন ও দুর্বল ভাষায় পরিণত করেছে এবং এ জন্য আমাদের স্থাপত্যভাষাতেও আছে শৈথিল্য। আমাদের স্থপতিরা যখন একাডেমিক পড়াশোনা করেন, বাংলা ভাষার উপস্থিতি তাতে প্রায় থাকেই না। তাহলে দুর্বল মাতৃভাষা কীভাবে স্থাপত্যভাষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে? খালিদও প্রশ্নটি তোলেননি, এর কোনো উত্তর দেওয়ার কারণও তাঁর নেই। কিন্তু দ্য মাদারটাং অব আর্কিটেকচার বইটিজুড়ে এই প্রশ্ন অনুরণিত হয়। মাতৃভাষা সংস্কৃতির প্রধান বাহন, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয়তা, জল-ডাঙা-হাওয়া, ভূ-প্রকৃতি এবং মানুষের নানা কৃত্য, একই সঙ্গে সমাজের কিছু নীতি ও মূল্যবোধ এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের দৈনন্দিনতা, শরীরের সঙ্গে দুনিয়াদারির আন্তসম্পর্ক (মেরলু-পন্টির বর্ণনায় যাকে ‘কায়াজম’ বলা যায়)। স্থাপত্য যদি সত্যিই ভাষা হয়—যদিও এ নিয়ে প্রশ্নও আছে—তাহলে সেই ভাষার স্থানীয়তার (মাতৃভাষার যা প্রধান বৈশিষ্ট্য) পূর্ণতা-অপূর্ণতা (বাংলাভাষীদের এক–চতুর্থাংশ এখনো এর লিখিত ও পঠিত রূপের অংশীদার হতে পারেনি), এসবও তো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। কোনো স্থপতি যদি জল-ডাঙা-হাওয়ার, স্থান বা পরিসরের এবং প্রকৃতির উপস্থিতির মিথস্ক্রিয়া বুঝতে অপারগ হন, যদি তাঁর স্থাপত্য পরিবেশের সঙ্গে এক নিপুণ ভারসাম্য রচনা করতে না পারে, যার মধ্য দিয়ে স্থানের অন্তর্নিহিত শক্তি, চৈনিক চিন্তায় যা ‘ফেং শুই’, তাহলে সেই স্থাপত্য কোন ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করবে? যদি স্থাপত্যের আধুনিকতা শুধু পশ্চিমা নকশায়, নির্মাণ উপাদান অথবা প্রকাশবৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়, তাহলে এই আধুনিকতা কাদের? আর স্থাপত্য যদি সামাজিক বৈষম্য ধরে রাখে, শিশু ও প্রকৃতি-অবান্ধব হয়, তাহলে তা কোন সংস্কৃতির প্রতিফলন করে?

রবিউল হুসাইন থেকে ভিন্নপথে মাতৃভাষাকে বিবেচনা করেছেন খালিদ আশরাফ। তিনি দেখিয়েছেন, যে বিষয়গুলো ভাষাকে বৈশিষ্ট্য দেয়, সেগুলো স্থাপত্যেকেও দেয়। যেমন এর লোকজ উৎপত্তি, প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক, এর প্রাত্যহিকতা, গ্রহণযোগ্যতা, অর্থময়তা আর অনুরণন তোলার ক্ষমতা এবং অন্য ভাষা থেকে এর নিরন্তর গ্রহণ। ভূমিকায় খালিদ আশরাফ লিখেছেন, তিনি লেখালেখির শুরুটা করেছেন স্থানের ধারণা এবং স্থানগত যথার্থতা থেকে, যা স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সান্নিধ্যে এসে সংহত হয়। মাজহারুল ইসলামের হাত ধরে বাংলাদেশে আধুনিকতার চর্চা শুরু হয়, যাকে কনটেক্সচুয়াল বা পরিপ্রেক্ষিত-নির্দিষ্ট আধুনিকতা বলে বর্ণনা করা যায়। এই বইয়ে তিনি এই মহান স্থপতির বাস্তুকলা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন, তিনি যদিও শুরুতে পশ্চিমা আধুনিকতার ভাষাকে মূল্য দিয়েছেন, দ্রুতই নিজের ভাষা খুঁজে পেয়ে তাকে সংহত করেছেন, যা একই সঙ্গে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক। খালিদ আশরাফ স্থাপত্যে স্থাবর-জঙ্গমের দোলাচল, শিড়কসংলগ্নতা ও উড়াল দেওয়ার বাসনার প্রকাশকে গুরুত্ব দিয়েছেন, ভাষার মতোই শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যেও যা দেখা যায়।

খালিদ আশরাফ গাঙ্গেয় বদ্বীপের ভূমিগঠন, বন্যা, নদীভাঙন, চরের উদয় হওয়া ও হারিয়ে যাওয়া—এসব বৈশিষ্ট্যের প্রভাব এবং এর প্রভাবে গড়ে ওঠা সমস্যাসংকুল একসময়ের নগরায়ণ, যাকে তিনি বলেছেন, ‘জলজ নগরায়ণ’ তার আত্মপ্রকাশ—এ সবকিছুকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, আমাদের অতীতে যে রকম ছিল, এক জলনির্ভর জীবনযাত্রা, আমাদের ভবিষ্যৎও হবে সে রকম তরল; অর্থাৎ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতাকে স্থপতিরা যেন স্মৃতিকাতরতার সঙ্গে না দেখেন, যেন ভবিষ্যতের প্রয়োজনে একে নতুন নির্মাণ ও বিন্যাসের সম্ভাবনা হিসেবে গণ্য করেন, বইটিতে সেই চিন্তাই বড় হয়।

দ্য মাদারটাং অব আর্কিটেকচার নিঃসন্দেহে আমাদের স্থাপত্য লেখালেখিতে এক অনন্য সংযোজন। বইটিতে তত্ত্ব আছে, দর্শনের ঘনত্ব আছে, ইতিহাস-সমাজতত্ত্ব-সংস্কৃতির চলাচল আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছে খালিদ আশরাফের চিন্তার নিজস্বতা এবং তাঁর স্থাপত্যভাবনার মৌলিকতা আর তাঁর দেখার স্পষ্টতার সঙ্গে দেখানোর স্বাচ্ছন্দ্য। এ বইয়ে একই সঙ্গে রয়েছে আমাদের বাস্তুকলার নিজস্ব এক দর্শনে স্থিত হওয়ার এবং তাকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। স্থাপত্যের মাতৃভাষা নিয়ে ভাবনাচিন্তার আড়ালে স্থাপত্য কীভাবে স্থানের বহুমাত্রিকতা ও দর্শনের কাছে, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির কাছে বিশ্বস্ত হতে পারে, তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা খালিদ আশরাফ করেছেন। বইটি নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের কাছে আমাদের বাস্তুকলার শক্তির জায়গাটা তুলে ধরবে।