বন্ধু রচিত পঙ্ক্তিমালা

সারা দেশ থেকে এবার অনেকগুলো একুশের সংকলন বের করেছে বিভিন্ন স্থানের প্রথম আলো বন্ধুসভা। সে থেকে বেশ কয়েকটি কবিতা বন্ধুসভার এ সংখ্যায় উপস্থাপন করা হলো
সরলতার জীবন
ওসমান সজীব
জীবনটা বড় বেরসিক
ঝড় তুফান বন্যায় কিংবা কান্না ভেসে যাওয়া
শকুনের ঘোরাফেরা সারি সারি লাশে
গতিময় পৃথিবীর আহত ঘটনা।
জড়তায় ফুল ফোটা
শৈশবে শুলে ওঠা এটা কি বিড়াম্বনা
নাকি অর্থপূর্ণ
ইঙ্গিত কাব্যিক সার্থকতা?
চাহিদার পাগলামির শুরু
জন্মতে। বাসনার অবসান মৃত্যুতে।
রহস্যের
কতটা গভীরে আছে জীবনের সমাধান?
জীবন ধর্ম জানার আগে
এ কেমন অন্তিম সমাধি?
বুলি, রংপুর
তারপর
সৈয়দ মেহেদী হাসান
আস্ত একটা নোটের মতো নিজেকে নিয়ে ঘুরছি দোকানে-দোকানে
ভাঙতি চাই, কেউ একবার হাতে নিল,
উল্টেপাল্টে দেখল অনেকে;
বলল: ভাঙতি নেই।
মধুর উন্মাদ অনুভূতি জমা না দিয়ে
খুচরা পয়সার বিপরীতে আস্ত নোট
খরচা হয়ে যায়-হিসাবের খাতা না কিনেই
যখন বাড়ি ফেরে ছাদ ভরতি কথাবার্তা
প্যারাকেমিস্ট্রি নিয়ে ঘোরে বনেদি বনসাই
আর আমার কবিতার খাতায় তখন বাড়তে থাকে গভীর রাত,
একটু শীত লাগোয়া বারো মাস-
পৃষ্ঠা ওল্টানোর আগেই জানিয়ে দেয়
চেনা চেনা মুহূর্তরা ছুটিতে গেছে।
উন্মেষ, বরগুনা
ভালো থেকো
অহেদুল ইসলাম
ভালো থেকো শৈশব, মধুমাখা দিন
ভালো থেকো অল্পতে, সুখ সীমাহীন!
ভালো থেকো কড়া রোদ, মায়ের শাসন
ভালো থেকো ডাল ভাত, মাটির বাসন!
ভালো থেকো বান্ধবী, পাশের বাড়ি
ভালো থেকো অভিমান, তোর সাথে আড়ি!
ভালো থেকো ছোটবেলা, পুতুলের বিয়ে
ভালো থেকো রূপকথা, কল্পনা নিয়ে!
ভালো থেকো কানামাছি, লুকোচুরি খেলা
ভালো থেকো পার্বন, বৈশাখী মেলা!
ভালো থেকো বিটিভি, সাদা-কালো ছবি!
ভালো থেকো কবরী, সুচরিতা, ববি!
ভালো থেকো ছড়া গান, নজরুল, রবি!
ভালো থেকো উপদেশ, ‘খুব বড় হবি’!
ভালো থেকো ছোট নদী, ভালো থেকো ভেলা
ভালো থেকো পুকুরে, ডুবোডুবি খেলা!
দক্ষিণডিহি, খুলনা
টীকাভাষ্য
এহসানহাবীব
প্রতিদিন ভোরে নিয়ম করে একবার আয়নার সামনে বসি। যত্ন করে
দেখি দাড়ি কতটা পেকে উঠেছে। গত দিন কোথায় কোথায় লেপ্টে গেছে
গ্লানি। কালিমা কেমন করে লেগে রয়েছে মুখের ভাঁজে? ঠোঁটের কোন
কোনায় লাগিয়ে রেখেছি দাসত্বের প্রলেপ? যত্ন করেই দেখি, দেখতে
হয়-কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে কর্মদিবস।
মুখে খুব নরম করে মাখি সেভিং ক্রিম-প্রতিদিন ভোরে। আয়নায় বসে
আমি কাটি-আমার দুঃখ, গ্লানি।
ব্রহ্মপুত্র, ময়মনসিংহ
একের পর এক
মাহ্ফুজ সরকার
শহরের বিস্তীর্ণ শয্যায়
মেঘের খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে বৃষ্টির করুণ হৃদয়।
রাত ডেকে দিচ্ছে পাতার রং, শহরের অবয়ব,
ঘোলাটে জলে একা লড়াই করে যাচ্ছে বিদ্রোহী চাঁদ।
দুর্বিপাকে বাঁধতে চায় কবির স্বেচ্ছাচারী মন।
অথচ, বারবার চোখের আড়ালে চোখ হারাচ্ছে
শহরময় একি আলোড়ন
যেন বাকি সব শহর ছেড়ে নির্বাসনে গেছে
পেছনে ফিরে যাচ্ছে এ জন্মের প্রথম প্রেমিকার
সাদা বারান্দা, খোপে বসে থাকা বৃষ্টিভেজা ঘুঘু।
এতটা কবিতা লুকিয়ে আছে,
যেন ভেসে ভেসে যাচ্ছে পঙ্ক্তি।
কবি অসহায়, অসহায় কবি
ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মাটিতে
অথচ একের পর এক পঙ্ক্তি শুধু ভেসেই যাচ্ছে।
সারথি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কবিতাটা নেবে
মিথুন দাস
তোমাকে একটা বিকেলই দিই বরং
এলোমেলো শেষ রোদ, নিরুত্তাপ হাওয়া
আর ঘুরঘুর করা এই প্রজাতির মন
ছোটাছুটি করা ওই কবিতাটা নেবে?
অথবা মনে করো বিকেলের ঘুম
চোখের তারায় নাচা রাজপুত্তুর মন
অকৃত্রিম স্বপ্নটা দিয়ে দিই যদি
রাজকন্যাখচিত ওই কবিতাটা নেবে?
ধরো তুমুল শৈশবের কুঁড়েঘর পাঠশালা
ছন্দে কুড়ানো সেই নামতার গান
‘দু একে দুই’, ‘দু দুগুণে চার’ যদি দিই
মনপ্রাণ দোল খাওয়া কবিতাটা নেবে?
কিংবা ধরো ধুলোর মেঠোপথ
সুপারির খোল চেপে নৌকাভ্রমণ
আদিম সুখসব দিয়ে যদি দিই
তারুণ্যখচিত ওই কবিতাটা নেবে?
ধরো ফুল হাতে দাঁড়ানো মিছিলের পথ
স্লোগানে স্লোগানে সব অধিকারের গান
প্রাপ্তির সবটুকু দিয়ে দিই তবে
করতালি মুখরিত কবিতাটা নেবে?
করচ, সিলেট
ফিরে যাচ্ছি
আহমেদ মুনির
পুড়েঅঙ্গার হওয়া শরীর
কাঁধে নিয়ে আমি ঘুরছি
গ্রাম-গ্রামান্তরে।
আমার কাঁধে কয়লার স্তূপ
শরীর ভেঙে পড়তে চায়
তবু হেঁটে যাই কারণ
এ কয়লা আমার সন্তান
এ কয়লা আমার ভাই
এই কয়লা আমার পিতা
এ কয়লা আমার বোন
বন্ধু পড়শি।
আমিও কয়লা হব কাল
তার আগে এই পোড়া দেহগুলো নিয়ে
গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে
আমি তাই হাঁটছি
নরম রসে ভেজা মাটির খোঁজে
যেখানে বৃষ্টির জল জমে আছে এখনো
মাথা তুলেছে নরম ঘাস
রক্তের ছিটে পড়ে কালচে হয়নি
যার রং
তেমনি জমিনে অন্তত
একখণ্ড কবরের আশ্রয়
আজ বড় প্রয়োজন।
সন্তরণ, চট্টগ্রাম
জলসেবিকা
তুহিন দাস
চুলের পাশে মায়াবী শীতকাল শুধু ভোরের গন্ধ মেখে
জলরং টুকে যায়, তাই কিছু গোপনতা এ ঋতুতে অপ্রকাশিত থাকে,
ডায়েরিতে আঁকা বুকপকেট আর একটি স্থির ঝরাপাতার ছবি
তবুও কেমন প্রকাশ করে নিজস্ব কোনো দূরের পথে যাওয়ার তীব্র সংবাদ
এইসব ভাবনার পাশে মৃদু গোলাপি রুমাল হাওয়ায় দোলে,
আয়না সাজায় আলোকস্তম্ভের খানেক সাজ, ব্যক্তিগত ধোঁয়ালাগা প্রহর-
অগণন বুদ্বুদের নিচে স্বপ্ন বেঁচে চলা মানুষেরা ঘুমোয়
নদীকথা, মৌলভীবাজার
বৈভব
শামীম আকতার
নরম নরম সুখগুলো ইচ্ছে হয়ে উড়ে সোনালি পালকে
চাঁদের অবিশ্রান্ত বর্ষণে হাঁটি তুমি আমি
আমাদের নিদ্রাহীন মধ্যরাতে।
তোমার চোখে জলা নক্ষত্র নীলিমায়
কৃষ্ণচূড়া বর পলাশের ঘ্রাণ
ফাগুনের বৈভব ফোটে প্রভাতফেরিতে
বর্ণমালার সূর্যোদয়ে।
অমোঘ পরিতৃপ্তিতে মুছে যায়
জীবনের কান্তি শ্রান্তিগুলো
স্বাধীনতার রোদেলা সাঁকোয়
স্বপ্নের ক্রমাগত জনন কবিতায়।
আজ এক সলতে আগুন জ্বলে
দ্রোহের মননে
ক্ষিপ্রতায় দীপ্ত প্রত্যয় জাগে
একুশের প্রতি ভোরে।
চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে গেঁথে ঐ যন্ত্রনার্ত বোধে
শব্দের বুকে ভাসে স্বর্গীয় সুখ
‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’
সমুদ্রপত্র, কক্সবাজার
বসে আঁকো
মনিরা রহমান
তোমার রঙের বাক্সে
যে টকটকে রংটি রয়েছে
সেটিকে দাও তোমার ক্যানভাসের ভূমিতে প্রথমে
তারপর দাও চড়া সবুজ রং
এরপর দাও খানিকটা ফিকে সবুজ
উপরে দাও স্বচ্ছ নীল
ঝকঝক করতে থাকুক আকাশটা
বইয়ে দাও জলের রং সবুজের ফাঁকে ফাঁকে
এইবার সবুজের মাঝে মাঝে
পোঁচ দাও কিছু সোনালির
নিচের পাড়ের দিকে দিও
নীল আর গভীর জল।
ভুলোনা বাদামি বর্ণের মানুষগুলোকে
আর তাদের কালো চোখ
আকাশে দিও পাখির ঝাঁক
আকাশের সামান্য নিচে
গাঢ় সবুজ পাহাড়
হয়ে গেল ছবি
হয়ে গেল বাংলাদেশ
বরেন্দ্রবরণ, রাজশাহী
অপেক্ষায়
আশীক রহমান
অপেক্ষায় থাকি। কোনো কিছু ঘটবে হয়তো;
অপেক্ষায় থাকি! হয়তো অভাবনীয় কিছু
ঘটে যাবে আগামীকাল সকালে কিংবা
তারপরের কোনো দিন, কোনো সময়ে!
অপেক্ষাই প্রধান কাজ এখন। কবে যে
কি ঘটে যায়! যদি চোখছাড়া হয়ে যায়
চকিতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা, হাতছাড়া
হয়ে যায় ঘটে যাওয়া ঘটনার ফল-
অধৈর্যহেতু অনেক কিছুই চলে গেছে চোখের আড়ালে,
আওতার বাইরে। এখন জানি-সবুরে মেওয়া ফলে।
তাই অপেক্ষা। এখনো ঘটে নাই-তাই বলে
ঘটবে না কিছু কী করে বলি! যেকোনো সময়েই
ঘটে যেতে পারে অভূতপূর্ব কিছু-অশ্রুতপূর্ব কিছু!
উদ্যম, নাটোর