যেভাবে উদ্ধার হলো সৈয়দ হকের উপন্যাস

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণবার্ষিকী ২৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিনই প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোবে ৫৯ বছর ধরে অগ্রন্থিত সৈয়দ হকের উপন্যাস যেকোনো দরজা। এত দিন পর কীভাবে উদ্ধার হলো এই উপন্যাস? প্রয়াণবার্ষিকী সামনে রেখে সেই গল্প জানা যাবে এই লেখায়।

সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫–২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)
ছবি: অন্য আলো

এ যেন অনেকটা সোনার খনি আবিষ্কারের মতোই। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের যেকোনো দরজা শিরোনামের উপন্যাসটি পেয়ে যাই টুটাফুটা বিবর্ণ হলুদ পোকায় কাটা পাতায় গাজী শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত ঢাকা থেকে প্রকাশিত সচিত্র সন্ধানীর ১৯৬১ সালের জুন-জুলাই ষষ্ঠ বর্ষের প্রথম সংখ্যায়। মনে পড়ে, পত্রিকাটি আমি কিনেছিলাম বিজয়নগরের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে। সচিত্র সন্ধানীর মতো এ রকম শত শত পুরোনো বই–পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন কিনে নিজের ঘরদোর আমি ভরে রেখেছি।

বিভিন্ন পত্রিকা নিয়ে অর্ধশত বর্ষের বেশি সময় ধরে যে সংগ্রহভান্ডার আমি গড়ে তুলেছি, সৈয়দ হকের এই উপন্যাস সেসবের মধ্যেই ছিল লুকিয়ে। করোনা সংক্রমিত দুঃসময়ে সেসব সংরক্ষিত ভান্ডার নাড়াচাড়া করতে গিয়েই পেয়ে গেলাম সৈয়দ হকের যেকোনো দরজা। সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত এ উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছিল মনোহর অলংকরণ। তবে এত দিন পর শিল্পীর নামটি আর খুঁজে পাওয়া গেল না। অনুসন্ধানে জানা গেল, সৈয়দ হকের এই উপন্যাস দীর্ঘকাল ধরে অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। ফলে এর পরতে পরতে রয়েছে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের শহর ঢাকা, বুড়িগঙ্গা নদী, হোটেল, গোপীবাগ, জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) ইত্যাদি প্রসঙ্গ।

সৈয়দ শামসুল হক আমার প্রিয় লেখকদের একজন। সেই হাইস্কুল থেকে পড়ার সময় সাপ্তাহিক চিত্রালী মারফত তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয়। পরে তো তাঁর রোকেয়ার মুখ, খেলারাম খেলে যা, নূরুলদীনের সারাজীবন এবং আরও অনেক গল্প–উপন্যাস–কবিতা–চলচ্চিত্র–গান–কাব্যনাট্য পড়েছি এবং দেখেছিও।

সৈয়দ হকের লেখা পেলেই গোগ্রাসে পড়ি। একবার পুরোনা চিত্রালী (১৯৬৪) থেকে তাঁর উপন্যাস আনারকলি পড়ে জানতে পারলাম যে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। বিষয়টি তাঁর স্ত্রী সুসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হককে জানালে, তিনি তা প্রথমা প্রকাশন থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন, এটা ২০১৮ সালের কথা।

তো যেকোনো দরজা উপন্যাসটিও সচিত্র সন্ধানীতে দেখার পর বিষয়টি আনোয়ারা সৈয়দ হককে জানাই। তিনি বলেন, ‘ওই কুকুর নিয়ে গবেষণা এবং কুকুর হত্যার প্রতিবাদের ওপর লেখা উপন্যাসটি আমি পড়েছিলাম। তবে তা খুঁজে পাইনি। ভাই, দ্রুত আমার কাছে ফটোকপি পাঠালে ভালো হয়।’

অতঃপর বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর আলতাফ শাহনেওয়াজ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন; এবং তাঁকে আমি উপন্যাসটির ফটোকপি সরবরাহ করি। এভাবেই এটি প্রথমার দুয়ারে পৌঁছায়।

যেকোনো দরজার প্রচ্ছদ

যেকোনো দরজার কেন্দ্রে রয়েছে রেঙ্গুন থেকে ঢাকায় আসা ভাগ্যবিড়ম্বিত বেকার তরুণ জামাল। ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে সালমার। সালমার সহায়তায় জামাল চাকরি পায় ধনাঢ্য ঠিকাদার বিপত্নীক সালাহউদ্দিন চৌধুরীর ফার্মে। সালাহউদ্দিন অদ্ভুত চরিত্র ও মানসিকতার মানুষ। সে জামালকে ‘মৌলিক চিন্তা’ করার প্ররোচনা দেয় এবং তাকে কুকুর নিয়ে গবেষণা করার কাজ দেয়। এ জন্য তাকে প্রতি মাসে সাড়ে ৩০০ টাকা বেতন দেওয়া হয়। এই দুই চরিত্রের সঙ্গে আরও দুটি প্রধান চরিত্র সালমা ও খালেদের জীবনসংগ্রামের প্রসঙ্গও রয়েছে উপন্যাসে।

যেকোনো দরজা সৈয়দ শামসুল হকের অভিনব কুকুরনিধন, তথা পশুর প্রাণসংহারবিরোধী এক নান্দনিক উপন্যাস। এটি আবর্তিত হয়েছে জামাল নামের এক বেকার তরুণ ও সালাহউদ্দিন চৌধুরী নামের একজন ঠিকাদারের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সালাহউদ্দিন জামালকে ‘কুকুর নিয়ে গবেষণা এবং কুকুর নিধনবিরোধী’ মৌলিক চিন্তাবিষয়ক তার বক্তৃতা–ধ্যানধারণা–ডিকটেশন বা নোট সাজিয়ে–গুছিয়ে পুনর্লিখন করতে বলে। এ জন্য তাকে প্রতি মাসে ৩৫০ টাকা বেতন দেওয়া হয়। এই দুই চরিত্রের সঙ্গে আরও দুটি প্রধান চরিত্র সালমা ও খালেদের জীবনসংগ্রামের প্রসঙ্গও রয়েছে উপন্যাসে।

শেষ পর্যন্ত যেকোনো দরজার প্রধান উপজীব্য মানুষ। এখানে আছে মানুষের মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলার প্রসঙ্গ। কাব্যিক ভাষায় এবং নানা রূপক ব্যবহারের মাধ্যমে এতে এসেছে একের পর এক দৃশ্যাবলি। এই উপন্যাস পাঠের পর প্রাণজগতের দরজা সংরক্ষণ করা হবে বলেই বিশ্বাস। উপন্যাসের চরিত্র সালাহউদ্দিন চৌধুরীর ভাষায়: ‘আমি বলব—পশু হচ্ছে প্রাণ, যেমন এ প্রাণ আমার; বলব—পশু হচ্ছে অস্তিত্ব, যেমন এ অস্তিত্ব আমার।’

উপন্যাসটি সৈয়দ হকের অন্য রকম এক গদ্যভঙ্গিকে উন্মোচন করবে।