তাঁর হাত ধরেই যাত্রা শুরু

তিন দিন আগে প্রয়াত হয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও স্মৃতি: ১৯৭১ গ্রন্থমালার সম্পাদক রশীদ হায়দার। তাঁর সঙ্গে আসাদুজ্জামান নূরের ছিল দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। এ লেখায় রশীদ হায়দারের স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি।

রশীদ হায়দার (১৫ জুলাই ১৯৪১—১৩ অক্টোবর ২০২০)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক রশীদ হায়দার চলে গেলেন। বলতে গেলে নীরবেই চলে গেলেন, চিরকাল তিনি যেমন ছিলেন—একটু নিভৃতচারী, আত্মপ্রচারবিমুখ, নিজের কাজের প্রতি তন্নিষ্ঠ ও সৎ।

রশীদ ভাই বলে ডাকতাম তাঁকে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেওয়ার পরে। ১৯৭২-৭৩ সালের কথা। তাঁর অগ্রজ, লেখক–নাট্যকার, নির্দেশক জিয়া হায়দার ‘নাগরিক’–এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর সূত্র ধরেই রশীদ ভাই ‘নাগরিক’-এ যুক্ত হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে। যুক্ত হয়েছিলেন আরও দুই ভাই কবি মাকিদ হায়দার ও জাহিদ হায়দার। ১৯৭৩ সালে বাকি ইতিহাস নাটকের নিয়মিত মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় স্বাধীন বাংলাদেশে এক নবযাত্রার সূচনা করল। এর পরপরই নাগরিক–এর প্রযোজনা মলিয়ের নাটক অবলম্বনে বিদগ্ধ রমনীকুল ও রশীদ হায়দারের তৈল সংকট। বিরতির আগে তৈল সংকট ও বিরতির পরে বিদগ্ধ রমনীকুল। সম্ভবত এটিই রশীদ ভাইয়ের লেখা প্রথম মঞ্চনাটক।

যে সময়ের কথা বলছি তখন বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত। দেশটা নানা সংকটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছে। সে সময়ের বাস্তবতায় এটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে তখন ওই সব সংকটের মধ্যে সুযোগ নিচ্ছিল কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোরের দল। নানা সংকটের মধ্যে ছিল কেরোসিন তেলের সংকট। ঢাকায় ঘরে ঘরে সে সময় গ্যাস ছিল না। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের বাড়িতে রান্নার জন্য কেরোসিন তেল ব্যবহার হতো। আর সারা দেশে হারিকেন জ্বালানো থেকে শুরু করে রান্নাবান্নাসহ নানা কাজে কেরোসিন ছিল অপরিহার্য। রশীদ হায়দারের লেখা নাটকটা ছিল এই তেলের সংকট নিয়ে। একজন কেরোসিন তেলের ডিলার, তাঁর দোকানের সামনে কেরোসিন সংগ্রহের জন্য ক্রেতাদের লম্বা লাইন। কিন্তু কিছু ক্রেতা তেল পেতে না পেতেই ডিলার সাহেব ঘোষণা দিলেন, তেল শেষ। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল অপেক্ষমাণ জনতা। তারা হামলা চালাল এই অসৎ ব্যবসায়ীর দোকানে। ডিলার পালিয়ে গেলেন। উত্তেজিত জনতা দোকানের ভেতরে কেরোসিন তেল খুঁজতে থাকে। একদল ঢুকে পড়ে পাশের বাড়িতে। পাশের বাড়িতে থাকেন একজন গোবেচারা ভদ্রলোক। তাঁর খাটের নিচে দুটো কেরোসিন তেলের টিন পাওয়া যায়। সবাই ধরে নেয় যে এই লোক ডিলারের তেল লুকিয়ে রেখে তাঁকে সহযোগিতা করছেন। ফলে সবাই মিলে প্রহার করে মেরে ফেলে তাঁকে।

এই গোবেচারা ভদ্রলোকের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন দক্ষ, অভিজ্ঞ অভিনেতা আবুল হায়াত। তাঁর বিপরীতে তাঁর স্ত্রী হিসেবে অভিনয় করছিলেন সুলতানা কামাল। বেগম সুফিয়া কামালের কন্যা। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন এবং মায়ের মতোই তিনি নারী অধিকার আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। মহড়া চলত নির্দেশক আলী যাকেরের বাসায়। তাঁর বসার ঘর আমাদের মহড়াকক্ষ। তাঁর বাড়ি বলতে গেলে পুরোটাই নাগরিক–এর দখলে। মহড়া চলাকালে আরেকজন অভিনেতা বাদল রহমান, পরবর্তীকালে যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, মহড়াকালে অসাবধানতাবশত তাঁর ঘুষি লেগে আবুল হায়াতের নাক গেল ফেটে—রক্তারক্তি কাণ্ড, হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাঁকে। ঠিক দুদিন পরে নাটক। তাই সবার মুখে ঘোর অন্ধকার। সবচেয়ে বেশি অন্ধকার রশীদ ভাইয়ের মুখ। তাঁর লেখা নাটক প্রথম মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে। এ সময় নির্দেশক আলী যাকের সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকেই করতে হবে ওই চরিত্রটি। আমি তখন পালাতে পারলেই বাঁচি। রশীদ ভাই একটু বিচলিত। আমি কি পারব? আমি তো একেবারে নতুন, অনভিজ্ঞ। স্বাধীনতার আগে টুকটাক যা করেছি, সেগুলোকে একধরনের ঠেকা কাজ চালানো বলা যায়। আলী যাকের অর্থাৎ ছোটলু ভাই বললেন, নূর সব সময় প্রম্পট করে। ফলে সবার সংলাপ একমাত্র তারই কমবেশি মুখস্থ। নির্দেশকের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দুদিন টানা মহড়া চলল। কখনো সুলতানা কামালের বাড়ি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে, কখনো ছোটলু ভাইয়ের ড্রয়িংরুমে। যথাসময়ে নাটক মঞ্চস্থ হলো তৈল সংকট; এবং মোটামুটি উতরেও গেল। নাটক শেষে রশীদ ভাই এসে আমাকে বললেন, তুই ইজ্জত বাঁচিয়েছিস। রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে এর মধ্যে সম্পর্কটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তিনি আমাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেন। আর আমি ‘তুমি’ সম্বোধনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

রশীদ ভাই আশিতে পা রেখেছিলেন। আশি তাঁর পূর্ণ হলো না। এর আগেই তিনি বিদায় নিলেন। একুশে পদক পেয়েছেন, স্বাধীনতা পদক পাওয়ার সব যোগ্যতা তাঁর ছিল।

এরপর রশীদ ভাই আর কোনো মঞ্চনাটক লিখেছেন বলে জানা নেই। কিন্তু মঞ্চে অভিনয় করেছেন কয়েকবার। তবে অভিনয় তাঁকে খুব বেশি টানেনি। আজ এই মুহূর্তে বেশি করে মনে পড়ছে সেই দিনগুলোর কথা। নাটক নিয়ে কী উত্তেজনা আমাদের মধ্যে, কী প্রবল আড্ডা! সেই আড্ডার বিষয় রাজনীতি, শিল্প–সাহিত্য, আবৃত্তি থেকে শুরু করে প্রেম, পরচর্চা—কোনো কিছুই বাদ থাকত না। রশীদ ভাই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন, তুলনামূলকভাবে কম সরব থাকতেন। কিন্তু উপভোগ করতেন। মঞ্চে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল রশীদ ভাইয়ের নাটক দিয়ে। আজও সে যাত্রা অব্যাহত। রশীদ ভাই, তোমাকে ধন্যবাদ।

রশীদ ভাই তখন বাংলা একাডেমিতে কর্মরত। ব্যস্ততা ক্রমাগত বাড়ছে। গল্প, উপন্যাস লিখছেন একটানা। ফলে নাগরিক–এর সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হতে শুরু করল। হঠাৎ হঠাৎ চলে আসতেন মহড়ায়। আবার হয়তো বেশ কিছুদিন দেখা নেই। একদিন আমাকে ফোন করে বললেন, নূর, একটা ছেলেকে পাঠাচ্ছি। নাম যুবরাজ। ভালো গান গায়। অভিনয়ে খুবই আগ্রহ। এভাবেই যুবরাজের নাগরিক-এ আসা। পরবর্তী সময়ে সেই যুবরাজই খালেদ খান নামে সমধিক পরিচিত হয়েছিলেন এবং মঞ্চনাটক ও টেলিভিশনে একটি বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছিলেন। দুঃখ, তাঁকে আমরা অকালে হারিয়েছি।

অসংখ্য ছোটগল্প, উপন্যাস, শিশুতোষ কাহিনির পাশাপাশি রশীদ ভাই যে অসাধারণ কাজটি করেছেন তা হলো মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার–আলবদরদের ভয়াবহ হত্যা আর নির্যাতনের নিষ্ঠুর কাহিনির সংগ্রহ ও তাঁর গ্রন্থনা। এ এক বিশাল এক কাজ। পাশাপাশি করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ। এটিও একটি অনন্য গ্রন্থ। বদলা দরকার, এই কাজগুলো যখন তিনি করছিলেন, তখন সময় আমাদের বিরুদ্ধে ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রশীদ হায়দারের ধমনিতে বহমান ছিল বলেই তাঁর গল্প–উপন্যাসে এর নিয়ত প্রতিফলন দেখেছি আমরা। তিনি আপসহীন মানসিকতায় উদ্দীপ্ত ছিলেন সর্বদাই। মনে পড়ে, তখন আমরা বিরোধী দলে। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে মঞ্চ তৈরি করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সম্ভবত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান। আমি সে সময় দলের প্রচার সম্পাদক। রশীদ ভাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম বক্তব্য দেওয়ার জন্য। এখনকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন। সেদিন রশীদ ভাই অসাধারণ বক্তব্য দিলেন। ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে তুলে আনলেন নরপশু পাকিস্তানি বাহিনী আর রাজাকার–আলবদরদের নৃশংসতার কাহিনি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মর্মস্পর্শী বিবরণ। সব শুনে সভাস্থল নিস্তব্ধ। অনেকের চোখে পানি। সবাই–ই চোখ মুছছেন। সভা শেষে শেখ হাসিনা রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললেন, প্রশংসা করলেন। আমাকে বললেন, ‘তাঁকে বিভিন্ন সভায় বেশি বেশি করে আমন্ত্রণ জানান। এসব কথা সবাইকে আরও বেশি করে জানানো প্রয়োজন।’

বাংলা একাডেমিতে জীবনের দীর্ঘ এক গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করেছেন রশীদ হায়দার। তাঁকে কখনো দেখিনি বাংলা একাডেমি আয়োজিত স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে বক্তব্য দিতে। কারণ আমার অজানা।

রশীদ ভাই আশিতে পা রেখেছিলেন। আশি তাঁর পূর্ণ হলো না। এর আগেই তিনি বিদায় নিলেন। একুশে পদক পেয়েছেন, স্বাধীনতা পদক পাওয়ার সব যোগ্যতা তাঁর ছিল। তবে পুরস্কারই শেষ কথা নয়। লাখ লাখ পাঠক—মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যাঁদের হৃদয় উদ্ভাসিত—তাঁর লেখা পড়বেন, তাঁর গবেষণা আরও নতুন গবেষণার জন্ম দেবে।

আর আমার মতো ক্ষুদ্র এক নাট্যকর্মী কৃতজ্ঞচিত্তে তোমাকে স্মরণ করবে রশীদ ভাই, সর্বদাই। তোমার নাটক দিয়েই তো মঞ্চে আমার যাত্রা শুরু, যে যাত্রা আমার জীবনটাকেই বদলে দিল। তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর গভীর ভালোবাসা, রশীদ ভাই।