বইমেলা হোক

অতঃপর এসেছে বইমেলা শুরুর ঘোষণা। শুরু হয়ে গেছে বইপ্রেমীদের উত্তেজনা। সবাই উন্মুখ হয়ে আছেন বইমেলার প্রতীক্ষায়

শাকুর মজিদের তোলা আশির দশকের বইমেলার চিত্র এবং আবদুস সালামের তোলা এই সময়ের বইমেলারছবি অবলম্বনে মনিরুল ইসলামের গ্রাফিকস

অনেক বিতর্ক আর কথাবার্তার পর মার্চের ১৮ তারিখ থেকে বাংলা একাডেমির বইমেলা শুরু হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিতর্কটা যে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল, এই ঘোষণায় আপাতত তার অবসান হলেও কিছু উদ্বেগ তো থেকেই যাবে। মহামারি তখনো বিদায় হবে কি না, তা এক্ষুনি বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা আশা করতেই পারি, এই কোভিড জন্তুর লেজটাও যেন না থেকে যায়, যেন এর অপস্রিয়মাণ পিঠটাই মার্চের শুরুতে আমরা দেখতে পারি।

আমরা শুনেছি, এ বছর কলকাতা বইমেলা হবে না, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সেখানে এতটা বিতর্ক তৈরি করেনি। পশ্চিমবঙ্গের বইপ্রেমীরা এটা মেনে নিয়ে সামনের বছরের দিকে তাকিয়ে আছেন—তাঁরা জানেন, মহামারির আপদ না গেলে মেলা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটা হুমকিই হয়ে দাঁড়াবে বরং। কলকাতার বইমেলা একটা বড় মাপের সাংস্কৃতিক আয়োজন, এর জন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকে, কিন্তু এই মেলা নিয়ে তাদের সেই আবেগ নেই, যা বাংলা একাডেমির মেলা নিয়ে আমাদের আছে। বইমেলা নিয়ে বিতর্কটা এই আবেগের ইতিহাসেই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

একুশে ফেব্রুয়ারির আবেগ, অভিঘাত, দ্রোহ ও স্মৃতির সঙ্গে বাংলা একাডেমি বইমেলার এমন একটা ঘনিষ্ঠ সংযোগ তৈরি হয়ে গেছে যে পেছন ফিরে তাকালে আমাদের মনেই পড়ে না এই মেলা শুরু হয়েছিল বায়ান্নর বেদনার আর মহিমার ওই দিনের দুই যুগের পরে। একুশের শহীদদের স্মরণে প্রথম যে ইটের মিনারটি তৈরি হয়েছিল, সেটি দ্রুতই ভেঙে ফেলা হয়। দ্বিতীয়টিও ভেঙে ফেলা হয়েছিল একাত্তরে, কিন্তু এরপর মাথা তুলে দাঁড়ানো শহীদ মিনারটি তার অসাধারণ স্থাপত্যে ওই দিনটিকেই তো প্রতিদিন বাঙ্​ময় করে তোলে। ইতিহাসের অনেক ঘটনার প্রতীকী রূপায়ণ নানাভাবে আমাদের প্রতিদিনের চিন্তায় স্থান করে নিয়েছে। বইমেলাটিও সে রকম।

মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা যখন এই মেলা শুরু করেন, সত্তর দশকের শেষে, এর পেছনে তাঁর একটা উদ্দেশ্য ছিল এবং তা শুধু বই বিক্রি করা নয়, বরং ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পাঠকদের, বিশেষত তরুণদের সচেতন করা। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শোকের ঘটনাটি ঘটেছে ১৯৭৫–এর আগস্টে, তারপর নভেম্বরে ঘটেছে আরেক হৃদয়বিদারক হত্যাযজ্ঞ। এরপর দেশটা যেন হঠাৎ করেই উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করল। বেশ কিছু মানুষের—যাদের হাতে ক্ষমতা ছিল বাস্তবতাকে পাল্টে দেওয়ার—চিন্তাভাবনায় পাকিস্তানের জন্য জেগে ওঠা নস্টালজিয়া আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনচর্চায় একটা বিরুদ্ধ অভিঘাত রাখতে শুরু করল। অল্প পরিসরের, ঘরোয়া মেজাজের, অন্তরঙ্গতায় মোড়া বইমেলাটি ছিল তরুণদের মন জাগানোর একটি ডাক। আমাদের মনোজগতে যাতে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা ছায়া ফেলতে না পারে, আমরা যেন সংস্কৃতি থেকে শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারি, তার একটা আহ্বান।

চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে দু–একবার বইমেলা নিয়ে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আমাকে তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলার মেলা ও আড়ংয়ের ঐতিহ্যটাও একই সঙ্গে তুলে আনার ইচ্ছা তাঁর ছিল। আমাদের চিরকালীন মেলাগুলো শুধু বেচাকেনার জন্য তাদের পসরা সাজিয়ে বসত না, বরং একটা উত্সবের আমেজ দিয়ে মানুষকে একে অপরের সঙ্গে মেলাত। ‘মেলা’ শব্দটিতে এই বহুজনের এক হওয়ার—সব জাতপাতের মিলিত হওয়ার একটা ইঙ্গিত আছে।

শুরুতে বইমেলা তার অনাড়ম্বর আয়োজন এই মিলনের বিষয়টি নিশ্চিত করত। এখানে কবি–সাহিত্যিকেরা আসতেন, পাঠকেরা আসতেন, তরুণ শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী—সবাই আসতেন। কামরুল হাসান অল্প পয়সায় তাঁর ছবি তুলে দিতেন মেলায় আসা মানুষজনের হাতে। এই মেলায় আমি আহমদ ছফা ও এস এম সুলতানের পাশে বসে তাঁদের কথাবার্তা শুনেছি। সংস্কৃতি নিয়ে ফয়েজ আহ্​মদ আর কামাল লোহানীর আলাপ শুনেছি। অজানা কোনো বাঁশিবাদকের একান্ত পরিবেশনা শুনেছি। মেলার নানা রূপান্তরও প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলা একাডেমি মেলা আয়োজনের দায়িত্ব নেওয়ার পর এর শ্রীবৃদ্ধি আমার চোখের সামনে ঘটেছে। একসময় বইমেলা তার প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সামনের রাস্তায় চলে গেলে এই অংশটিকে ছোটখাটো একটা বাণিজ্য মেলার আদল পেতেও দেখেছি। তারপর রাস্তা ডিঙিয়ে মেলাটি যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে গেল, সেই মুহূর্তটিরও আমি সাক্ষী ছিলাম।

আমার সব সময় মনে হয়েছে, বইমেলা যত না বই বিক্রির মেলা, তার চেয়ে বেশি বই পড়ার চর্চা, আমাদের সংস্কৃতির অখণ্ডতা—এবং সবচেয়ে বেশি যা—একুশের আবেগ আর বাঙালির মনোজগতে এর শিক্ষাগুলো স্থান করে দেওয়ার প্রতি আমাদের সম্মতি ও অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠার একটা আয়োজন। প্রথম উদ্দেশ্য অর্জনে মেলাটি সফল। প্রতিবছর এতে বই বিক্রি বাড়ছে, বই নিয়ে আলোচনা–সমালোচনাও বাড়ছে; কিন্তু দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি যেহেতু পরিমাপযোগ্য নয়, আমরা নিশ্চিত নই এর সফলতা আসলে কতটা। মেলায় যত মানুষ আসেন, তাঁদের একটা বড় অংশই আসেন বিনোদনের জন্য—যে অর্থে বিনোদন বিষয়টিকে সমাজ, এবং সমাজকে একই সঙ্গে যা বিম্বিত করে এবং ওই নির্দিষ্টভাবে বিম্বিত হতে প্রভাবিত করে, অর্থাৎ সর্বতোগামী মিডিয়া সংজ্ঞায়িত করে। অনেকেই একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত। কিন্তু আমি অনুভূতি-ভালোবাসা-সচেতনতা ইত্যাদির হদিস করতে গিয়ে সংখ্যার গুরুত্বকে বিবেচনায় আনি না। প্রতিদিন মেলায় আসা মানুষের মধ্যে এক শ জনও যদি মনের ভেতর শুভ আর সুন্দরের তাগিদটাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন, আমি ধরে নেব, মেলাটি সফল, পরিসংখ্যানবিদেরা যা-ই বলেন না কেন। এটি যে হচ্ছে, আমি তা বুঝতে পারি।

মেলায় যাওয়া গত ১০-১২ বছর তেমন হয় না—সাকল্যে তিন–চার দিন হয়তো যাই, কিন্তু বুঝতে পারি, বিনোদনের বাইরেও সুস্থতাপ্রত্যাশী অনেক মানুষ মেলায় আসেন। তাঁরা একুশের উত্তরাধিকার কিছুটা হলেও ধারণ করেন।

গতবার পর্যন্ত মেলা যথারীতি চলেছে এবং মুজিব বর্ষ সামনে রেখে জমজমাট ছিল। এনামুল করিম নির্ঝরের সৃজনচিন্তায় মেলার অবয়ব একটা সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হয়েছিল। প্রকাশকদের মুখে চওড়া হাসি দেখা দিয়েছিল। মেলার আয়োজনটাও ছিল সুশৃঙ্খল। কিন্তু মেলা শেষের তিন সপ্তাহও গেল না, কোভিডের ছোবলে রক্তাক্ত হলো বিশ্ব, বাংলাদেশের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল। তারপর তো মানুষের একান্ত সব বুদ্​বুদে ঢুকে পড়া, স্বজন হারানোর কান্না, বেদনার নীল ইতিহাস রচিত হওয়ার পালা।

কোভিড আমাদের নিঃস্ব করেছে, শিক্ষা, সংস্কৃতির সক্রিয়তা, মেলামেশা, সামাজিকতা—সবকিছু থেকে দূরে নিয়ে গেছে। প্রায় একটা বছর শিক্ষাকে আমাদের শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছে। বাস্তবের কৃত্যগুলো এখন চলে গেছে অলীক এক জগতে, ইন্টারনেট লালিত ‘সাইবার পৃথিবী’ নামক এক ভার্চ্যুয়াল বাস্তবে। ফেব্রুয়ারি যতই এগিয়ে এসেছে, প্রশ্ন উঠেছে, সবকিছু ভার্চ্যুয়াল বাস্তবে ঠেলে দেওয়া হলে কেন বইমেলাকেও নয়? বইমেলা কেন প্রতিবছরের মতো বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে?

এ নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে বিতর্ক জোরদার হয়েছে। প্রকাশকেরাই প্রধানত পক্ষে ছিলেন শুরুতে। পরে পাঠকসমাজের একটি অংশ তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বিপক্ষে ছিলেন পাঠক ও সুধী সমাজের অনেকেই। আয়োজকেরা অর্থাৎ বাংলা একাডেমি, ছিল মাঝামাঝি। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনি কোন দিকে, আমি আমার ছেলেবেলার শহর সিলেটের এক পাড়া-মুরব্বি এবং রসিকজনের মতো (আমাদের বন্ধুদের মতবিরোধ হলে যিনি রেফারির ভূমিকায় নেমে একটা সমাধান দিতেন) বলেছি, ‘ইবাইদি আছি, হবাইদিও আছি’। ইবাইদি, অর্থাৎ যাঁরা আপত্তি জানাচ্ছেন, তাঁদের দিকে। আমি জানতাম, যত দিন কোভিড অতিমারির ভয় দূর হবে না, যত দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে, তত দিন মেলা হতে আমার আপত্তি থাকবে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, বিজ্ঞানের কথা শুনে চললে উপকার হয়, এটা মানি। সে জন্য বলেছি, জনস্বাস্থ্য এবং অতিমারি বিশেষজ্ঞরা যে মত দেবেন, সে মত আমাদের মান্য করা উচিত।

আবার প্রকাশকদের যুক্তিটাও আমি বুঝি। একটা আস্ত শিল্প এ দেশে টিকে আছে অনেকটাই ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক বিক্রি-বাট্টার ওপর। এক বছরের ক্ষতি পোষানোর মতো স্বাস্থ্য এ শিল্পের নেই। এরা শুরু থেকে বলছিলেন, ফেব্রুয়ারিতে না হলে মার্চে মেলা হোক। প্রয়োজন হলে ১৭ মার্চ থেকে। এপ্রিলে কালবৈশাখীর ভয়টা থাকে, তারপরও। তাঁরা আরও বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী মেলা করা সম্ভব। যুক্তি দেখিয়েছেন, যদি মধ্য মার্চের মধ্যে কোভিড দুর্বল হয়, দৈনিক আক্রান্তের পরিসংখ্যান এক বা দেড় শতাংশে নেমে পড়ে, তাহলে সেটি সম্ভব।

যাঁরা মহামারি শেষ না হলে বইমেলার আয়োজন করা উচিত নয় বলে মত দিয়েছেন, অর্থাৎ যাঁরা বিতর্কের ‘ইবাইদি’–তে ছিলেন, তাঁরা বিজ্ঞানের কথাটাই বলেছেন। আমি আশা করি, মার্চের শুরুতে, ভ্যাকসিন সবার জন্য সহজলভ্য না হলেও মহামারির ভয় থাকবে না, এবং তাঁরাও মেলায় নিরুদ্বেগভাবে অংশগ্রহণ করবেন।

এ লেখার শিরোনাম ‘বইমেলা হোক’। এটি আমার কোনো দাবি নয়, সমাপ্ত কোনো বাক্যও নয়। এটি একটি আশাবাদী বাক্যের শুরুটা মাত্র। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশ নামের অদম্য দেশটি—১৯৭১–এর মার্চের আগেও যে দেশ স্বাধীন হবে, কেউ তা ভাবতে পারেনি, যে দেশ তলা হারানো ঝুড়ির অপবাদ গায়ে মেখে দারিদ্র্যে আর হতাশায় তলিয়ে না গিয়ে এর সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বের অর্থনীতির ২৫তম শক্তি হিসেবেই বরং দাঁড়িয়ে গেছে—অতিমারি-অন্তে আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

এবারের বইমেলা হোক সেই পর্যায়টির সবচেয়ে সুন্দর প্রতীকী উদ্বোধন।