দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। একজন পাঁড় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী, আরেকজন পাঁড় ইসলামপন্থী বিপ্লবী। তবু জীবনের কোনো এক বাঁকে এসে দুই মেরু এক রেখায় এসে মিলবে, জীবিকার প্রয়োজনে পাশাপাশি বসবে, আড্ডা দেবে, ফেলে আসা জীবনের গল্প বলবে এবং দিন শেষে সন্ধ্যার মৃত আলো গায়ে মাখতে মাখতে বাড়ি ফিরবে, তা কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন তাঁরা?
শামস-উল-হক ও হাজি সেরাজুদ্দিন—দুজনের কেউই ভাবেননি। তবু জীবন তাঁদের নানা পথ ঘুরিয়ে এনে অবশেষে এক রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। তাঁরা এখন কাবুলের ফুটপাতে বসে বই বিক্রি করেন।
আফগানিস্তানের কাবুল। বিখ্যাত এক শহর। এই শহরের সবচেয়ে বড় বাজারটির কাছে বসে পঁচিশ বছর ধরে তাঁরা বই বিক্রি করছেন। শামস-উল-হক বিক্রি করেন ইতিহাস ও রাজনীতির বই। তাঁর বইয়ের তাকে দেখা যায়, মুজাহিদিন কমান্ডার আহমদ শাহ মাসউদের জীবনীর পাশে চুপটি করে বসে আছে আফগানিস্তানের শেষ কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক মোহাম্মদ নজিবুল্লাহর জীবনী। তার নিচের তাকেই দেখা যায়, বাবা-ই-মিল্লাত (জাতির পিতা) মোহাম্মদ জহির শাহের জীবনী। ঠিক তার পাশেই রয়েছে হিটলারের মাইন ক্যাম্ফ, আর এর পাশে পশতু ভাষায় অনূদিত চে গুয়েভারার বলিভিয়ার ডায়েরি। ষাট বছর বয়সী শুভ্র দাড়ির শামস-উল-হক হেসে বলেন, ‘ভাববেন না এই মানুষগুলোর আদর্শ অনুসরণ করি আমি। এরা আমার দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তবু বিক্রি করি, বলতে পারেন পেটের দায়ে।’
সেরাজুদ্দিন অবশ্য শুরু থেকেই পাঠ্যবই বেশি বিক্রি করেন। তাঁরও বয়স হয়েছে ষাট। পরিবারে খাওয়ার মুখ আছে দশটি। তাদের অন্ন জোগাতে রোজ সকালে বইয়ের পসরা নিয়ে বসেন। সারা দিনে বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৬০০ আফগানি মুদ্রা। তা দিয়েই টেনে চলেন সংসার। তাঁর ছেলেরা অবশ্য মাঝেমধ্যে দোকানে এসে বসে। সেরাজুদ্দিন কামেল লোক, ঘটে বুদ্ধি রাখেন, মৃদু হেসে বলেন, ‘পাঠ্যবই বিক্রি করি, কারণ কাবুলে সবচেয়ে বেশি স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীও তাই বেশি। তরুণ বয়সের এসব ছেলেমেয়েই আমার ক্রেতা।’
শুরুর দিকে অন্যান্য বইও বিক্রি করতেন সেরাজুদ্দিন। ইরান আর পাকিস্তান থেকেও বই আনতেন।
কিন্তু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তালেবানরা ক্ষমতায় এলে তাঁর বেচাবিক্রি লাটে ওঠে। ‘ধর্মনিরপেক্ষ উদার বই, সমাজতান্ত্রিক বই এবং ইরানি বই তালেবানরা বিক্রি করতে দেয়নি। এমনকি মুসলিম ব্রাদারহুডদের বই বিক্রিও নিষিদ্ধ করেছিল তারা।’ বলেন সেরাজুদ্দিন। তখন ব্যবসা বাঁচাতে বেশি বেশি পাঠ্যবই বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি।
এই দুই বন্ধু বই বিক্রেতা শুরুতে কেউ কাউকে চিনতেন না। প্রথম দোকান বসিয়েছিলেন শামস-উল-হক। তিনি বলেন, ‘তথাকথিত মুজাহিদিনদের মতোই একদিন জোর করে আমার পাশে দোকান বসায় সেরাজুদ্দিন।’ তারপর চেনাপরিচয়। টুকটাক আলাপ। দিন যায়, রাত যায়। তাঁদের আলাপ গাঢ় হতে থাকে। একসময় আবিষ্কার করেন, যৌবনকালে তাঁরা ছিলেন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। তাঁদের আদর্শ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। শামস-উল-হক ছিলেন সমাজতান্ত্রিক মন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবী, আর হাজি সেরাজুদ্দিন ছিলেন ইসলামি বিপ্লবে দীক্ষিত মুজাহিদিন।
আশির দশকে শামস আফগান কমিউনিস্ট শাসকদের বিমানবাহিনীর একজন অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। তিনি অবশ্য দলের সদস্য ছিলেন না। তবে ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে যে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেই অভ্যুত্থানকে তিনি সমর্থন করেছিলেন। ‘আমার মতো আফগানিস্তানের বেশির ভাগ তরুণই তখন সোভিয়েতদের সমর্থন করেছিল। না করে উপায় ছিল না। তখন (১৯৭৩ সাল) মোহাম্মদ দাউদ খান তাঁর চাচাতো ভাই মোহাম্মদ জহির শাহকে উৎখাত করে ক্ষমতায় বসেন। তারপর শুরু হয় রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী, লেখক ও ধর্মীয় নেতাদের নির্বিচার গ্রেপ্তার ও হত্যা। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আফগানিস্তান। অবশেষে ১৯৭৯ সালের ক্রিসমাসের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। সোভিয়েতদের এই অভ্যুত্থান তখন সাধারণ আফগানবাসীর কাছে স্বাভাবিকভাবেই আশীর্বাদ মনে হয়। আশীর্বাদ মনে হয়েছিল আমার কাছেও।’ একনিশ্বাসে বলে যান শামস-উল-হক। এই ছিল তাঁর কমিউনিস্টদের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ওঠার গল্প।
তবে হাজি সেরাজুদ্দিনের গল্পটা এমন সরল নয়। সেরাজুদ্দিন ১৭ বছর বয়সেই হারকত-ই-ইসলামি সংগঠনে মুজাহিদিন হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কারণ, সোভিয়েত অভ্যুত্থানের পর সেরাজুদ্দিনের পরিবারের অনেক সদস্যকে কারাবন্দী করা হয়েছিল এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। স্বজন হারানোর বেদনা ও প্রতিশোধস্পৃহা সেরাজুদ্দিনকে বাধ্য করেছিল অস্ত্র হাতে তুলে নিতে। তিনি খুব দ্রুতই একজন মুজাহিদিন যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পারেন সেরাজুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘মুজাহিদিনদের ভুলের কারণেই নব্বইয়ের দশকে তালেবানরা ক্ষমতায় এসেছিল।’
যৌবন পেরিয়ে এই দুই বিপরীত আদর্শের মানুষ এখন প্রৌঢ়ত্বে পা রেখেছেন। চোখের সামনে দেখেছেন গত পঞ্চাশ বছরের আফগানিস্তান। কত ঘটন-অঘটন, কত উত্থান-পতন! কত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছেন তাঁরা। সোভিয়েতদের দখলদারি দেখেছেন, তালেবানদের উৎপাত দেখেছেন, মার্কিনদের আগ্রাসন দেখেছেন। এখন মার্কিনদের হটিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে তালেবান। তাই এখন আবার তালেবানদের এই পুনরুত্থানও দেখছেন।
তাঁরা এত রক্ত আর অশ্রু দেখেছেন যে তাঁরা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চান না। কায়ক্লেশে বাকি জীবন পার করে দেওয়াই এখন তাঁদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কী আছে আফগানিস্তানের ভাগ্যে—এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলে তাঁরা দুজনেই আকাশের দিকে তাকান। বলেন, ‘আল্লাহই ভালো জানেন। তিনিই ভাগ্যবিধাতা।’
সূত্র: নিউ লাইনস ম্যাগাজিন, নিউইয়র্ক টাইমস ও ব্রিটানিকা।