তারাদের তাড়া করা

কিংবদন্তি বা তারকাদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয় একজন ক্রীড়া সাংবাদিকের। কখনো অনেক ঘুরেও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা, কখনো আবার অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আরাধ্য খেলোয়াড়ের নাগাল পাওয়া—স্মৃতির সরণিতে জমা হওয়া সেসব গল্পের কয়েকটি।


নববধূর তাড়া
‘কখন রওনা দেবে?’—টুং করে ফোনটা বেজে উঠতেই দেখি বউয়ের খুদে বার্তা। কখন যে রওনা দেব, সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। হোটেল র‌্যাডিসনের লবিতে অধীর অপেক্ষায় আছি। রিচি রিচার্ডসন সময় দিয়েছেন বেলা একটায়।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে রিচার্ডসন ঢাকায় এসেছিলেন আফগানিস্তান সিরিজের ম্যাচ রেফারি হয়ে। আইসিসির ম্যাচ রেফারি বা আম্পায়ার কেউ সিরিজ চলাকালে সাক্ষাৎকার দেন না। দিলেও আইসিসির অনুমতি নিতে হয়। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আইসিসির মিডিয়া বিভাগের সঙ্গে প্রায় হাফ ডজন মেইল (এর মধ্যে প্রশ্নপত্রও পাঠাতে হয়েছে) চালাচালি শেষে সবুজ সংকেত মিলল, আফগানিস্তান সিরিজ শেষের পরের দিন হোটেল র‌্যাডিসনে ঠিক বেলা একটায় সময় দেবেন ক্যারিবীয় কিংবদন্তি। সমস্যাটা হলো, একই হোটেলে উঠেছে ইংল্যান্ড দলও। হোলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় সেবার ইংলিশদের বাংলাদেশ সফর নিশ্চিত করতে অনেক বেগ পেতে হয় বিসিবির। কঠোর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেয়ে তবেই ইংল্যান্ড আসে। স্বাভাবিকভাবেই হোটেল ঘিরে ফেলা হয় নিরাপত্তার কঠিন বলয়ে। একেকটা বলয় ভেদ করে হোটেল লবিতে যাওয়াই হয়ে দাঁড়াল বিরাট চ্যালেঞ্জিং কাজ। কঠিনেরে যখন ভালোইবেসেছি, এ চ্যালেঞ্জ উতরানো আর কী!

লবিতে অপেক্ষার প্রহর গুনছি আর একটু পরপর বউয়ের মেসেজ পাচ্ছি, ‘কিছু তো বলছ না!’ বিয়ে করেছি ২০ দিন হয়েছে। বিয়ের এক দিন পরই তাকে বাবার বাড়িতে রেখে চলে এসেছি আফগানিস্তান সিরিজ কাভার করতে। এখন আবার শুরু হতে যাচ্ছে আলোচিত ইংল্যান্ড সিরিজ। এভাবে বাবার বাড়িতে রেখে আসায় নববধূকে নাকি সমাজের নানা কথা হজম করতে হচ্ছে! তাকে তাই ঢাকায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বসকে বলে কোনোমতে একটা দিনের ছুটি নিয়েছি। বস এক দিনের ছুটি দিয়েছেন কয়েকটি শর্তে: রিচার্ডসনের ইন্টারভিউ শেষে ইংল্যান্ড দলের সংবাদ সম্মেলনে কাভার তো করতেই হবে; ইংল্যান্ড সিরিজের বিশেষ সংখ্যায় তামিম ইকবালকে নিয়ে ফিচার লিখে তবেই যেতে হবে। সব লেখা শেষ করে বাস ধরতে ধরতে বেজে গেল রাত ১০টা। বাড়িতে সাকল্যে পাঁচ ঘণ্টা থেকে আবার পড়িমরি করে ফিরতে হলো ঢাকায়।

কার্টলি অ্যামব্রোসের ইন্টারভিউ নিতে পোহাতে হলো অনেক হ্যাপা। ছবি: সংগৃহীত
কার্টলি অ্যামব্রোসের ইন্টারভিউ নিতে পোহাতে হলো অনেক হ্যাপা। ছবি: সংগৃহীত

আইসিসির ‘শাস্তি’
রিচার্ডসনের সাক্ষাৎকার পেয়ে বড় ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম আইসিসির মিডিয়া বিভাগকে। কে জানত, তিন বছর পর এ আইসিসিই আবার ‘শাস্তি’ দেবে আরেক উইন্ডিজ কিংবদন্তির সাক্ষাৎকার নেওয়ার ‘অপরাধে’! গত বিশ্বকাপের ঘটনা। টন্টনে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ উপলক্ষে সেদিন সমারসেট কাউন্টি ক্লাব মাঠে বসেছে কিংবদন্তির মেলা! ক্লাইভ লয়েড, অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, কার্টলি অ্যামব্রোস, ইয়ান বিশপরা চোখের সামনে! সাংবাদিক হিসেবে সাক্ষাৎকারের লোভে চোখটা চকচক করে উঠেছে। গার্নার-রবার্টসের পিছু নিয়ে লাভ হয়নি, তাঁরা চলে গেছেন ভিআইপি বক্সে। লয়েড আইসিসির দূত হিসেবে আছেন বিশেষ বক্সে। বিশপ চুটিয়ে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ধারাভাষ্য কক্ষে। এখানে তুলনামূলক সহজতম লক্ষ্য হচ্ছেন অ্যামব্রোস। রেডিও কমেন্ট্রির ফাঁকে ফাঁকে তিনি পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসছেন প্রেসবক্সে। তক্কে তক্কে আছি কখন প্রেসবক্স থেকে বের হবেন সাবেক এ ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার। একবার তাঁকে বের হতে দেখেই পিছু নেওয়া। অ্যামব্রোসকে পাওয়া গেল ওয়াশরুমে! জলবিয়োগ জরুরি না হলেও তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যেতে হলো। বিয়োগকর্ম শেষে তাঁকে পটানো শুরু করতেই হেসে উঠলেন, ‘ওয়াশরুমে কি সাক্ষাৎকার দেওয়া যায়?’

তা যায় না, কোথায় দেবেন, সেটি যদি বলতেন...অ্যামব্রোস কিছু না বলে রহস্যের হাসি হাসলেন। খানিক পরে অ্যামব্রোসকে আবিষ্কার করলাম প্রেসবক্সের নিচে কফিশপের খোলা জায়গাটায়। মুহূর্তেই তাঁকে ঘিরে ধরলেন দু-তিনজন বাংলাদেশি টিভি রিপোর্টার। আড্ডার মেজাজে অ্যামব্রোস সাক্ষাৎকার দিলেন সেখানেই। যেহেতু টিভি সাংবাদিকেরা আছেন, এ সুযোগে মুঠোফোনে একটু ভিডিও ফুটেজও নিয়ে রাখলাম। আর তখনই হা-রে-রে করে তেড়ে এলেন আইসিসির ভেন্যু মিডিয়া ম্যানেজার। তাঁর যুক্তি, যতই কফিশপের বারান্দা হোক, স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে ম্যাচ চলার সময় ভিডিও করা যাবে না! বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন, আগের দুটি ভেন্যুতে গ্যালারির বাইরে ভিডিও করলে কেউ কিছু তো বলেনি, আর দর্শকেরা গ্যালারিতে ইচ্ছেমতো ভিডিও করছে, কেউ তো বাধা দিচ্ছে না! কোনো যুক্তিতেই কাজ হলো না। আইসিসির চোখে এটা ভুল। আর এ ভুলের মাশুল হিসেবে নটিংহামে বাংলাদেশের পরের ম্যাচে (অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে) প্রায় ১৫ জন সাংবাদিকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকও প্রেসবক্সে বসার অনুমতি পেলেন না। অগত্যা প্রেসবক্সের নিচের গ্যালারিতে বসে কাভার করতে হলো ম্যাচটা।

মেহেদী হাসান মিরাজ। ফাইল ছবি
মেহেদী হাসান মিরাজ। ফাইল ছবি

মিরাজের জমি
২০১৬ সালের অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট জিতিয়ে মেহেদী হাসান মিরাজ চলে এসেছেন আলোচনার কেন্দ্রে। মিরপুর টেস্ট জয়ের পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল বসের ফোনে, ‘মিরাজ কখন খুলনায় যাবে, খোঁজ নিন। ওর ফ্লাইটের সঙ্গে মিলিয়ে আপনার টিকিট কাটা হবে। ঢাকা থেকে খুলনা—ওর পুরো যাত্রাটা খুব কাছ থেকে দেখে লিখতে হবে।’ দুই ঘণ্টার মধ্যে সব আয়োজন করা হলো। সন্ধ্যার ফ্লাইটে ‘বিস্ময় বালকে’র সফরসঙ্গী হয়ে রওনা দেওয়া হলো খুলনায়। বাংলাদেশের যে কজন ক্রিকেটার আর্থিক সীমাবদ্ধতা জয় করে উঠে এসেছেন, মিরাজ তাঁদের অন্যতম। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের নায়ক হয়ে যখন খুলনার খালিশপুরে তাঁর দোচালা টিনের ভাড়া বাসায় ফিরলেন, মানুষের ভিড়ে যেন তাঁদের পুরো ঘরটাই ভেঙে পড়ার উপক্রম! মিরাজ যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেন, থাকেন পাঁচতারকা হোটেলের চাকচিক্যময় পরিবেশে, আর মা-বাবার কাছে ফিরলে থাকেন দোচালা টিনের ঘরে! এ বৈপরীত্য নিয়েই লেখা হলো একটি প্রতিবেদন। সেদিনই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ দলের তরুণ এই অলরাউন্ডারের পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণের নির্দেশ দিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। ২০১৭ সালে খালিশপুরে তাঁর জন্য তিন কাঠা জমি বরাদ্দ দিল খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। মিরাজ মাঝেমধ্যেই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘প্রথম আলোকে ধন্যবাদ ওই প্রতিবেদনটার জন্য।’

সাকিব আল হাসান। ছবি: অন্য আলো
সাকিব আল হাসান। ছবি: অন্য আলো

সাকিবের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ
২০১৮ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট সিরিজ বাজেভাবে হারের পর গায়ানায় সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের শুরুটা হয় দুর্দান্ত। ৯৭ রান করে ম্যাচের নায়ক সাকিব আল হাসান। ম্যাচের পর বাঁহাতি অলরাউন্ডার আসেননি সংবাদমাধ্যমের সামনে। রাতে তাঁর সঙ্গে কথা হলো মুঠোফোনে। সাংবাদিকের সঙ্গে ‘অসময়ে’ বাবার কথা বলাটা বোধ হয় ভালো লাগেনি না আলাইনার! মেয়েকে শান্ত করতেই সাকিব বললেন, ‘এখন কথা বলা কঠিন, কাল (পরের দিন) দুপুরে টিম হোটেলে চলে আসেন।’ নির্ধারিত সময়ে গিয়ে দেখি সাকিব সুইমিংপুলের পাশে সপরিবারে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন। ‘আমার সঙ্গে আপনিও যোগ দিতে পারেন, আমি এত খাব না’, খাবার খেতে খেতেই নেওয়া হলো সাকিবের চমৎকার এক সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার প্রাপ্তির পর মনটা যখন খুশিতে ডগমগ, খানিক পরেই সেটিই চুপসে গেল ফাটা বেলুনের মতো। গায়ানা থেকে কিছুতেই পরের ভেন্যু সেন্ট কিটসে যাওয়ার বিমান টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না! কী যে আফসোস হচ্ছে তখন গায়ানিজ সাংবাদিকটির কথা মনে পড়ে। সেন্ট কিটসের টিকিট কেটে দেবে বলেই দুপুরে আমার হোটেলে এসেছিলেন তিনি। সাকিবের সাক্ষাৎকার পাওয়ার আশায় গায়ানিজ সাংবাদিককে সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছি। নিশ্চয়ই জানেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যেতে বিমানযাত্রাই ভরসা। নির্ধারিত তারিখের বিমান টিকিটই যদি না পাওয়া যায়, পরের ম্যাচ কাভার করব কীভাবে? কী যে এক অসহায়ত্ব পেয়ে বসল। এমন জটিল সফরের অভিজ্ঞতা আগে না থাকার মাশুল এভাবে গুনতে হবে! ভীষণ টেনশনেই কাটতে থাকল সময়। সফরসঙ্গী দুই স্বদেশি সাংবাদিক নানাভাবে সান্ত্বনা দিলেন। এগিয়ে এলেন ধারাভাষ্যকর আতহার আলীও। অনেক চেষ্টার পর একটা ব্যবস্থা হলো। সম্প্রচার দলের বাংলাদেশি ব্যবস্থাপক তানভীর আহমেদ প্রায় তিন গুণ দামে তাঁদের ভাড়া করা বিমানের একটি টিকিট ব্যবস্থা করলেন, যেটিতে সওয়ার হয়ে সেন্ট কিটসে যাবে বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলও। স্নায়ুর ওপর দিয়ে বড় ঝড় গেলেও শেষ পর্যন্ত অসাধারণ এক বিমানযাত্রার গল্পই হয়ে রইল সেটি। দুই দলের সঙ্গে বিমানযাত্রার অভিজ্ঞতা ছাপা হলো প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়।

মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: অন্য আলো
মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: অন্য আলো

মাশরাফির সঙ্গে বিষণ্ন বিকেল
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ সামনে রেখে খুলনায় বাংলাদেশ দল শুরু করেছে বিশেষ ট্রেনিং ক্যাম্প। এ কন্ডিশনিং ক্যাম্প কাভার করতে একটু আগেভাগেই যেতে হলো খুলনায়। সেখানে পৌঁছানোর এক দিন পরই মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরের দিন মাকে হাসপাতালে রেখে কিছুতেই আসতে মন টানছিল না মাঠে। কিন্তু আগে থেকে মাশরাফির সঙ্গে কথা হয়েছে, বিকেলে স্কিল ট্রেনিং শুরুর আগে সময় দেবেন তিনি। হাসপাতালে মাকে কোনোভাবে বুঝিয়ে এলাম মাঠে। মাশরাফিকে পাওয়া গেল পড়ন্ত বিকেলে। দিনের মরে আসা আলোয় মাশরাফি কথায় কথায় শোনালেন প্রয়াত ক্রিকেটার, তাঁর বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানার গল্প, যাঁর বাড়ি স্টেডিয়াম থেকে হাঁটা দূরত্বে। মাশরাফির মুখে মানজারুলের গল্প, হাসপাতালে অসুস্থ মা আর দিনের নিভু নিভু আলো—বিকেলটা বড় বিষণ্ন লাগল। বুকের মধ্যে তৈরি হলো অদ্ভুত এক হাহাকার। মাশরাফির লেখাটা লিখে রাতে যখন হাসপাতালে গিয়েছি, মায়ের বেদনাক্লিষ্ট মুখটার দিকে আর তাকাতে পারি না। তখনো অফিসকে জানাইনি যে এত বড় একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সিদ্ধান্ত নিলাম, পরের দিন অফিসকে জানিয়ে ছুটি নেব।

কিন্তু সেই ছুটি আর নেওয়া হয়নি, মা-ই আমাদের জীবন থেকে ছুটি নিয়ে পরের দিন ভোরে চলে গেলেন অন্য লোকে।