‘ইউলিসিস’ নিয়ে যত কাণ্ড
‘আজ ব্লুমস ডে, জেমস জয়েসের ইউলিসিস–এ ঘটে যাওয়া ঘটনার বার্ষিকী। ডাবলিনের আবহাওয়া চমৎকার। আপনি ডাবলিনে আছেন? আজ অভিসারে যাবেন? তাহলে রিংসেন্ড পার্কে ঘুরে আসুন না কেন, যেমন করে সেই বিকেলে হেঁটেছিলেন জয়েস তাঁর প্রেমিকার সঙ্গে।’
ওপরের কথাগুলো ২০১৪ সালের ১৬ জুন ব্লুমস ডে উপলক্ষে লেখা হয়েছিল নিউইয়র্কারে। ইউলিসিস উপন্যাস নিয়ে ইংরেজিভাষী জগতে তোলপাড় চলে ওই দিন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। শহরটা যেন পৃথিবীর দুর্বোধ্যতম উপন্যাসকে বাস্তবে রূপায়িত করতে নামে!
জেমস জয়েসের কালজয়ী উপন্যাস ইউলিসিস ছাপা হয়েছিল ১০০ বছর আগে, ১৯২২ সালে ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে। জয়েস তখন প্যারিস প্রবাসে থাকা ৪০ বছর বয়সী এক আইরিশ যুবক। সে সময় তিনি প্রায় পানাসক্ত, চোখে একাধিক অস্ত্রপচারের পর প্রায় অন্ধ। এর সঙ্গে ছিল নিজের মেয়ের মানসিক অপ্রকৃতিস্থতা। এসব পরিস্থিতির মধ্যেই তিনি রচনা করেছিলেন ইউলিসিস। এখানে পুরো একটা পৃথিবীকে লেখক
পুরে দিয়েছেন দুই মলাটে একটা দিনের ভেতর।
উপন্যাসটি লেখা শুরু হয় ১৯১৪ সালে, শেষ হয় ১৯২১ সালে। প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ঘটনা ঘটেছে মাত্র এক দিনে। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে, জুন ১৬ ১৯০৪ সালে। ইউলিসিস রচনায় জয়েসের যতটা শক্তি খরচ হয়েছে, তার বড় অংশই গেছে ডাবলিনকে ফুটিয়ে তুলতে—শহরের রাস্তা, অলিগলি এবং এর গন্ধ ও দৃশ্য। উপন্যাসটি লেখার বহু দিন আগেই ডাবলিন শহরটি ছেড়ে গিয়েছিলেন তিনি। আর আজকের মতো গুগল স্ট্রিট ভিউ তখন ছিল না। তাই প্যারিসে বসে স্মৃতির ভেতর থেকেই ডাবলিন শহরকে গড়ে তুলেছিলেন জয়েস।
ইউলিসিসকে ঘিরে কাণ্ড–কীর্তির শেষ নেই। ১০০ বছর ধরে এই বই একদিকে যেমন নিরন্তর তর্ক উসকে দিয়েছে, অন্যদিকে সাহিত্যকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়। আজকে বিশ্ব যখন অনেক বেশি জাতিসর্বস্ব, অপরকে ঘৃণা যখন নিজ পরিচয়ের ভিত্তি, তখন ইউলিসিস–এর শেষ অধ্যায় আপনাকে চমকে দেবে, ‘কিন্তু আমি বলি—আমার দেশ আমার জন্য মরুক। এখন পর্যন্ত, সে তো তা–ই করেছে। আমি মরতে চাই না। মৃত্যু জাহান্নামে যাক। জীবন দীর্ঘজীবী হোক!’
ইউলিসিস ধ্রুপদি ঘরানার বই। সবাই বইটির কথা জানেন, কিন্তু পড়ে শেষ করেছেন খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষ। পৃথিবীর দুর্বোধ্যতম সাহিত্যকর্মের অন্যতম এই উপন্যাস এখনো রয়েছে পৃথিবীর পাঠক আকর্ষণের কেন্দ্রে। একে বুঝতে না পারাই কি এর বিখ্যাত হওয়ার কারণ? ইউলিসিসকে ঘিরে কত কী না হয়ে গেছে এত দিনে এবং এখনো হচ্ছে!
ব্লুমস ডে
ইউলিসিস উপন্যাসের দিন মানে ১৬ জুন। ইংরেজি সাহিত্যে দিনটি ব্লুমস ডে নামে পরিচিত। ব্লুমস ডে পালনেরও শতবর্ষ হতে বাকি আর মাত্র দুই বছর। ব্লুমস ডে নামটি এসেছে উপন্যাসের মূল চরিত্র লিওপোল্ড ব্লুম থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় জয়েসমোদীরা দিনটি পালন করেন। চমকপ্রদ তথ্য হলো, ১৯২২ সালে ইউলিসিস প্রকাশের দুই বছরের মধ্যেই ব্লুমস ডের উদ্যাপন শুরু হয়। ১৯২৪ সালের ২৭ জুনের এক চিঠিতে জয়েস মিস উয়িভারকে কয়েকজন মিলে ব্লুমস ডে পালনের খবর জানান।
ডাবলিনে এই দিনে এখনো সেই আমলের দুই ঘোড়ায় টানা গাড়িতে উপন্যাসে বর্ণিত পথ ধরে সারা দিন ঘুরে বেড়ান আগ্রহী ব্যক্তিরা। এই পথচলার শুরু হয় উপন্যাস যেখানে শুরু হয়েছে, সেই জায়গা থেকে। ঘটনার সব পথ চলে চলে শেষ হয় রাতে নাইটটাউনে। সংলাপগুলো চলতে যেতে থাকে।
ডাবলিনে বিভিন্ন ব্লুমস ডের জমায়েতে অনেক মানুষ হাজির হন সেকালের পোশাক পরে। কিছু আয়োজনে থাকে একটানা ইউলিসিস পড়ে শেষ করা। কখনো ৩৬ ঘণ্টাজুড়ে চলে সেই পাঠ। তবে ব্লুমস ডের মূল আকর্ষণ থাকে উপন্যাস শুরুর স্থান স্যান্ডিকোভে। সেখানে এখন জয়েস টাওয়ার আর জয়েস জাদুঘর। শত শত ডাবলিনবাসী উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের পোশাক পরে হেঁটে বেড়ান এদিন। এক চরিত্র আরেক চরিত্রের সঙ্গে কথা বলেন উপন্যাসের সংলাপে। প্রতিবছরের ১৬ জুন তাঁরা যেন ইউলিসিস–এর বয়ানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে আসেন। এ যেন শহরজুড়ে ইউলিসিস মঞ্চায়ন। আধুনিককালের আর কোনো লেখা নিয়ে এমন উদ্যাপন নিতান্ত দুর্লভ!
ইউলিসিস অ্যাপ
এখন পড়ার জগতে প্রভাব ফেলছে তথ্যপ্রযুক্তি। তাই জেমস জয়েসের কালজয়ী উপন্যাসকে ঘিরে বেরিয়েছে একটি অ্যাপ—‘ইউলিসিস অ্যাপ’। এই অ্যাপও আবার তৈরি করা হয়েছে বিচিত্রভাবে, বৈচিত্র্যময় এক অভিজ্ঞতা দেওয়ার নিমিত্তে। এ নিয়ে অ্যাপটির নির্মাতা আরিয়েল মালকার কথা হলো, ‘কিছু অ্যাপ পড়ার গতি বাড়ানোর দাবি করে। তবে আমরা সম্পূর্ণ উল্টো প্রস্তাব করছি। পড়ার গতিকে ধীর করার জন্য একটি অ্যাপ বানিয়েছি। আচ্ছা, আঙুল দিয়ে ইউলিসিস পড়ার ব্যাপারটি কেমন হবে!’ কিন্তু কেন পড়ার গতি স্লথ করে দেয়, এমন একটি অ্যাপ বানালেন মালকা? এ নিয়ে তাঁর যুক্তিকেও ফেলে দিতে পারবেন না আপনি। জয়েস নিজেই বলে গেছেন, ইউলিসিস কোনো সহজ পাঠের বই নয়। এর মধ্যে এত ধাঁধা, এত বিচিত্র প্রসঙ্গ ও শব্দ; আর অনুভূতির এমন জোরালো খেলা রয়েছে যে এটি ধীরে পড়াই ভালো। তাই ইউলিসিস–এ টেক্সট, স্থান, কাল এবং ভাবনা—এসব কিছুর ভেতরকার সম্পর্ক আবিষ্কারে পাঠককে সঙ্গে নিয়ে পথচলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এই অ্যাপ। ফলে আপনি এখানে পাঠের গতি বাড়ানো নয়, গতি ধীর করানোর অভিজ্ঞতা পাবেন। কেউ কেউ একে জেন স্টাইলে ইউলিসিস পাঠ বলেও অভিহিত করেছেন।
যখন গ্রাফিক নভেলে
কেবল অ্যাপ নির্মাণ করেই থেমে থাকেনি ‘ইউলিসিস’ নিয়ে নিরীক্ষা। এর মধ্যে সবচেয়ে দুঃসাহসী কাজটি নিয়ে বোধ হয় চেষ্টা করছেন চিত্রশিল্পী রবার্ট বেরি। ‘ইউলিসিস’ নিয়ে একটি গ্রাফিক নভেল তৈরির কাজ করছেন তিনি। উপন্যাসটি পড়ে পড়ে একটি করে পৃষ্ঠা আঁকছেন এই শিল্পী। পরে তা অনলাইনে পোস্ট করছেন—আপাতত কাজ চলছে এভাবেই। কাজ শুরুর সময় বেরি হিসাব করেছিলেন, এমন ধারায় কাজ চললে কাজটি শেষ করতে এক যুগের মতো লাগতে পারে। ‘ইউলিসিস’–এর গ্রাফিক নভেলের এ উদ্যোগে বেরি কোনো ঘাটতি রাখতে চান না। যে কারণে আপাতত এখানে আছে তিন স্তর—কমিক, পাঠনির্দেশিকা ও পাঠকের মন্তব্য। একই সঙ্গে এখানে থাকবে উপন্যাসের সম্পূর্ণ টেক্সট, পণ্ডিতদের মতামত ও গবেষণার লিংক তৈরির কাজ।
বেরির এই কাজ কৃতকৌশলের জগৎ থেকে বিদ্যায়তন আর পপুলার কালচারের ভুবনে ব্যাপক আগ্রহ জাগিয়েছে। ২০১০ সালে আইপ্যাড অ্যাপ হিসেবে এর রিলিজ হয়। তবে ‘ইউলিসিস’কে এখানেও অতীত পিছু ছাড়েনি। গ্রাফিক নভেলের মূল প্রকাশক থ্রোএওয়ে হর্সকে আইপ্যাড কর্তৃপক্ষ অ্যাপল কিছু অংশ সেন্সর করতে বলে। কারণ ওই সব অংশ অ্যাপলের ‘পলিসি অন নুডিটি’র খেলাফে যাচ্ছে। পরে অবশ্য সিদ্ধান্ত পাল্টেছে অ্যাপল। এখন কেউ কেউ ‘ইউলিসিস’কে বলছেন, ‘ডিজিটাল বাঁকবদলে আধুনিকতাবাদকে ফিরে দেখা।’
তিন অধ্যায়ে মুশকিল আসান
ইউলিসিস পড়তে গিয়ে নাকাল হওয়া পাঠকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু উপন্যাসটির দুর্বোধ্যতা, ভাষা আর ভাবনাকে প্রকাশ করার বহাল পদ্ধতিগুলোকে এর বুড়ো আঙুল দেখানোর কুখ্যাত সফলতা—সব মিলিয়ে এ বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবার কোনো কোনো পাঠক ঘুরপথে গন্তব্যে যাওয়ার উপায়ও খুঁজেছেন। প্রকাশের পর থেকেই এই তর্ক জারি আছে যে এই বিশাল বইয়ের সব কটি অধ্যায় পড়ার দরকার কী? এ বিষয়ে সমালোচকেরা একমত হতে পারেননি। আবার অনেক পাঁড় জয়েসভক্তও এ কথা মানেন যে ইউলিসিস–এর কয়েকটি অধ্যায় অন্যগুলোর চেয়ে হয়তো একটু কম জরুরি। এসব কারণেই হয়তো উপন্যাসটির একটা আনঅফিশিয়াল সংস্করণ আছে, যাকে বলা হয় ‘টিএলডিআর ভার্সন’। মানে ‘টু লং, ডিডন্ট রিড’—খুব লম্বা তাই পড়িনি। টিএলডিআর ভার্সনের মাধ্যমে আপনি পুরো বইয়ের মাত্র তিনটি অধ্যায় পড়েই ইউলিসিস পড়ার কাজ শেষ করে দিতে পারেন। এই অধ্যায় তিনটি হলো, ‘টেলেমেকাস’, ‘ক্যালিপসো’ ও ‘পেনেলোপে’। তবে সাবধান পাঠক! এটি স্পষ্টই ফাঁকিবাজির পথ। কিন্তু আশার কথা হলো, দুনিয়ায় আপনার চেয়ে অলস পাঠকও তো আছেন। তাঁদের আসরে গিয়ে এই তিন অধ্যায় পড়ার বদৌলতে আপনি নিশ্চয় বাজিমাত করে দিতে পারবেন যেকোনো দিন!