রণজিৎ গুহ ও ‘ভদ্রলোকশ্রেণি’

গতকাল ২৮ এপ্রিল ছিল নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রখ্যাত তাত্ত্বিক রণজিৎ গুহর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী

রণজিৎ গুহ (২৩ মে ১৯২৩—২৯ এপ্রিল ২০২৩)ছবি: সংগৃহীত

রণজিৎ গুহর প্রধানতম পরিচয় নিম্নবর্গের ইতিহাসকার হিসেবে, আর সেদিক থেকে ভদ্রলোকশ্রেণির সমালোচনা তাঁর মূল কাজেরই অঙ্গীভূত। বাংলা অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিক থেকে এ সমালোচনার এক প্রধান তাৎপর্য এই যে এ শ্রেণি ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে ওতপ্রোত থেকেই বিকশিত হয়েছে। ফলে সমাজের অধিপতি শ্রেণির ভাবাদর্শ যেমন এদের হাতেই তৈরি হয়েছে, ঠিক তেমনি ঔপনিবেশিক শাসনকে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সমালোচনা করাও এ শ্রেণির পক্ষে সম্ভব হয়নি। শ্রেণি হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণে বর্ণাঢ্য এ জনগোষ্ঠীর অন্তরঙ্গ পর্যালোচনা যদি না করা যায়, তাহলে বাংলা অঞ্চলের উপনিবেশায়ন-প্রক্রিয়া যথাবিহিত কায়দায় বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না। অথচ ইতিহাস বা ভাবাদর্শ বা সংস্কৃতির অভিমুখ রচনার দায় দায়িত্ব মুখ্যত এই শ্রেণির হাতেই থাকায় বাংলা অঞ্চলের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে এ ধরনের চর্চা তুলনামূলক কম। এদিক থেকে রণজিৎ গুহর সমালোচনা বিশেষ তাৎপর্যবহ।

বর্তমান লেখায় আমরা গুহর দুটি রচনা অবলম্বন করে ভদ্রলোকশ্রেণি প্রসঙ্গে তাঁর পর্যালোচনার দু-একটি দিকের তীক্ষ্ণতা ও কার্যকরিতা বুঝতে চাইব। প্রথমটির নাম নীল-দর্পণ: দ্য ইমেজ অব আ পিজেন্ট রিভোল্ট ইন আ লিবারেল মিরর (১৯৭৪), আর দ্বিতীয় পুস্তিকার নাম অ্যান ইন্ডিয়ান হিস্টোরিওগ্রাফি অব ইন্ডিয়া: আ নাইনটিনথ সেঞ্চুরি অ্যাজেন্ডা অ্যান্ড ইটস ইমপ্লিকেশনস (১৯৮৮)। রচনা দুটির বহুস্তর তাৎপর্যের মধ্যে আমরা কেবল ভদ্রলোকশ্রেণির সমালোচনার ধরন ও প্রবণতার দিকটিই এখানে উপস্থাপন করব।

নীল-দর্পণ–বিষয়ক লেখাটিতে রণজিৎ গুহ বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত নাটকটি পড়ার জন্য যে ধরনের পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন, তা একই সঙ্গে ইতিহাস-পাঠ ও সাহিত্য-পাঠের অনন্য দৃষ্টান্ত। মূলত ভদ্রলোকশ্রেণির অবস্থা, অবস্থান ও মতাদর্শিক ভুবনে নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চারিত করেই তিনি এ অসামান্য সাফল্য পেয়েছেন। প্রথমেই তিনি বাংলাভাষী ভদ্রলোক পাঠকসমাজে নাটকটির বেশুমার গ্রাহ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের আবেগঘন অনুমোদনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বুঝতে চেয়েছেন, এই সামষ্টিক ও সর্বাত্মক সম্মতির ব্যাকরণ কী। তাঁর জবাব এই যে নীল-দর্পণ আসলে ছিল কলকাতার নাগরিক লিবারেলদের মুখ বাঁচানোর একটা সুযোগ। কলকাতার উদারনৈতিক মানবতাবাদী গোষ্ঠী যে সংকীর্ণ মনোবৃত্তি ও মতাদর্শিক কাঠামোয় জীবন যাপন করত বা করতে বাধ্য ছিল, নীল-দর্পণ–এ বস্তুত সে কাঠামোরই পুনরুৎপাদন ঘটেছে। কিন্তু তাতে বিদ্রোহ ও ইংরেজবিরোধিতার আভাস থাকায় ভদ্রলোক সমাজ একেই গ্রহণ করেছেন ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে।

নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র, রণজিৎ গুহ লক্ষ করেছেন, এ শ্রেণিরই মানুষ। ইংরেজি শিক্ষা, সংস্কার আন্দোলন, পশ্চিমায়ন ও আধুনিকায়নের যে ছকে এ ভদ্রলোকশ্রেণি বিকশিত হয়েছে, তিনি মোটেই সে কাঠামোর বাইরের কেউ নন। আর তাঁর নাটকের চরিত্রগুলোও চূড়ান্ত বিচারে একই ভাবাদর্শিক আবহের মধ্যেই ক্রিয়া করেছে। নবীনমাধব চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা সূত্রে এ গোত্রভুক্ত; আর তার ভাই বিন্দুমাধব তো কলকাতার ইংরেজিপড়ুয়া। বিন্দুমাধবের শিক্ষা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের যে উচ্ছ্বাস, তা ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে সেকালের শহর ও গ্রামে সঞ্চারিত মনোভঙ্গিরই প্রকাশ। এভাবে এ নাটকের চরিত্র ও তার পাঠকশ্রেণির মধ্যে মনোভাবগত ও সাংস্কৃতিক সাম্য পরিলক্ষিত হয়।

এ শ্রেণির—নাটকের ও বাস্তবের—অস্তিত্বের অন্যতম নির্ভরতা ছিল আইন। ‘ব্রিটিশ আইন’ই ছিল তাদের প্রধান রক্ষাকবচ। সবাই ভরসা করেছে এ আইনের ওপর। নীল-দর্পণ–এ জমিদারদের একাংশের নিন্দা করা হয়েছে; কুখ্যাত ‘হাপ্তম’ আইনের বিরোধিতা করা হয়েছে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে আইন থেকে গেছে নির্ভরতার এলাকা। যেমন নবীনমাধব বারবার নিশ্চয়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছে, ছোটখাটো ব্যক্তিরা বিচারে পক্ষপাতিত্ব করলেও চূড়ান্ত বিচারে আইন ন্যায়ের পাশেই থাকবে। গুহ দেখিয়েছেন, সমকালীন পত্রিকার প্রচারণা, কলকাতার ভদ্রলোকদের তৎপরতা ও নাটকের কুশীলব—সবাই একসঙ্গে, একই সুরে ব্রিটিশ আইনের চূড়ান্ত ন্যায়বিচারের কথাই বলেছে।

সেদিক থেকে বলা যায়, নাটকের সামগ্রিক আবহে এমন একটা দ্বৈরথ তৈরি হয়েছে, যেখানে ‘ইংরেজ’ বর্গটি দুটি বিপরীত প্যাটার্নে বিভক্ত হয়েছে। একদিকে আছে মূল ক্ষমতাকাঠামোর নিয়ন্ত্রকেরা; আর অন্যদিকে কাঠামোর বিভিন্ন অংশে দায়িত্বরত কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি, যারা ব্রিটিশ শাসনের ন্যায়ের ধারণাটা রক্ষা করছে না। উনিশ শতকের উপনিবেশিত বাস্তবতায় এ বিভাজন করা হতো ‘বড় ইংরেজ’ আর ‘ছোট ইংরেজ’ নামে। ‘ছোট ইংরেজ’দের কুকর্মের দায়ভার এভাবেই ‘বড় ইংরেজ’রা লাঘব করত। নীল-দর্পণ নাটকে যেমন খারাপ চরিত্র উড ও রোগ সাহেব। খারাপের বিপরীতে ভালোর এ প্রস্তাবের মানেই হলো, সব সময় একটা আশা থাকছে রাষ্ট্রতন্ত্রের কাছে। রণজিৎ গুহর এ পর্যবেক্ষণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এ অর্থে যে উনিশ শতকে, এমনকি বিশ শতকের কিছু সময় পর্যন্তও ভদ্রলোক সমাজ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে মর্মগত অর্থে কোনো সমালোচনা আসলে করেনি। রাষ্ট্রতন্ত্র সম্পর্কে নানা অসন্তোষ জানিয়েছে, অধিকতর সুযোগ-সুবিধা বা সম্মানের দাবি জানিয়েছে। সেগুলোর কোনো কোনোটিই আমাদের দেশে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব হিসেবে কীর্তিত-বন্দিত হয়ে থাকে। কিন্তু আদতে সেগুলো যে মোটেই ব্রিটিশরাজের প্রতি কোনো প্রকার অনাস্থার প্রকাশ নয়, নীল-দর্পণ বা নীলচাষ বা নীল-বিদ্রোহের বরাতে গুহ তা পরিষ্কার করে উপস্থাপন করেছেন।

কথাটা গুহ খোদ নীল-দর্পণ–এর লেখক সম্পর্কেও বলেছেন। দীনবন্ধু মিত্রর অপরাপর লেখাপত্র এবং নানা ইস্যুতে তাঁর অবস্থান ও মনোভাব বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন যে এ লেখক স্বভাবতই সেকালের ভদ্রলোক সমাজের এক যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবেই সক্রিয় ছিলেন। তখনকার প্রধান জীবনদৃষ্টি ও বিশ্বাস, যেমন ভারতের বর্তমান অবস্থা খুবই দুর্দশাগ্রস্ত এবং ইংরেজ শাসনই ভারতকে রক্ষা করবে কিংবা আগের মুসলমান শাসন খুবই খারাপ ছিল, তারা স্বৈরতন্ত্রী শাসন চালাত ইত্যাদি প্রশ্নে তাঁর অবস্থান মোটেই আলাদা ছিল না। গুহ ঠাট্টা করে বলেছেন, যে নাটকে এমন সংকীর্ণ দৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক ও রাজানুগত্যে নিষ্ঠাবান এক লেখকসত্তার প্রতিফলন ঘটেছে, সে নাটককে যে দশকের পর দশক বাংলার ভদ্রলো–কসমাজ এক প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী রচনা হিসেবে উপভোগ করেছে, সেটাই প্রমাণ করে, এখানকার জাতীয়তাবাদ বা ইংরেজবিরোধিতা প্রকৃত প্রস্তাবে কতটা ইংরেজ-আনুগত্যে নিমজ্জিত ছিল।

অ্যান ইন্ডিয়ান হিস্টোরিওগ্রাফি অব ইন্ডিয়া: আ নাইনটিনথ সেঞ্চুরি অ্যাজেন্ডা অ্যান্ড ইটস ইমপ্লিকেশনস বইটির নামই ইঙ্গিত দেয়, মূলত ভদ্রলোক ইতিহাসকারদের দৃষ্টিভঙ্গি বা ইতিহাসতত্ত্বই এর লক্ষ্য। ভারতীয় ইতিহাসের জন্য তিনি আশা করেছেন এক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু যাঁদের দিয়ে সে কাজ হবে, তাঁরা নিজেরাই জন্মেছেন ও বেড়ে উঠেছেন উপনিবেশকের ইতিহাসদৃষ্টির মধ্যে। এখানে রণজিৎ গুহ ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসঙ্গটি বিশদ করেছেন। ইংরেজি ভাষার আবহের মধ্যে এবং ইংরেজি শিক্ষার বিশিষ্ট জীবনদৃষ্টির মধ্যেই ভদ্রলোক–সমাজ বেড়ে উঠেছে বলে ইতিহাস সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিকভাবেই উপনিবেশকের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করেই বিকশিত হয়েছে। এমতাবস্থায় শাসকপক্ষের আকাঙ্ক্ষা আর এ শ্রেণির আকাঙ্ক্ষাও বেশ সমান্তরাল গতিতেই এগিয়েছে।

হিন্দু কলেজের এক ঘটনার উল্লেখ করেছেন রণজিৎ গুহ, যেখানে কলেজের ছাত্রদের একটি রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছিল। রচনার বিষয় ছিল, ‘ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসার নৌপথ আবিষ্কৃত হওয়ায় কে বেশি লাভবান হয়েছে—ভারত নাকি ইংল্যান্ড’। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ছাত্ররা সাধারণভাবে উত্তরে লিখেছিল, ইংল্যান্ডের কিছু উপকার তো নিশ্চয়ই হয়েছে, কিন্তু আসলে ভারতই এ মহান আবিষ্কারের প্রকৃত ফলভোগী। কারণ, এর মধ্য দিয়ে তারা সুশাসন আর আলোকায়নের সুফল পেয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি সেকালের ভদ্রলোকশ্রেণির সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। কাজেই রণজিৎ গুহ লিখেছেন, এ ধরনের একটা শ্রেণির কাছে ভারতীয় ইতিহাসের নিজস্বতা আশা করাই তো আসলে ভুল প্রত্যাশা।

রণজিৎ গুহর এ রচনা দুটির আরও নানা তাৎপর্য আছে। কিন্তু যদি কেবল উপনিবেশিত ভদ্রলোকশ্রেণির স্বরূপ উন্মোচনের দিক থেকে পঠিত হয়, তাহলেও এর গুরুত্বটা বোঝা যাবে। উনিশ শতকে পশ্চিমায়ন ও আধুনিকায়নের মতো প্রক্রিয়াগুলো এ অঞ্চলের জীবন ও রাষ্ট্রে আকারে-প্রকারে বেশ জোরালোভাবে গেড়ে বসে। ব্যাপারগুলো যে একই ধারায় এখনো বহমান, তা নয়। কিন্তু অনেকগুলো গভীর কাঠামো যে তখনই কেজো আকার পেয়ে গেছে এবং এখনো ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায় আমাদের সামগ্রিক সত্তাতত্ত্বীয় অনুসন্ধানের অন্তত একাংশ সে সময়ের পর্যালোচনার ওপর নির্ভরশীল।

মুশকিল হলো, কলকাতায় ঔপনিবেশিক শাসনের ব্যাপারে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্মতি দেখা গেছে। বিশাল ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্র হিসেবে এবং প্রাচ্যবাদীচর্চার বর্ণাঢ্য ইতিহাসের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কলকাতার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃষ্টিশীল উৎপাদন ছিল অসাধারণ। ফলে উনিশ শতকের কলকাতাকে উপনিবেশায়নের কেন্দ্র হিসেবে না দেখে আধুনিকায়নের কেন্দ্র হিসেবে দেখার প্রবণতা অত্যন্ত প্রবল। আধুনিকায়নের সে অভিযানে প্রচুর সোনা ফলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেগুলোয় যে উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার চিহ্নও খুব প্রত্যক্ষ, তাতেও সন্দেহ করা চলে না।

রণজিৎ গুহর অন্যতম প্রধান অবদান উপনিবেশায়নের এসব চিহ্ন উন্মোচনের একরাশ সূত্র প্রণয়ন করা। যে ভদ্রলোকশ্রেণি পুরো প্রক্রিয়ার ধারক-বাহক, তার কুলজি টানা ছাড়া সে কাজে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে গুহর সাফল্যের প্রধান কারণ নিশ্চয়ই তাঁর মূল প্রকল্প—নিম্নবর্গের ইতিহাস। বলা যায়, নিম্নবর্গের চিহ্নায়ন বিপরীতক্রমে তাঁকে নিয়ে গেছে ভদ্রলোকশ্রেণির চিহ্নায়নে। ইতিহাসতত্ত্বে গভীর অনুরাগ, তত্ত্বায়নপ্রবণতা এবং টেক্সট রিডিংয়ে অসামান্য কুশলতার সমন্বয়ে তিনি বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস বিশ্লেষণের জন্য খুবই জরুরি বর্গ ‘ভদ্রলোকশ্রেণি’র বিশ্লেষণে গভীর নতুনত্ব আনতে পেরেছেন। আমাদের সামগ্রিক ইতিহাস-পাঠ ও সাহিত্য-পাঠে ওই উন্মোচন যে প্রভাবসঞ্চারী হবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।