মাস্ক-মাক্সবৃত্তান্ত

কোভিড-১৯ নামের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ চলছে। অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসা কোনো শত্রু নয়, এ একেবারে মেড ইন পৃথিবী, ঘরের শত্রু বিভীষণ। এ বাহিনী আবার মহাভারতীয় কায়দায় অদৃশ্য হয়ে লড়ার মন্ত্র জানে, ফলে তাদের কজন নিকাশ হয়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায় না। তবে মিত্রবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বর্ণনা ওয়ার্ল্ডোমিটারে ক্ষণে ক্ষণে জানানো হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেখছি মৃত্যু ১১ লা৩০ হাজার ৪৯৬, ধাঁ করে লিখফেললাম, না হলে সুকুমারের হ-য-ব-র-ল–এর মতো পরক্ষণেই বেড়ে যাবে।

শোনা যায়, এখনকার পারমাণবিক বা হাইড্রোজেন বোমার তাকত নাকি এমনই যে গোটা পাঁচেক ফোটালেই দুনিয়ার সব প্রাণী নিকাশ হয়ে যাবে। তবে এ অস্ত্র এখানে কাজে দেবে না। শত্রু নাকি প্রাণধারী কিছু নয়, যার প্রাণই নেই, তাকে আবার মারা, উল্টো নিজেরাই বেঘোরে প্রাণ হারানোর জোগাড় হবে। এদের মারতে শুধু নাক-মুখ ঢাকার ব্যবস্থা আর হাতে গ্লাভস পরলেই চলবে, এসবে ধাক্কা লেগেই বাবাজিরা মাটিতে পড়ে আপনিই অক্কা পাবে। এ তো সহজ ব্যাপার, কিন্তু যুদ্ধের খবর তো ভালো নয়, মিত্রবাহিনী কেবলই পিছু হটছে। কারণ নাকি এদের সংখ্যা, মরে যত বাড়ে তার শতগুণ, ঠাকুরমার ঝুলির রাক্ষস-খোক্কসের মতো আরকি। এতেই বিশ্বব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব।

মেশিনগান-যুদ্ধবিমান-ট্যাঙ্ক-বোমা দিয়ে যুদ্ধ করতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ, যুদ্ধ লম্বা হলে ইয়া ইয়া ধনী দেশও পথে বসে। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মুখসারির যোদ্ধাদের যুদ্ধপোশাকে আন্দাজ কয়েক হাজার টাকা লাগে, আর আমাদের মতো কম হিম্মতওয়ালাদের শুধু মুখে একটা মাস্ক আর হাতে একজোড়া গ্লাভস হলেই হলো, খরচ ১০০ টাকার বেশি নয়। আর মাস্ক নাকি তিন পল্লা কাপড় দিয়ে বাসাতেই বানানো যায়। চিন্তা করা যায়, এত কম খরচে একটি বিশ্বযুদ্ধ চলছে! ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে যুদ্ধাস্ত্র, বানাচ্ছেন মা-বোন-স্ত্রী-খালা-চাচি-শাশুড়ি-ভাবি-ননদ মিলে, গৃহে গৃহে সৌহার্দ্য ও শান্তি স্থাপনে আর কুটিরশিল্পে এর অবদান এখনো টাকার অঙ্কে হিসাব করা হয়নি।

তবে গোল বেধেছে অন্য জায়গায়। প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রার যুগে দেশে দেশে টেলিভিশন সংবাদ আর টকশোতে প্রায় রানিং কমেন্ট্রির মতো চলছে কোভিড-১৯ ঝড়, মুহূর্তে মুহূর্তে আপডেট। সেই সঙ্গে দায়িত্ববান সরকারি মুখপাত্রগণ জনগণকে করণীয় সম্পর্কে নসিহত দিয়ে চলেছেন। আমাদের দেশে এই ব্যাপারে একটুখানি বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। নাক-মুখ ঢাকার জন্য কখনো বলা হচ্ছে মাস্ক পরতে, কখনো বলা হচ্ছে মাক্স পরতে। একটু কান খাড়া করে শুনলে সরকারি দৈনিক বুলেটিনে আর টকশোতেও দুই রকমই শোনা যাবে। আমাদের স্বল্পশিক্ষিত জনগণ এতে একটু ফাঁপরে পড়ে যাচ্ছেন, মাস্কই পরবেন নাকি মাক্স। লেখাপড়া খানিকটা জানা আছে বলে এ ব্যাপারে ফয়সালার জন্য অভিধানের সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, ইংলিশ-টু-বেঙ্গলি। বঙ্গদেশি ও ভারতীয় অভিধান ঘেঁটে মাস্ক শব্দের অর্থ বেরোলো মুখোশ, মুখাবরণ, মুখচ্ছদ ইত্যাদি, আবার ছদ্মবেশও। এদিকে মাক্স বলে ইংরেজিতে কোনো শব্দই নেই। না না, আছে। এটি সোভিয়েত আমলের একটি মহাকাশ-প্রকল্পের আদ্যক্ষরের সংক্ষিপ্তসার, রুশ ভাষায় উচ্চারণ করতে গেলে দন্ত হারানোর সমূহ সম্ভাবনা। সোভিয়েত নাম শুনে বাম পণ্ডিতেরা কেউ কেউ নাকি একে কার্ল মার্ক্সের সঙ্গেও গুলিয়ে ফেলছেন। অবশ্য মাক্স নামের সে কর্মসূচি এখন বহুকাল বাতিল। এদিকে পুতিন মহাশয়ের মাস্কের মতো নির্বিকার মুখচ্ছবির আড়ালে যে কী আছে, ডান-বাম কেউই সেটি সঠিক ধরতে পারছেন না। আর সোভিয়েত কানেকশন টের পাওয়ার ফলেই নাকি ট্রাম্প সাহেব মাস্ক নামটি শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন।

তবে মাস্কের এত রাজনৈতিক তাৎপর্য নিরীহ জনগণ ধরতে পারে না। তারা মুখোশ, মুখাবরণ, এমনকি ছদ্মবেশও পরতে রাজি আছে, কিন্তু গোটা একটি মহাকাশযান মুখে ধারণ করে থাকতে কাউকে রাজি করানো যাবে বলে মনে হয় না। আর এতে খরচাপাতি যা পড়বে, তা শুনেই অনেকে ভিরমি খাবেন। তার চেয়ে মাস্কই সই। প্রথম দিকে ছিল মজুতদারের দিনকাল, তাদের প্রতিভায় নানান জাতের মাস্কের একটু অভাব পড়ে গিয়েছিল। তবে উদ্ভাবনী প্রতিভায় অদ্বিতীয় বাঙালি এর তড়িৎ সমাধান বের করতে বসে থাকেনি। আগে শুধু ওষুধের দোকানেই মাস্ক পাওয়া যেত, এখন দোকানপাট-ফেরিওয়ালা-ফুটপাথে মাস্কের গড়াগড়ি, সাদা-কালো-ফুলকাটা, দুনম্বরি, তিন নম্বরি—সব কিসিমের। আগে মাস্ক আর স্যানিটাইজার নকল পাওয়া গিয়েছিল, এখন নকল ডাক্তার, নকল হাসপাতাল পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে।

তবে মাস্ক পরার ব্যাপারে বাঙালির অনীহার কারণ নিয়ে গবেষণা হতে পারে। একে গরমের দেশ, গায়ে কাপড় রাখার অভ্যাস কম, তার ওপর গায়ের চেয়ে মুখের জোর বেশি, সেই মুখ বন্ধ করে দিলে বাঙালির থাকে কী! মুশকিল হচ্ছে এ শত্রুর আক্রমণের নিশানা মূলত মুখ আর নাক, এ ছাড়া চোখ। চোখে পর্দার ব্যবস্থা আছে, মুখও চাইলে বন্ধ রাখা যায়। কিন্তু নাকের জন্য সৃষ্টিকর্তা কোনো ঢাকনার ব্যবস্থা করেননি। অতএব ঢাকো নাক, ঢাকো মুখ, পারলে চোখও। মাস্কের ব্যবস্থা নাক ও মুখ একসঙ্গে ঢাকার জন্য। কিন্তু তাতেও মুখ বন্ধ করা গেছে বলে মনে হয় না। টেলিভিশনের প্রতিবেদন, টকশোর হুংকার, মন্ত্রী মহোদয়দের বাণী—সবই মাস্কে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মাঝেমধ্যে অবোধ্য বা দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে, এমনকি ভুল অর্থ বোঝার আশঙ্কাও থাকে। আর মাঠঘাটের বাঙালি মাস্ক পকেটে রাখে, নাকটা বের করে রাখে অথবা এক কানে ঝুলিয়ে রাখার বুদ্ধি খাটায়। পুলিশ-মিলিটারি গোছের কিছু টের পেলে অবশ্য সটান সঠিক হতেও তার জুড়ি নেই। দাওয়ায় মাদুর পেতে খালি গায়ে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রাপ্রিয় বাঙালির জন্য এ অবস্থা একটি উপদ্রব বিশেষ, তবে সময় এলে সে বাঙালি যে সবার আগে রুখে দাঁড়ায়, সেটিও তো ইতিহাসে লেখা আছে। কোভিড-১৯ নামের এ উপদ্রবকে হটাতে বাঙালি যে মাস্ক মুখে রুখে দাঁড়াবে, সেটি নিশ্চয় অলীক কল্পনা নয়।