আহা! কোনো দিন সাধ মেটেনি
শীতের কঠিন রাতে, বাতাস উঠলে বাড়িটায় কেমন যেন মটমট শব্দ হতো। চারপাশে অবারিত এবড়োখেবড়ো ডোবা, জলাভূমি। শেয়াল ডাকলে আমার মনে পড়ে যেত সিলেটের লাভলী রোডে প্রথম গিয়ে ওঠা সেই একাকী অসহায় অবস্থার মধ্যে বাস করা বাড়িটার কথা। আশরাফের (স্বামী আশরাফ আহমদ) ওষুধ কোম্পানির চাকরি। সে এরিয়া ম্যানেজার হলেও ফাঁকি তার রক্তে নেই। তাই অফিসের কাজে ও যখন ট্যুরে যেত, তখন আমি বমিতে চারপাশ ভাসিয়ে দিতাম। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতো, কিন্তু যখনই তলপেটে হাত রাখতাম, যেদিন থেকে অর্চি ভ্রূণ হয়ে আমার গর্ভে এসেছে, অপার্থিব এক সুখের অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে দিত। দেয়ালের ওপাশে থাকা বাড়িওয়ালি খালাম্মার পরিবার শুরুতে আমাকে বেশ স্নেহই করত। কিন্তু সারা রাত ভূতের মতো একা ঘরে বসে থাকলে কে কাকে সঙ্গ দেবে? মাঝেমধ্যে শাশুড়ি এসে প্রচণ্ড মায়ায় জড়িয়ে থেকে যেতেন। সে আর কয় দিন!
অমন অবস্থায় আশরাফ ফিরে এলে আছড়ে পড়তাম তার ওপর। আমাদের এমন ওপেন রোমান্টিক ব্যবহার ধীরে ধীরে রক্ষণশীল পরিবারটির নাপছন্দ হতে শুরু করল। কিন্তু তখন পর্যন্ত বাইরে তারা ভালো ব্যবহার করত। কিন্তু প্রেগন্যান্ট অবস্থার তিন মাস আমার ভয়াবহ কাটতে থাকল। সিলেটে গৃহকর্মী তখনো পাওয়া মুশকিল ছিল।
বিয়ের আগে থেকেই আমার অভ্যাস ছিল, ক্যাসেটের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে গানের অনুভব বুঝে একটার পর একটা গান সাজিয়ে আনা। যেমন মেলোডি গান একপাশে। কোন শিল্পীর পরে কোন শিল্পীর গান রাখলে একটা ক্যাসেট বাজলে দীর্ঘ সময় একরকম অনুভবে বাস করা যাবে, এসব ছিল আমার মনদর্পণে। ফলে ময়মনসিংহের গাঙিনার পাড়ের মকবুল রেডিও স্টুডিও, ঢাকার গানের ডালি, সিলেটের দোকানের নাম ভুলে গেছি—বসে থাকতাম ধৈর্য ধরে, ঘরের সব কাজ গুছিয়ে গিয়ে। সব দোকানদার বলত, ‘আপনার মতো এমন কাস্টমার আর পাইনি।’ আমার কাছে ক্যাসেটগুলো ছিল নারীদের গচ্ছিত গয়নার চেয়ে বেশি মূল্যবান। খুব সুন্দর করে একটার পর একটা সাজিয়ে রাখতাম। আর যেখানে যেসব মেলোডি গান পেতাম, লিস্ট তৈরি করতাম। গান বাজত দিনভর, আর আমি আমার সারা দিন-রাতের কাজগুলো সম্পন্ন করতাম। কখনো একটা গানই হয়তো পরপর নয়বার ক্যাসেটের একপাশে থাকত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ‘এই রাত তোমার আমার’!
আহা! কোনো দিন সাধ মেটেনি। একদিন বাড়িতে চৌদ্দ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশন এল। আমার সে কী রোমাঞ্চ! মনে হলো, এখন থেকে সন্ধ্যাটা আর আমার একাকী কাটবে না! এর মধ্যে লক্ষ করতে থাকি, আমার ক্যাসেটগুলো চুরি যাচ্ছে। আমি হন্যে হয়ে খুঁজে দারুণ মনখারাপের মধ্যে যখন ডুবে যাচ্ছি; শুনতে পাই, পাশের খালাম্মার ঘরে আমার করা গানের সিরিয়ালের একটা ক্যাসেট বাজছে। আমি ইমোশনাল ফুল ছিলাম বলে কোনো কিছু না বুঝে খালাম্মার ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে সটান রেকর্ডার থেকে ক্যাসেট বের করে দেখি, ক্যাসেটের ওপরের সব লেখা মুছে কাগজগুলো খুঁটে খুঁটে উঠিয়ে ফেলেছে সে। আমি বললাম, তুমি আমাকে বলে কেন আমার ক্যাসেট আনোনি? তাহলে আমি এত হয়রান হয়ে খুঁজতাম না। কেন ক্যাসেটের লেখা মুছে নষ্ট করেছ? আমাকে হতবাক করে দিয়ে সে বলে, ‘এ আমার ক্যাসেট। আমি কেন আপনার ক্যাসেট চুরি করতে যাব?’
চুরি! এ তো আমার মাথায় আসেনি! ভেবেছিলাম বলবে, নিয়ে এসেছি, শুনে ফেরত দিয়ে দেব। ফলে ব্যাপারটা যা হওয়ার, বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে গেল। পুরো পরিবার গিয়ে আমার বিপক্ষে দাঁড়াল। একদিকে আমি কিচ্ছু খেতে পারছি না। কিচ্ছু না, ছুটা গৃহকর্মী একজন পেয়েছিলাম, সে কিছু কমলা এনে দিয়েছিল, আমি তখন কেবল কমলার ওপর বেঁচে আছি। অন্যদিকে পাশের ঘর থেকে ওদের চিৎকার শুনতাম, মমিনসিংগা আবাইদ্যা একটা বিয়া কইরা আনছে! এরপর আরও সব গালিগালাজ। তারা বাড়িওয়ালি, দুই পয়সার ভাড়াটে হয়ে আমি কীভাবে তাদের ছেলেকে চোর বলি? কথা বাড়তে বাড়তে যখন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, আমার চুপ থাকার সুযোগ নিয়ে তারা যখন ‘মমিনসিংগা মাগি’ বলে পর্যন্ত গালি দিতে থাকল, পুরোপুরি যোগাযোগহীন যুগে আমার মনে হচ্ছিল, মরে যাই।
চারপাশের শীত, ক্ষোভ আর অপমানে হু হু করে বিষণ্নতা আমার ভেতরে ঢুকতে থাকে। আধমরার মতো দিনরাত কাটাতে থাকি। আশরাফ এসে দেখে, বমিতে একাকার হয়ে আমি বিছানায় নেতিয়ে আছি। আশরাফের শব্দ পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলি, এখানে আমি মরে যাব, আর একমুহূর্তও নয়। এরপর সব শুনে আশরাফ সেদিন মাসের মাঝখানের তোয়াক্কা না করে আমাকে নিয়ে প্রথমে তার কলিগের বাড়িতে ওঠাল। পরদিনই ভাতালি রোডে দারুণ একটা বাসা পাওয়া গেল। আমি সেদিনের আশরাফের সেই সিদ্ধান্তের জন্য আজীবন তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি। যদি আর কয়েকটা দিন মানিয়ে চলতে বলত, জানি না, আমি কী করতাম!
ভাতালির পরে আরেকটা বাড়িতেও ছিলাম। দারুণ বাড়িওয়ালি! দারুণ সব স্মৃতি! মেডিকেল কলেজের পাশে হওয়ায় ধীরে ধীরে চিকিৎসকদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হলো। যাদের অনেকেই এখন দেশ–বিদেশের অনেক বড় চিকিৎসক। একসময় ইলিয়াস ফারুকী নামের একটা ছেলে যে ছিল মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ, ব্যাচেলর হিসেবে বাসা পাচ্ছিল না। আশরাফের খুব স্নেহভাজন। আমাদের বড় বাড়ির একটা ঘরে এসে উঠল। দারুণ ভালো মুভি দেখে। গান শোনে। নিজের চমৎকার ব্যবহারে চিকিৎসকেরা তার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। ওর সূত্র ধরেই চিকিৎসকেরা আসত। তখন ভাতালিতে আমার গর্ভের অর্চিকে সঙ্গ দিতে তার খালামণি ঝর্ণা এসে উঠেছিল। ঝর্ণার ওপর নিজের ভার ছেড়ে আমি তখন লেখালেখির মধ্যে ডুবে যেতে পারতাম। ইলিয়াস আমাদের গভীর আত্মীয় হয়ে গেল। এখনো সেই সম্পর্ক আছে। আমি তার সঙ্গে, চিকিৎসক মেয়েদের সঙ্গে সিলেটের মতো রক্ষণশীল জায়গায় কাঁচাবাজার করতে যেতাম। মেডিকেলের পাশে বলে কাঁচাবাজারের মহল ছিল উদার। যাহোক, সেখান থেকেই একটা গল্প পাঠাই আনওয়ার আহমদের লিটলম্যাগ রূপম-এ। গল্পের নাম ছিল ‘পুরুষ’। উত্তরে আনওয়ার ভাই লিখেছিলেন, আপনার ‘পুরুষ’ গল্প অনেক পুরুষকে লজ্জা দেবে। রাজধানীর সাহিত্যজগৎ থেকে ছুটে যাওয়ার পর সেটাই ছিল আমার প্রথম প্রাপ্তি। এরপর ধীরে ধীরে ফের নানা জায়গায় আমার লেখা ছাপা হতে শুরু হলো।
এবার কবরীর কথায় আসি। আমি ক্লাস সেভেন থেকেই নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একেবারে টনটনে হয়ে গেলাম। আমাকে যাতে কেউ অপমান করতে না পারে, খুব সতর্ক থাকতাম। কারণ, আমি আজীবন সব সহ্য করতে পারি, অপমান নয়। ফলে সেলিব্রিটি সম্পর্কে নিজের ভালো লাগা, আকুতি এসব নিজের মতো কঠিনভাবে গোপন রাখতে শিখে গেলাম। তখনই পাড়ার টিভিতে আফজাল হোসেনের নাটক দেখে তার দারুণ প্রেমে পড়ে গেলাম। এরপর সুবর্ণা, আফজাল, ফরীদির অনেক রকম নাটক—পারলে না রুমকি, নাটক, আমি সে ও সখা; রিনি রেজার সঙ্গে রক্তের আঙুরলতা, কূল নাই কিনার নাই—কত নাটক দেখেছি! সিনেমা হলে গিয়ে প্রথম তাজ্জব হই আলমগীর কবিরের ছবি দেখে। অসাধারণ! মাঝেমধ্যে মনে হতো, আলমগীর কবিরের যদি কোথাও কোনোভাবে আমার ওপর চোখ পড়ত! তাহলে অভিনয়জগতে চলে যেতাম। কারণ, তখন তাঁর পরিচালিত ছবি রূপালী সৈকতে, সূর্যকন্যা ইত্যাদি দেখে তাঁর পরিচালনার মহা ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
যাহোক, টিভিতে যখন আফজালকে দেখতাম, অজানা বেদনায় বুক হু হু করত। তখন সাদাকালো যুগে এত ভালো ভালো নাটক প্রচারিত হতো, মাঝেমধ্যে তীব্র লেখক সত্তা হোঁচট খেত, মনে হতো, অভিনয় করলেই আমার সাফল্য আসবে। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে ফের লেখালেখিতে বিন্যস্ত করতাম। তখন কিশোর বাংলায় আমার লেখা ছাপা হয়। ‘আমাদের পাতা’ নামক বিভাগটি দেখতেন দাদুভাই। ‘আমাদের জন্য লেখা’ বিভাগ দেখতেন দৈনিক যুগান্তর–এর সদ্য সাবেক হওয়া সম্পাদক সাইফুল আলম; সাইফুল ভাই। ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেই রুবীর খালাতো ভাই আলীমুজ্জামান হারু ভাইয়ের সঙ্গে (হারু ভাই তখন সাপ্তাহিক রোববার-এ কাজ করেন। রুবী ও হারু ভাই দুজনেরই আপন মামা কথাসাহিত্যিক রাহাত খান। সেসব গল্প অন্য দিন) আমি কিশোর বাংলা অফিসে গিয়ে সাইফুল ভাইকে বলি, আমি লক্ষ করেছি, সিনিয়র লেখকদের লেখা আপনার বিভাগে ছাপা হয়। দৈনিক বাংলা আমার লেখা ছাপে। এখন থেকে এই বিভাগে আমার লেখা ছাপতে হবে। নয় আমি আর কোনো লেখাই দেব না। এমন যখন তর্ক হচ্ছে, সাইফুল ভাই কার দিকে তাকিয়ে যেন মিটমিট করে হাসছিলেন। মাথা ঘুরিয়ে দেখি, একটা টেবিলের পেছনে আফজাল হোসেন দাঁড়িয়ে। তিনিই কিশোর বাংলার ইলাস্ট্রেশন করতেন, পরে জেনেছি। ভেতর ভেতর আমার হাত-পা জমে যায়। পরিচিত হয়ে ভেতরে তুমুল নার্ভাসনেস নিয়ে ওপরে নিজেকে সামলে বলি, আপনি তো নায়ক, অভিনেতা কিন্তু হুমায়ুন ফরীদি। আফজাল হোসেন সে কথা শুনে হাসতে হাসতে বলেন, ‘হারু, এ কাকে নিয়ে এলি? আমাকে অভিনেতাই মনে করে না।’ হারু ভাই বলেন, ‘ভালো করে চা–শিঙাড়া খাওয়া।’ যাহোক, সেদিনের পর আমি আফজাল হোসেনের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর এগোনোর দিকে ধাবিত হইনি। সোজা গিয়ে ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে সাইফুল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে সেভাবেই চলে আসতাম। আর আফজাল হোসেন তখন কত ব্যস্ত!
অনেক পরে, যখন ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি, তখন এটিএন বাংলায় শিল্প–সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা থেকে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য দশজনকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হয়। সেখানে গান থেকে সাবিনা ইয়াসমীন, নাটক থেকে সুবর্ণা মুস্তাফা, চলচ্চিত্র থেকে কবরী সরোয়ার আরও আরও অত মনে নেই, সাহিত্য থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আমি গিয়েছিলাম। আমি কবরীর ব্যাপারটা জানতাম না, ফলে তাঁকে দেখেই হতবিহ্বল হয়ে আমি তাঁর পা ছুঁতে যাব, অমনি উনি আমাকে হাজারগুণ হতভম্ব করে দিয়ে বললেন, ‘এই তো পেয়েছি! আমার ক্রুশকাঠে কন্যার লেখক নাসরীন জাহানকে! আমি ওই বইয়ের পাতায় পাতায় আমাকে খুঁজে পেয়েছি। হন্যে হয়ে খুঁজেছি তার পর থেকে তোমাকে! কী ভাগ্য! তোমাকে এখানে পেয়ে গেলাম! জীবনে এমন বিস্ময়কর অপূর্ব মুহূর্ত আর কী হতে পারে?’