মানবতার অর্থ ও উত্তরাধিকার আজ চ্যালেঞ্জের মুখে

বর্তমান বিশ্বের আলোচিত চিন্তক ইউভাল নোয়াহ হারারি। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক তিনি। তাঁর লেখা ‘স্যাপিয়েন্স’ বইটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া একটি বই। মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ কেমন হবে, সে বিষয় নিয়েও তিনি লিখেছেন ‘হোমো ডিউস’ নামে একটি বই। এই দুই বই এবং হারারির বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতা শুনে প্রিয় লেখকের কাছে চিঠি লিখেছেন অ্যান্ডি নরম্যান নামের এক পাঠক। পাঠক ও ভক্তের সেই চিঠির জবাব দিয়েছেন ইউভাল নোয়াহ হারারি। ‘লেটার ডট উইকি’ থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

ইউভাল নোয়াহ হারারিকে লেখা অ্যান্ডি নরম্যানের চিঠি

প্রিয় ড. হারারি,
আমার নাম অ্যান্ডি নরম্যান। আমি আপনার কাজকর্মের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। আমি মনে করি, আপনার ‘স্যাপিয়েন্স’ ও ‘হোমো ডিউস’ আমাদের জন্য এক যুগান্তকারী আশীর্বাদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও বই দুটি নিঃসন্দেহে উদ্দীপ্ত করবে। আমি অনেক কিছু জেনেছি বই দুটো থেকে।

তবে আপনি যে মানবতাবাদের কথা বলেন, তার সঙ্গে আমাদের চেনাজানা মানবতাবাদের মিল খুব সামান্যই। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, সামাজিক ন্যায়নীতি, পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রাণি অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্র থেকে যুগ যুগ ধরে আমরা যে মানবতাবাদ শিখেছি, তার সঙ্গে আপনার বলা মানবতাবাদ সাংঘর্ষিক।

শুধু তা–ই নয়, তথাকথিত সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও নাজিবাদের সঙ্গেও আজকের মানবতাবাদীদের বিশ্বদর্শন মেলে না। আমাদের যেকোনো আন্দোলনের ইশতেহার একনজর দেখলেই বুঝতে পারবেন, উল্লিখিত মতাদর্শ আসলে মানবতাবিরোধী। প্রকৃত মানবতাবাদ সব সময় সর্বগ্রাসী মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

হাইডেগার নামের একজন প্রখ্যাত নাজি ও সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সমসাময়িক মানবতাবাদীরা ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’, তথা মানুষকে পূজা করে না। মানুষের কোনো ‘পবিত্র অবয়ব’ থাকতে পারে, আমরা তা বিশ্বাস করি না। আমরা এটাও বিশ্বাস করি না যে ‘মহাপরাক্রমশালী ঈশ্বর মানুষের জন্য ভালো’ এবং ‘অন্যান্য প্রাণি শুধু আমাদের (মানুষের) সুবিধার জন্যই জগতে রয়েছে।’ আমি এখন বুঝি, কাউকে গালি দেওয়ার জন্য ‘মানবতাবাদী’ শব্দটি হচ্ছে সবচেয়ে সুবিধাজনক শব্দ।

ধর্মনিরপেক্ষ উদার চিন্তাবিদেরা সব সময় ধর্মের বিকল্প একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের এই খোঁজাখুঁজি বরং মানবতাকে বিভক্ত করেছে। এটা একটা সমস্যা। এই সমস্যা নিয়ে একদিকে দার্শনিকেরা কাজ করছেন, অন্যদিকে সমাজ সংস্কারক, সমাজকর্মী ও সমাজনির্মাতারাও কাজ করছেন। তবে আমি সত্যিই বিশ্বাস করি যে মানবতাবাদকে দার্শনিক ও সামাজিক আইনকানুন দ্বারা বোঝা যায়। নৈতিক অগ্রগতির এটা একটা উৎস বলেও মনে করি।

সুতরাং আপনি আপনার বইয়ে যে মানবতাবাদের চিত্র এঁকেছেন, তা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে আহ্বান জানাই, আপনি সত্যিকারের মানবতাবাদকে ফিরিয়ে আনুন। আপনি মনে মনে যে পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন, সেখানে খুঁজলেই সম্ভবত প্রকৃত মানবতাবাদের সংজ্ঞা খুঁজে পাবেন। ছোট্ট এই পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আপনি একটি বৃহৎ মানবতাবাদী আন্দোলনে শরিক হতে পারবেন। তখন সবার শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারবেন এবং আপনার মতাদর্শের পক্ষেও বিশাল অনুসারী গোষ্ঠী তৈরি করতে পারবেন।


ইতি
অ্যান্ডি নরম্যান

অ্যান্ডি নরম্যানের চিঠির উত্তরে ইউভাল নোয়াহ হারারি

প্রিয় অ্যান্ডি,
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ওপরই আমি প্রথমত ফোকাস করতে চাই। আমরা আমাদের ছায়া নিয়ে কী করব? যেসব মানুষ আধুনিকতা উদযাপন করে, সভ্যতার আলো উপভোগ করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা লালন করে, তারা প্রায়ই বুঝতে পারে না যে কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদের ব্যাপারে তারা কী করবে। তারাও কি আধুনিকতার অংশ?

তারাও কী ধর্মনিরপেক্ষ আলো থেকে উৎসারিত পণ্য? আমার বক্তব্য হচ্ছে, হ্যাঁ, তারাও অংশ। তবে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার আলো ও আধুনিকতার অবদানকে স্বীকার করে না। এর মানে হচ্ছে, আমাদের সতর্ক থাকা উচিত এবং ছায়াকে স্বীকার করা উচিত। একই সঙ্গে ‘আমাদের সঙ্গে এমনটা ঘটতে পারে না’ এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করা উচিত।

আমি মনে করি, চিরাচরিত ধর্মের বিরুদ্ধে মানবতাবাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে, জ্ঞানকে ধারণ করা এবং ভুলকে স্বীকার করার সাহস। আপনার সঙ্গে আমি একমত যে মানবতাবাদ গত কয়েক শতাব্দীতে যেকোনো ধর্মের তুলনায় মানুষের পক্ষে অনেক বেশি ভালো কাজ করেছে।

একুশ শতকের এই সময় সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা একটি উত্তর-মানবতাবাদী (পোস্ট হিউম্যানিস্ট) যুগে প্রবেশ করছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর জৈব প্রযুক্তি সবকিছু ওলট–পালট করে দিচ্ছে। ফলে মানবতার অর্থও বদলে যাচ্ছে। গত তিন শতাব্দীজুড়ে যে মানবতা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে গেছে, সেই মানবতা নিয়ে এখন আমাদের পুনরায় চিন্তা করা প্রয়োজন।

আমি একটা তথ্যের ওপর জোর দিতে চাই। সেটা হচ্ছে, নাৎসি ও স্ট্যালিনবাদীরাও মানবতায় বিশ্বাস করত এবং তারা মনে করত যে তারাও মানুষের জন্য ভালো কাজ করছে।

আপনি লিখেছেন মানবতার প্রকৃত ধারণা হচ্ছে, সব মানুষ মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কারা? আমরা যখন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করি না, তখন সেটা সম্ভবত ইহুদিদের জন্য সুনাম বয়ে আনে? আমরা যখন গরুর সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করি না, তখন সেটা সম্ভবত মানব সম্প্রদায়ের জন্য সুনাম বয়ে আনে? এরপর আজ থেকে বহু বহুকাল পর ২১০০ সালে যখন আমরা হোমো স্যাপিয়েন্সদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব, তখনো সম্ভবত সেটা অতিমানবদের জন্য সুনাম বয়ে আনবে? যেকোনো উপায়ে নিজের পক্ষে এসব যুক্তি দাঁড় করানো সবচেয়ে বিপজ্জনক।

আমি মানবতাকে দেখি একটি পবিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে। আমি মানবতাকে দেখি কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে, যেমন ধর্মতত্ত্ব মনে করে, কর্তৃত্ব আসে ঈশ্বরের কাছ থেকে। একইভাবে জাতীয়তাবাদীরা মনে করে কর্তৃত্ব আসে জাতি থেকে। সুতরাং মানবতাবাদীরাও মনে করে কর্তৃত্ব আসে মানবতা থেকে।

জগতে অনেক ধরনের মানবতাবাদ আছে, যেমন আছে অনেক ধরনের ঈশ্বরবাদ। আসলে ঈশ্বর যেমন অস্পষ্ট, তেমনি মানবতাবাদও অস্পষ্ট।

মানবতাসংক্রান্ত লেখাজোখা ও বক্তৃতায় আমি উদার মানবতাবাদ, সামাজিক মানবতাবাদ ও বিবর্তনবাদী মানবতাবাদকে ফোকাস করেছি। আপনি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ সম্পর্কে যা বলেছেন, আমি সেখানে একটু দৃষ্টি দিতে চাই। আমি মনে করি, ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ মোটেও মানবতাকে পবিত্র করে না। তবে পৃথিবীতে যেসব মানবতাবাদী আন্দোলন হয়েছে, তা প্রকৃত অর্থেই মানবতাকে পবিত্র করেছে। এসব মানবতাবাদী নৈতিক আন্দোলন ইতিহাসের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৭৭৬ সালে ‘সব মানুষ সমান’ এবং ‘সবার অধিকার রয়েছে’ মর্মে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না।

ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ সম্পর্কে আপনি যা বলেছেন, সেটা নৈতিক ও দার্শনিকভাবে খুব উচ্চবোধসম্পন্ন একটা বিষয় হতে পারে, কিন্তু উদারতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের তুলনায় তা কম গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।

সত্য ও ক্ষমতা একসঙ্গে চলতে পারে না। সস্তা গল্প কোটি কোটি মানুষকে বোঝানো সম্ভব কিন্তু সত্য সব সময়ই কম মানুষ বুঝবে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি ক্ষমতা খুঁজবেন, নাকি সত্য খুঁজবেন?

ইতি
ইউভাল


অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]