ভালো নেতা হতে হলে কী কী বই পড়া জরুরি

নিয়মিত বই পড়া বারাক ওবামাকে নেতা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে
ছবি: সংগৃহীত

একটি ব্যাপার খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকলে অবশ্য খেয়াল না করে উপায়ও নেই। আর তা হচ্ছে বিশ্বের জনপ্রিয় নেতারা সবাই বই পড়েন; তা তিনি রাজনৈতিক নেতা হোন আর ব্যবসায়ী নেতা হোন। যাঁরা টুইটারে বারাক ওবামাকে ফলো করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট দু–চার দিন পরপরই টুইটারে নিজের পড়া বই নিয়ে টুইট করেন। বইটির ভালো লাগা, মন্দ লাগা দিক নিয়ে দু–চার কথা লেখেন। বইটি কেন পড়া উচিত, সেসব নিয়েও লেখেন। মিশেল ওবামাও বই নিয়ে ভীষণ সরব। প্রায়ই তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে উপস্থিত হয়ে বই নিয়ে আলোচনা করেন। শুধু তা–ই নয়, বিভিন্ন প্রকাশনীর ইউটিউব চ্যানেলেও বই নিয়ে আলোচনা করেন সাবেক এই মার্কিন ফার্স্ট লেডি।

যাঁরা বিল গেটস সম্পর্কে টুকটাক খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, এই ধনকুবের প্রতিদিন বই পড়েন এবং সেসব বই নিয়ে লম্বা লম্বা আলোচনা লেখেন নিজের ওয়েবসাইট গেটস নোটসে। আরেক ধনকুবের ওয়ারেন বাফেটের বই পড়া নিয়েও প্রায়ই বিশ্ব গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ব্যবসায়ী জগতের এই আইকনের বই পড়ার ধৈর্য বিস্ময়কর। এমনকি হালের প্রযুক্তি বিশ্বের তরুণতর নেতা মার্ক জাকারবার্গও বই পড়েন।

সংগত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, ভালো নেতা হতে হলে কি বই পড়া জরুরি? এ বিষয়ে নেতৃত্ব বিশেষজ্ঞ এবং পিয়েডমন্ট হেলথ কেয়ারের এক নির্বাহী পরিচালক এলিজাবেথ ওয়াং বলেছেন, ভালো বই, বিশেষত ভালো উপন্যাস মানুষের নেতৃত্ব বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাঁর মতে, একটি ভালো উপন্যাস মানুষের ভেতর ছয়টি গুণের জন্ম দেয়।

১. সৃজনশীলতা বাড়ায়

একটি উপন্যাসে শুধু গল্পই থাকে না, বরং গল্পের মাধ্যমে নানান সমস্যার সমাধানও থাকে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা বেশি বেশি গল্প-উপন্যাস পড়েন, তাঁরা অন্যদের চেয়ে অনেক সুন্দরভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, সন্নিবেশ করতে পারেন এবং তথ্যের উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারেন। গল্পপড়ুয়াদের মন অনেক বেশি উদার হয় এবং তাঁরা ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারেন। বই পড়ার অভ্যাস তাঁদের সৃজনশীলতা বাড়িয়ে দেয়।

২. গল্পবলিয়ে

দেখবেন, ভালো নেতারা চমৎকার গল্প বলতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর কথাই ধরুন, তিনি গল্পের ঢঙে বক্তৃতা করতেন। গল্পের মাধ্যমেই মানুষের মনে আগুন ধরিয়ে দিতে পারতেন। ৭ মার্চের ভাষণ তো এক ঐতিহাসিক গল্পই। মার্টিন লুথার কিংয়ের আই হ্যাভ আ ড্রিম তো এক গল্পই। নেতারা এই গুণ অর্জন করেন বই পড়ার মাধ্যমে। এলিজাবেথ ওয়াংয়ের মতে, যাঁরা বেশি বেশি গল্প-উপন্যাস পড়েন, তাঁরা যেকোনো ঘটনাকে গল্পের মতো করে উপস্থাপন করতে পারেন। তা ছাড়া উপন্যাস পড়ার মাধ্যমে তাঁদের শব্দভান্ডারও বাড়ে। চমৎকার চমৎকার শব্দ ব্যবহার করে তাঁরা জনগণকে মুগ্ধ করতে পারেন।

৩. সহানুভূতির জন্মদাতা

ভালো নেতা হওয়ার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সহানুভূতিসম্পন্ন হওয়া। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক নেতাই সহানুভূতিসম্পন্ন। আর বই পড়ার অভ্যাস মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তোলে। একটি উপন্যাসে অনেক চরিত্র থাকে। চরিত্রগুলো দুঃখ, কষ্ট, হাসি, আনন্দসহ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে যায়। পড়ার সময় এসব ঘটনার অভিঘাত অনুভব করেন পাঠক। ফলে তিনিও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। জার্নাল অব অ্যাপ্লায়েড সোশ্যাল সাইকোলজির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হ্যারি পটার শুধু নিছক এক উপন্যাস নয়, এটি মানুষের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। এই বই শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতার জন্ম দেয়, ভাবনার খোরাক দেয়, নেতৃত্ববোধ তৈরি করে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করে। বিশেষ করে নেতৃত্ব বিকাশে খুবই অবদান রাখে।

৪. দুশ্চিন্তানাশিনী

যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে হয় ভালো নেতাদের। এই বিশেষ গুণ অর্জন করতে আপনাকে সাহায্য করবে বই পড়ার অভ্যাস। ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, গান শোনা কিংবা ট্রেডমিলে হাঁটার চেয়ে বই পড়া মানুষকে বেশি প্রশান্তি দেয়। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে একটি ভালো উপন্যাসের বিকল্প নেই। গল্পকার ও ঔপন্যাসিক কেরিডওয়েন ডোভি বলেছেন, যখনই কোনো বিষয়ে মাথায় চাপ অনুভব করি কিংবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি, তখনই একটি গল্পের বই খুলে বসি। সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।

৫. সম্পর্কের নির্মাতা

যোগ্য নেতা হতে হলে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। আর সম্পর্ক তৈরির পূর্বশর্তই হচ্ছে যোগাযোগ। যোগাযোগের দক্ষতা ছাড়া নেতা হওয়া একেবারেই অসম্ভব। মানুষের সঙ্গে আপনি যদি যোগাযোগই না করতে পারেন, তাহলে নেতা হবেন কী করে? নেতা হতে হলে মানুষের চোখের ভাষা বুঝতে হয়, মুখের ভাষা বুঝতে হয়, শরীরের ভাষাও বুঝতে হয়। আর ভাষাই তো যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। নিউইয়র্ক টাইমস–এর কলামিস্ট অ্যানি মার্ফি পল বলেছেন, যাঁরা যত বেশি গল্প-উপন্যাস পড়েন, তাঁরা তত বেশি মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন। খুব দ্রুত সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন।

৬. এনে দেবে অমরত্ব

নেতৃত্বের সঙ্গে অমরত্বের এক গোপন সম্পর্ক রয়েছে। ভালো নেতারা মৃত্যুর পরও কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকেন। আর মানুষের ভেতর এই অমরত্ববোধ এনে দেয় বই পড়া। বইয়ের লেখকেরা পৃথিবী থেকে তিরোহিত হন বটে, কিন্তু তাঁদের বই থেকে যায় যুগের পর যুগ। আজ থেকে ২০০ বছর আগে ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে মহামতি দস্তয়েভস্কির, কিন্তু তিনি এখনো বেঁচে আছেন। দস্তয়েভস্কিকে অমরত্ব এনে দিয়েছে তাঁর উপন্যাস। যাঁরা গল্প–উপন্যাস পড়েন, তাঁদের মনেও অমর হওয়ার সাধ জন্মে। ফলে কেউ রাজনৈতিক নেতা হয়ে অমর হন, কেউ ব্যবসায়ী নেতা হয়ে অমর হন, আবার কেউ সাহিত্যিক নেতা হয়ে অমর হন।

এই ছয়টি গুণের বাইরেও যেসব গুণের কারণে মানুষ নেতা হয়ে ওঠেন, সেসব গুণকেও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বিকশিত করে একটি ভালো উপন্যাস কিংবা ভালো একটি গল্পের বই। তাই ভালো নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ভালো গল্প-উপন্যাসের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।


সূত্র: লিট অ্যান্ড লিজার, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর টেলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস অনলাইন, জার্নাল অব অ্যাপ্লায়েড সোশ্যাল সাইকোলজি ও দ্য নিউইয়র্কার।