ভক্তের অতি ভক্তি, বিড়ম্বনায় লেখক

ভক্ত তো লেখকদের আরাধ্য। তবে কোনো কোনো ভক্তের কাণ্ডকীর্তিতে লেখককে বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়। অন্তর্জাল ঘেঁটে লিখেছেন শিমিন মুশশারাত

ভক্তরা লেখকদের অনেক সময় ছায়ার মতোই অনুসরণ করেন। তাঁদের কারণে নাকাল হয়েছেন এমন লেখকের সংখ্যা কম নয়ছবি: সংগৃহীত

প্রিয় লেখকের দেখা পাওয়ার অভিজ্ঞতা অসামান্য। অটোগ্রাফ নেওয়া বা লেখকের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য তাই তাঁদের ভক্তরা সাগ্রহে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে কখনো-সখনো পাঠকের ভক্তির পরিমাণ লেখকের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি তা হতে পারে বিপজ্জনকও। বর্তমানে জীবিত এমন কয়েকজন লেখকের সঙ্গে তাঁদের ভক্তদের কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো। বাস্তব জীবনের এই ঘটনাগুলো যেন গোয়েন্দা গল্প বা থ্রিলারকেও হার মানায়।

দ্য ট্রিক ইজ টু কিপ ব্রিদিং-এর লেখক জ্যানিস গ্যালওয়ে একটি বইয়ের অটোগ্রাফ দেওয়ার আয়োজনে অদ্ভুত এক ভক্তের দেখা পেয়েছিলেন। ভক্ত বলাটা অবশ্য ঠিক হলো না। কারণ, এই মানুষ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন শুধু গ্যালওয়ের লেখা তাঁর কত অপছন্দ, সেটা জানাতে। শুধু লেখাই নয়, লেখকের কানের দুলও নাকি তাঁর কাছে বিশ্রী লেগেছিল!

তবে এর চেয়েও বাজে ছিল ভ্যাল ম্যাকডারমিডের অভিজ্ঞতা। সান্ড্রা বোথাম নামের এক নারী সোনালি পরচুলা, হ্যাট আর চশমা পরে ছদ্মবেশে অপেক্ষা করছিলেন লাইনে। তাঁর অটোগ্রাফ নেওয়ার পালা এলে তিনি ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত আ সুইটেবল জব ফর আ উইম্যান বইটি এগিয়ে দেন। এরপরই ঘটে সেই অকাণ্ড, লেখক ভ্যাল ম্যাকডারমিডের গায়ে কালি ছুড়ে মারেন সান্ড্রা বোথাম। পরে জানা গেছে, ২০ বছর ধরে ম্যাকডারমিডের ওপর ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন তিনি। কারণ, তাঁর ধারণা ছিল, বইটির একটি পরিচ্ছদে লেখক তাঁকে অসম্মান করেছেন।

অপরাধবিষয়ক উপন্যাসের লেখক পিটার জেমসের এক ভক্ত ১০ বছর ধরে তাঁর নানান অনুষ্ঠানে হাজির হন। শুধু তা-ই নয়, একসময় তিনি লেখককে দীর্ঘ ই-মেইল পাঠানো শুরু করেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ই-মেইলের পরিমাণ ও কলেবর। দিনে ২০টি ই-মেইলও পেয়েছেন জেমস। এর মধ্যে একটি মেইল দেখে আক্কেলগুড়ুম হয়ে যায় লেখকের। তাতে ছিল একটি ছবি—দেয়ালজুড়ে জেমসকে নিয়ে লেখা খবরের কাটিং, বইয়ের প্রচ্ছদ, এমনকি দূর থেকে তোলা স্ত্রীসমেত তাঁর আলোকচিত্র। এ ঘটনায় পুলিশের শরণাপন্ন হলে তারা জানায়, কেউ সরাসরি হুমকি না দিলে তাদের তেমন কিছু করার নেই। এরপর আরও একটি অনুষ্ঠানে অটোগ্রাফ নিতে আসেন ওই ভক্ত। নাম জিজ্ঞেস করায় খেপে যান তিনি, পিটার তক্ষুনি বুঝে যান কে উনি। অতঃপর এই উদ্ভট অনুসারীর হয়রানির শেষ হন ১০ হাজার শব্দের একটি ই-মেইলের মাধ্যমে, ‘আমি বহুদিন ধরে আপনার এক নম্বর ভক্ত আর আপনি আমার নামটাও মনে রাখতে পারেননি।’—এমনই ছিল সেই সুবিশাল ই-মেইলের প্রথম লাইন।

বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় হরর ঘরানার লেখক স্টিফেন কিং। একাধিক পাগলপ্রায় ভক্তের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। এক লোক একবার দুটো দাবি নিয়ে তাঁর বাড়িতে ঢুকে যায়। এক. কিংয়ের উপন্যাস মিজেরি আসলে তাঁর লেখা। দুই. তাঁর সঙ্গে একটা বোমা আছে। কাকতালীয়ভাবে মিজেরি উপন্যাসের ঘটনার কেন্দ্রে আছেন একজন লেখককে জোর করে বাড়িতে আটকে রাখা তাঁর এক ভক্ত। এ ছাড়া এক বৃদ্ধা বিশ্বাস করতেন, স্টিফেন কিং তাঁর বাড়ির ভাঁড়ার ঘরে দ্য শাইনিং বইটি লিখেছেন। তবে সবচেয়ে অভূতপূর্ব দাবি ছিল স্টিভেন লাইটফুট নামের একজনের। তাঁর ধারণা ছিল, স্টিফেন কিং তাঁকে চিঠি লিখেছেন। আর সেই চিঠি পড়ে তাঁর বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মেছিল যে স্টিফেন কিং হলেন জন লেননের হন্তারক!

খ্যাতির বিড়ম্বনার সবচেয়ে রোমহর্ষ গল্পটি হেলেন দেউইটের। এই লেখকের নিজের হাতে লেখা ঘটনার শেষটা এমন, ‘বিছানায় বসে লিখছি, হাতে বেসবল ব্যাট। জানি না কাউকে এটা দিয়ে আঘাত করতে পারব কি না। তবে ঘটনার শুরু হয়েছিল এভাবে, লেখা জমা দেওয়ার তারিখ ঘনিয়ে আসছে, এদিকে টাকাপয়সাও তেমন হাতে নেই। দ্রুত প্রকাশককে লেখা দিতে পারলে ঝামেলা থেকে রেহাই মেলে।’

জ্যানিস গ্যালওয়ে, ভ্যাল ম্যাকডারমিড, স্টিফেন কিং, হেলেন দেউইট, পিটার জেমস

হেলেন যখন এমন অবস্থায়, তখন ছোট্ট একটি কেবিনে থাকার বন্দোবস্ত করেন তিনি। সময় দুই মাস। ফোন, ইন্টারনেট-বিবর্জিত হয়ে এখন শুধু লিখে ফেলা বাকি। কিন্তু লেখা শুরুর পর পাশের বাড়ির এক ভদ্রলোক প্রায় প্রতিদিন খাজুরে আলাপ করতে চলে আসেন হেলেনের কেবিনে। পরবর্তীকালে এই লোকটির কথা হেলেন লিখেছেন ‘ই’ নামে। প্রতিদিন হেলেন তাঁকে জানান তিনি খুব ব্যস্ত, কথা বলার সময় করে উঠতে পারছেন না। ই বলেন, ঠিক আছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় না। যথারীতি সকাল-বিকেল ই-এর দেখা মেলে। অগত্যা তিতিবিরক্ত হয়ে কেবিন ছেড়ে একটি হোটেলে গিয়ে থাকা শুরু করেন হেলেন। এর মাঝে তিনি ওই লোকের বাড়িওয়ালার সঙ্গে এই সমস্যা নিয়ে তিনি যোগাযোগও করেন। বাড়িওয়ালা তাঁকে বলেন, সমস্যা আপনারই। আপনি আকর্ষণীয় সে জন্যই ই বারবার আপনার বাড়ি যায়। ঘটনাটি পুলিশকে জানালে তারা লোকটির দীর্ঘ অপরাধের ইতিহাস আবিষ্কার করে। পরে কোর্ট থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয় এক শর্তে, হেলেনের আশপাশে যেন না দেখা যায় তাঁকে। কিন্তু এ আদেশ থোড়াই কেয়ার করতে ই-এর তেমন দেরি হয় না। দ্রুতই তিনি হাজির হন হেলেনের বাড়িতে, তবে এবারে বন্দুকসমেত। এই ঘটনার পর জেল হয় লোকটির। এরপর কোনো অজ্ঞাত কারণে সময় শেষ হওয়ার পাঁচ মাস আগেই তিনি ছাড়া পেয়ে যান। খবর পেয়ে পুরো ঘটনাটি লিখতে শুরু করেন হেলেন, বেসবল ব্যাট হাতে, লোকটির ফিরে আসার অপেক্ষায়।

বেশ বোঝা যাচ্ছে, বিভিন্ন লেখককে নিয়ে ভক্তদের এই অতি ভক্তি ‘চোরের লক্ষণ’ না হলেও তাঁদের জীবনকে দুর্বিষহ করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

সূত্র: লিটরিঅ্যাক্টর ডটকম ও দ্য গার্ডিয়ান