বলিহারি সর্দিকাশি

ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ফ্লু এ নয়। সামান্য সর্দিজ্বরও এখন সর্বজনমান্য। অমান্য করে পাছে পস্তাতে হয়, এই আতঙ্ক আজ প্রামাণ্য হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে।

বলা বাহুল্য, দু-চারটে হাঁচি-কাশিও এখন আর নির্দোষ নয়। ‘যাহা দিলাম উজাড় করিয়াই দিলাম’—বাঙালি ওই হাঁচিটাই উজাড় করে দেয়। এ ক্ষেত্রে কন্ট্রোল তার কোনোকালেই ছিল না। এ কালে এসে তাকেও কিনা হিসাব কষে হাঁচতে হচ্ছে!

কারণ কী?

কারণ ওই একটাই। হাঁচি-কাশিই এখন ক্লু। রোগীর কেস স্টাডিতে কোল্ড হিস্ট্রিই ধর্তব্য। স্মর্তব্য সৈয়দ মুজতবা আলী। জার্মান প্রবাদ যতই বলুক ‘ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তাহে’, সেই পরাক্রমশালী জাতিও আজ পর্যুদস্ত। উদয়াস্ত চলছে টিকে থাকার চেষ্টা।

মাথায় গোবর, পরীক্ষায় গোল্লা, প্রেমে ব্যর্থতা, অপ্রেমে হল্লা, বাতের ব্যথা, দাঁতে পোকা, বাজারে আগুন, ঘরে অশান্তি, বাইরে ধুলা-ময়লা-জ্যাম-প্যাঁ-পুঁ, হাটে চোরাকারবারি, মাঠে কোন্দল-মারামারি, ঘাটে ঘাটে ঘুষ, ঘোষ নীতিবাক্য, অঘোষ মানবিকতা, কথকতার রাজনীতি—সব দেখেশুনে খেপে গিয়ে এত দিন যারা হররোজ বলতেন, ‘এর চেয়ে শালা মরে যাওয়াই ভালো!’ তারাও এখন ইমিউনিটি বিল্ড-আপে ব্যস্ত।

ইতিহাস বলে, যোগ্যতমরাই টিকে থাকেন। থুতনির নিচে মাস্ক বেঁধে অনেকে সেই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে কসুর করছেন না। মশহুর যাঁরা, তাঁদের তরিকা ভিন্ন। দিন কি রাতে সাঁঝ-প্রভাতে তাঁরা লাইভে আসছেন। সেলফিতে আর কুলাচ্ছে না। নিও নরমাল বলে কথা! ঘরে ঘরে আজ উপস্থাপক। ‘কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে’... তাঁরা ফেসবুককে পাথর ঠাওরাচ্ছেন। এঁদের অধিকাংশই ভদ্রপল্লির বাসিন্দা, স্বেচ্ছাগৃহবন্দী এবং চূড়ান্ত শৌখিন। তাঁরা ঘর হতে দুই পা ফেললে অন্তত এটুকু দেখতে পেতেন, কোথাও কোনো ভয় নেই। ভয়ের ভানটুকু শুধু তাঁদের মধ্যেই আছে।

তবু জীবন যাচ্ছে কেটে মাস্ক, মাল্টা আর মাল্টি ভিটামিনে। হাতে হাতে ঘুরছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। অফিসের বড় কর্তাও এখন ক্ষণে ক্ষণে দুহাত কচলান। কোন কুক্ষণে কুপোকাত হতে হয় কে জানে!

কর্তৃপক্ষও নড়েচড়ে বসেছে। তাদের চেষ্টাও কম নয়। সামাজিক দূরত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো ফুটপাতের ভিড়ে পথচারীর দিকে তেড়েফুঁড়ে যাচ্ছেন, ‘মাস্ক কই?’

‘স্যার, অনেকেই তো মাস্ক পরে আছে। আমার আর কী দরকার?’ পথচারীর সলাজ জবাব।

‘ও, তাই নাকি!’ প্রশ্নকর্তা লা-জবাব। এবার আরও কড়া ধমক,‘প্যান্ট খুলুন।’

‘অ্যা! প্যান্ট খুলব কেন, স্যার?’

‘সবাই তো প্যান্ট পরে আছে। আপনার আর কী দরকার?’

বাঙালি বরাবরই বেপরোয়া। গলাপানিতে না পড়া পর্যন্ত সে কিছুই গ্রাহ্য করে না। লক্ষণ ভীষণ হলেই শুরু হয় তার ভীম বেগে ছোটাছুটি। এরপরই ঘটে চমৎকার! হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায় সে। দুপায়ে মাড়ায় বিপদ। ঘুচে যায় শঙ্কা। প্রমাদ দূর হয় প্রবাদে, সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়। এরপর তাকে মানায় সাধ্য কার?

অথচ এখন সময় মানার, মেনে চলার; চললে স্বাগতম। না চললে পৃথিবী থেকে ভাগতম।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত হওয়ার কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করছে! ওষ্ঠাগত প্রাণ। শ্রেষ্ঠ প্রেমিকও প্রেমিকাকে বাহুডোরে নিয়ে গাইতে পারছে না ‘তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’।

প্রেমিকা আঁতকে উঠে বলছে, তফাত যাও, পজিটিভ হ্যায়।

সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন ‘বেঁচে থাকো সর্দিকাশি’। তিনি কি দেখতে পাচ্ছেন, বিশ্ববাসী আজ হাঁচি থেকেও পালিয়ে বাঁচতে চাইছে?

আদালতের রায়ে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। জেল সুপার এলেন তার কাছে।

‘আপনার শেষ কোনো ইচ্ছা থাকলে বলতে পারেন।’

‘তার আগে বলুন, আমাকে কীভাবে মারা হবে?’

‘ইলেকট্রিক শক দিয়ে।’

‘স্যার, আপনিই মা-বাপ। আপনার কোলে মাথা রেখে মরতে চাই।’

সুপার দেখলেন, এ তো ভারি বিপদ! তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসলেন। ফিরে এসে আসামিকে জানালেন, ‘দুঃখিত, আমরা সিদ্ধান্ত বদলেছি। ফায়ারিং স্কোয়াডে আপনার মৃত্যুদণ্ড হবে।’

শুনে আসামি বলল, ‘আপনি মান্যগণ্য। সামনে দাঁড়াই কীভাবে! আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে মরতে চাই।’

সুপার পড়লেন মহা ফাঁপরে! মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির শেষ ইচ্ছা পূরণ কর্তব্য। অনেক ভেবে তিনি পুনরায় সিদ্ধান্ত বদলালেন। বললেন, ‘ওকে, আপনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে ফাঁসির মাধ্যমে।’ ভাবলেন, আর ধানাইপানাই চলবে না। নিজের বুদ্ধিতে নিজেই খুশি!

আসামি এবার সুপারের দিকে দুকদম এগিয়ে এসে নিচু কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, কদিন হলো সর্দিজ্বর। হালকা গলাব্যথা আছে। আজ সকাল থেকে কোনো কিছুর ঘ্রাণ পাচ্ছি না!’

শুনেই সুপার আঁতকে উঠে তিন কদম পিছিয়ে গেলেন।

আসামিও বিদ্যুৎবেগে লাফিয়ে উঠল। বাতাসে বার কয়েক নাক টেনে বেমক্কা সুপারকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘স্যার, মৃত্যুর আগে একটা হাঁচি দিতে চাই।’