আমেরিকানের শেষকৃত্যে বাজল আইয়ুব বাচ্চুর গান

যৌবনে রোনাল্ড কামাচো, তিনি মনে করতেন আইয়ুব বাচ্চু পৃথিবীর সেরা গিটারিস্টদের একজন। ছবি: সংগৃহীত
যৌবনে রোনাল্ড কামাচো, তিনি মনে করতেন আইয়ুব বাচ্চু পৃথিবীর সেরা গিটারিস্টদের একজন। ছবি: সংগৃহীত

রোনাল্ড কামাচো। গিটার বাজাতে খুব ভালোবাসতেন ৭৩ বছর বয়সী এই ইতালিয়ান-আমেরিকান। করোনা সংক্রমণে আমেরিকায় মারা গেছেন তিনি। তবে বাংলাদেশের আইয়ুব বাচ্চুর গান তাঁর প্রিয়তম ছিল বলে এই ভিনদেশি মানুষটির শেষকৃত্যে বাজল ‘সেই তুমি’।

সকাল ছয়টা। আমি অফিসে এফটিআইআর স্পেকট্রোমিটার মেশিনের সামনে। বেশ কিছু রাশ টেস্ট আছে। নোট দেওয়া আছে, এগুলো আগে শেষ করতে হবে।

করোনা শুরু হওয়ার পর থেকেই আমেরিকানদের ভিটামিন সি, জিংক, হলুদের সঙ্গে সঙ্গে বেরি–জাতীয় ফলের ভিটামিনের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। যার বেশির ভাগই ক্যাপসুল, সফটজেল ও জুস ।এসব উপাদান শরীরের ইমিউন সিস্টেম মজবুত করে। ভাবছি, করোনা সংক্রমণ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে এ দেশে মানুষ মুড়ির মতো এসব খাচ্ছে? হবে হয়তো! নাহয় প্রতিদিন এত টেস্ট করতে হতো না। আগে কখনো এই কোম্পানিতে এভাবে এত বেরি গ্রুপের ভাইটামিস টেস্ট করতে দেখিনি।

এসব সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যেই বেজে উঠল ফোন।

: রোশন, ক্যান ইউ কাম টু মাই রুম? 

: ইয়েস কামিং!...বাট হোয়াই! 

: প্লিজ, কাম। আই নিড ইউর হাগ। 

: হাগ? 

মনে মনে বলি, সারছে। এই বেটা বলে কী! একে তো সকাল, তার ওপর এই সময়ে! জানতে চাই,

: হাগ? আর ইউ শিউর? 

: ইয়েস বলেই কেমন করে যেন বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগল। আর আমার আরও সন্দেহ হতে লাগল।

: অ্যাম কামিং, বাট উই শুড মেনটেইন সোশ্যাল ডিসট্যান্স। 

আমি ফোন রাখলাম। তবে সঙ্গে সঙ্গেই গেলাম না। মাথার মধ্যে উল্টাপাল্টা চিন্তা ঘুরতে থাকল।

সকাল সাড়ে ছয়টা। কোডি আর আমার শিফট ছয়টা থেকে। আমি আর কোডি এসেই কাজ শুরু করেছি। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়নি। দুজন দুই রুমে। আরও দুজন আসবে। করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব মানার জন্য আমাদের কাজের সময় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

ফোনটা রেখেই ভাবছিলাম, করোনার সময়ে আমার বরকে কখন জড়িয়ে ধরেছি মনে নেই। প্যানডেমিক সময়ে যেহেতু আমাকে কাজের জন্য বাসা থেকে বের হতে হয়, তাই মেয়েদের থেকেও দূরে থাকার চেষ্টা করি। তাহলে! এই সময়ে কোডি কেন এমন জড়িয়ে ধরতে ফোন করল। তা-ও এত সকালে! যেখানে আমি আর সে ছাড়া এই মুহূর্ত অফিসে আর কেউ নেই। জড়িয়ে ধরে তো কিসও করতে পারে। কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এদের কাছে দুটিই সমান। এত বছরে কখনো এমন আচরণ লক্ষ করিনি। ফলে মাথায় কেমন যেন সন্দেহ হলো। এরপরও তাকে একটা হাগ দেওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হলাম, তবে তার রুমে যাব যাব করেও সময় নিলাম যেতে। 

কোডি কামাচো। সিনিয়র কেমিস্ট। জন্মসূত্রে আমেরিকান। ইতালীয় দাদা। একসময়ে ভালো গিটার বাজাতেন। কোডির মা–বাবার বিচ্ছেদ হওয়ায় তাঁরা আলাদা থাকেন। সে থাকে দাদার সঙ্গে। আমরা একসঙ্গে ছয় বছর ধরে কাজ করি এখানে। কাজের অনেক ভুলভ্রান্তি একই সঙ্গে সমাধান করি। পাশাপাশি বসে খাই। সে ইতালির গল্প করে, আমি বাংলাদেশের। 

অফিসের বার্ষিক পিকনিকে সবাই পরিবার নিয়ে যায়। প্রতিবছর কোডি তার ৭৩ বছর বয়সী দাদা রোনাল্ড কামাচোকে নিয়ে পিকনিকে আসে। দেখতে হলিউডের বয়স্ক কোনো নায়কের মতো। সবাইকে খুব মাতিয়ে রাখেন রোনাল্ড। ভালো গিটার বাজান। আমরা অনেকেই তাঁর দাদার ভক্ত হয়ে গেছি। গিটার প্রসঙ্গে কথা উঠতেই একবার আমি রোনাল্ডকে আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ গানটি ইউটিউব থেকে শুনিয়েছি। সেই গান তাঁকে ইংরেজি করে দিয়েছি। আইয়ুব বাচ্চুর বেশ কিছু স্টেজ পারফরম্যান্স দেখিয়েছি। আইয়ুব বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখে মুগ্ধ হয়েছেন রোনাল্ড। শুনে বলেছেন, ও মাই গড! হি ইজ আ জিনিয়াস। 

তখন আমি মন খারাপ করে বলেছি, উই লস্ট আওয়ার জিনিয়াস। হি পাসড অ্যাওয়ে। এরপর আইয়ুব বাচ্চুর কিছু গান তিনি শুনবেন বলে আমার কাছ থেকে গানের লিঙ্ক নিলেন। এরপর থেকে রোনাল্ড আমাকে বেশ কয়েকবার তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর গিটার শুনতে ডেকেছেন। আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। 

হঠাৎই পাশের রুম থেকে কোডির চিৎকার কানে এল। সে হাউমাউ করে কাঁদছে। সঙ্গে হাত–পা ছুড়ছে। চেয়ারে লাথি আর টেবিলে থাপড়াচ্ছে। আমি দৌড়ে ছুটে যেতেই সে-ও দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। দেখলাম, তার ল্যাপটপের ভিডিওতে হাসপালে চিকিৎসক–নার্সসহ সবাই ছুটোছুটি করছে। মাঝখানে কোডির দাদাকে ভেন্টিলেটরসহ দেখা যাচ্ছে। এক নার্স মোবাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে কোডিকে দাদার শেষ অবস্থা দেখানোর চেষ্টা করছেন। ভিডিওতে নার্স কোডিকে বলছে, ডার্লিং ইটস আ ডাইং প্রসেস... 

আমরা তোমার দাদার কোনো হৃৎস্পন্দন পাচ্ছি না। আমরা একটু পরই ভেনটিলেশন খুলে নিচ্ছি। তাই তোমাকে দেখাতে কল দিয়েছি। 

আমার কান্না পেল। আফসোস হলো, কেন আরেকটু আগে এলাম না। আমি জীবনে এমন ভিডিও কলে কারও মৃত্যু দেখিনি। এ দেশে আসার পর আত্মীয়স্বজনদের অনেকেরই মৃতদেহ ভিডিও কলে দেখেছি। তবে এমন সরাসরি ভিডিওর মাধ্যমে কাউকে মারা যেতে দেখিনি। তাই কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হাত–পা কাঁপতে লাগল। কোডিকে চেয়ারে বসিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। 

একটু পরেই চিকিৎসককে বলতে শুনলাম, ইউর গ্র্যান্ডপা ইজ নো মোর। উই আর স্যরি। 

রোশান, পাপা নো মোর। নো পাপা পাপা! নো! 

কান্নায় আমিও আর সহ্য করতে পারছিলাম না। 

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: প্রথম আলো
আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: প্রথম আলো

কোডি দাদাকে পাপা ডাকত। পাপা পাপা বলে আরও শক্ত করে আমাকে তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। এরই মধ্যে আমার বাকি কলিগরাও আমার টেক্সট পেয়ে ছুটে এসেছে। দেখলাম তারাও চোখ মুছছে। সবাই কোডিকে জড়িয়ে কান্না করতে শুরু করেছে।

একটা সময় ভিডিও অফ হয়ে গেল। কিছু সময় পর কোডিও কান্না থামিয়ে নীরব হয়ে এল।

এরপর কোডি জানাল, জানুয়ারি মাসে গ্র্যান্ডপা ইতালি গিয়েছিলেন তার স্কুলবান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকেই ফিরেছেন অসুস্থ হয়ে। এরপর থেকেই তিনি হাসপাতালে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন।

আমরা চারজন কোডিকে বাসায় পৌঁছে দিলাম। দরজার বাইরে থেকেই তাকে বিদায় দিয়ে আবারও অফিসে ফিরে আমাদের যান্ত্রিক কাজে মনোযোগ দিলাম। কোডি কয়েকটা জায়গায় কল দিয়ে জানাল, ফিউনারেল হোম পাওয়া গেছে। তবে ১২ দিন লাগবে। এরই মধ্যে কোডি তার দাদার পছন্দের সবকিছুর আয়োজন করতে চায়। তার দাদার পছন্দের মধ্যে সে আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ গানের মিউজিক ডাউনলোড করে নিয়েছে।

এবার আমি অবাক হলাম। কোডির দাদা আইয়ুব বাচ্চুর গিটার বাজানো পছন্দ করতেন। তিনি মানতেন, আমাদের আইয়ুব বাচ্চু পৃথিবীর সেরা গিটারিস্টদের একজন। কিন্তু এতটা করতেন, তা জানা ছিল না।

কোডি আমাকে কল দিয়েছে, তুমি কি ফিউনারেলে আসতে চাও? তার মানে হলো সে চাইছে আমি যেন থাকি।

আমি অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত করলাম। স্বার্থপরের মতো করোনার ভয়ে যাইনি গ্র্যান্ডপাকে শেষবার দেখতে। বলেছি, স্যরি, কোডি। 

ফিউনারেলে কোডি তার দাদার জন্য ‘সেই তুমি’ মিউজিক বাজিয়ে শুনিয়েছে। আর আমি ঘরে বসে প্রার্থনা করেছি। 

গ্র্যান্ডপা ক্ষমা কোরো, এবার তুমি আইয়ুব বাচ্চুর গান সরাসরি শুনতে পারবে। হয়তো দুজনে মিলে ওপারে নতুন কোনো কনসার্টের আয়োজন করবে।