
আমি আমাকে বহুবার বিপদে পড়তে দেখেছি, কিন্তু প্রিয় পৃথিবীকে? এই প্রথম। জীবনে এই প্রথম দেখছি ধীরে ধীরে কেমন অচেনা হয়ে উঠছে চিরচেনা শহর, প্রিয় পথ, নগর, বন্দর। এমনকি খুব চেনা মানুষগুলো! তারাও কেমন জানি অপরিচিত, অচেনা। পাড়ার মোড়েও যাওয়া হয় না ইদানীং। ছোট হতে হতে পৃথিবী যেন আজ আরও ছোট হয়ে গেছে। একটা জানালা, ছোট্ট বারান্দা, ডাইনিং, ড্রইং; ব্যস, এই নিয়েই চলে যাচ্ছে অন্য সবার মতো আমারও লকডাউন জীবন। আজ মানুষের চোখে মানুষের সন্দেহের দৃষ্টি। এত দিন যাদের সাথে বেরিয়েছি, কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছি, হাত মিলিয়েছি, আজ তাদের আলিঙ্গনে যেতেও ভয় লাগে। ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে আত্মা অজানা আতঙ্কে। অদৃশ্য ভাইরাস মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি করে মানুষকে বানিয়েছে জীবন্ত লাশ।
লাখ লাখ মানুষ আজ করোনার ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। হাজার হাজার প্রাণহানি। লাশের সারি। লাশ পড়ে থাকছে রাস্তায়, ছুঁয়ে দেখারও কেউ নেই। আপন স্বজনও পালিয়ে যাচ্ছে অসুস্থ মানুষকে ফেলে। হাসপাতালের করিডরে পড়ে আছে লাশ। যারা বেঁচে আছে, তারাও লাশের মতোই, মৃত। পুরো পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ আজ আতঙ্কিত, দিশেহারা। অথচ, কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না ভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণ। এক পৃথিবী মানুষ আজ পাগলপ্রায়। সবচেয়ে সাহসীরাও আজ ভীত, আতঙ্কিত। বিধ্বংসী আণবিক শক্তি, রণতরী তুচ্ছ এখানে। আত্মসমর্পণ ছাড়া আসলে আর উপায় নেই। যদিও এটা কঠিন, তবু পরিবার, সমাজ, দেশের কথা ভেবে নিজেকে আড়াল করে রেখেছি ঘরে, অন্য সবার মতো। যদিও এখনো পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি লকডাউনে।

এত সব খারাপ খবরের পরও আনমনে বলে উঠি, বাহ্! পৃথিবী কত সুন্দর! যখন টিভির পর্দায় দেখি সাগরের জল আজ ঘন নীল। নীল জলে নির্ভয়ে খেলা করছে ঝাঁকে ঝাঁকে ডলফিন, সৈকত সৈকতে কাঁকড়া কচ্ছপদের উৎসব, রাস্তায় রাস্তায় খেলা করছে হরিণ, পেঙ্গুইন, ভোঁদড়ের দল। চারপাশে নির্মল, ঝকঝকে, ধুলাহীন, ধোঁয়াহীন বাতাস। আনন্দে নেচে উঠছি অবচেতনে, মুহূর্তেই ভুলে যাচ্ছি বিপন্ন মানুষের কথা। মনে মনে ভাবছি, লকডাউন থেকে যদি ভালো কিছু হয়, হোক না। থাকুক না মানুষ কিছুদিন ঘরের ভেতর। অল্পক্ষণের জন্যে হলেও ভুলে যাই, মরে গেলে আমাকে শ্মশানে নেবার কেউ নাই!
ঘরের সামনে একচিলতে উঠান। উঠানের কোনায় বিদায়ী গাঁদা-ডালিয়া, লিচুর মুকুল, পেয়ারার ফুল, কচি মেহেদিপাতা, নতুন পাতায় ঢাকা মেহগনি-তেজপাতা। একপাশে লাউয়ের জাংলা। দুটো ডিম নিয়ে বসে থাকা মা ঘুঘু। দুপুর হয়নি তখনো, এখানেই জন্ম হলো একটি কবিতার—
‘ঈশ্বর হোক সবার’
তিনি তো তোমাদের একার ঈশ্বর নন।
তিনি হয়তো ডলফিনের আবেদন মঞ্জুর করেছেন—
তিনি হয়তো সাগরের মোনাজাত কবুল করেছেন—
তিনি হয়তো বনের প্রার্থনা মন দিয়ে শুনেছেন—
তিনি হয়তো পাহাড়ের দাবিগুলো যৌক্তিক ভেবেছেন—
তারাও হয়তো টিকে থাকার জন্য দুহাত বাড়িয়েছিল!
হয়তো তারাও বাঁচতে চেয়ে কেঁদেছিল রাতের পর রাত—
নইলে আজ আকাশ কেন হবে এত নীল!
নইলে পাখিরা কেন আজ মুখরিত হবে দূরন্ত কোলাহলে
তিনি তো মানুষের একার ঈশ্বর নন, আর
পৃথিবীও নয় তোমাদের একার
আমি তখন আলতো করে শেষ চুমুক দিচ্ছিলাম চায়ের কাপে।
বাবা বেঁচে নেই। মা অসুস্থ। আদর করে নাম রেখেছিলেন মিনার আর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বসুনীয়া পদবি নিয়ে বেশ কাটিয়ে দিলাম ১৯৬৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে অর্ধশতাব্দী।
হয়তো শীঘ্রই লকডাউন উঠে যাবে। আবার সবুজ হবে, আবার হেসে উঠবে, নতুন সকালে আবার কোলাহলে মুখরিত হবে আগামী, হয়তো আবার ফেরা হবে পুরোনো আড্ডায়। হয়তো ফেরাই হবে না! এ যুদ্ধে কে টিকে থাকবে, জানি না! তবে বলাই যায়, সবাই থাকব না। যারা থাকবে, সেই অবশিষ্ট মানুষের কাছে আমার অনুরোধ, কবিতায় বলা বার্তাটুকু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার, ‘পৃথিবীটা নয় মানুষের একার’ আর তারা যেন ক্যালেন্ডারে একটি মাসের নাম রাখে ‘লকডাউন মাস’।
২৭ মার্চ, ২০২০
[মিনার বসুনীয়া—জন্ম: ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯, পাইকপাড়া, কুড়িগ্রাম। পেশায় চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন কর্মকতা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নেই। একটি ভাঁজপত্র প্রকাশ করেছেন। জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং লিটলম্যাগে কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে জাতীয় কবিতা পরিষদ, বিভাগীয় শাখা রংপুরের সঙ্গে জড়িত।]