মাসুদ খানের কবিতা

মাসুদ খান। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
মাসুদ খান। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
সেই কবে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পাখিতীর্থদিনে’-তে কবি মাসুদ খান লিখেছিলেন, ‘আজ এক রুগ্ণ অগ্নিকুণ্ডের কিনারে বসে আছি জবুথবু, চারদিকে চলমান সার্কারামা, ছবিগুলি খুব দ্রুত নাচতে নাচতে আসে আর যায়।’ গেল শতকের আশির দশকের আবির্ভাবকাল থেকেই কবিতাকে নতুন সুরে বাঁধতে চেয়েছেন এই কবি। কবিতার ছত্রে ছত্রে লিখেছেন রূপকাহিনির মতো কাঁপা কাঁপা পঙ্ক্তিমালা, যেখানে সার্কারামা আর সরাইখানা মিলেমিশে একাকার। বাংলা কবিতার গীতিধর্মিতার সঙ্গে বিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয়-আশয়ের মিশেলে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের স্বতন্ত্র প্রদেশ, অনন্য এক কাব্যভাষা। এ অব্দি সাতটি কবিতার বই বেরিয়েছে তাঁর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘প্রসন্ন দ্বীপদেশ’ অর্জন করেছে প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার। অন্য আলো অনলাইনের নতুন আয়োজন ‘এ মাসের কবি’তে আজ থাকছে মাসুদ খানের কবিতা।


মিসিং লিংক

কালোবাজারের মর্মস্থলে বসে এতকাল
চালান করেছ দারুচিনি, ভাবাবেগ...সীমান্তের এপার-ওপার।
আজ দেখি আনাগোনা
না-কালো, না-শাদা এই হৃদগন্ধা ধূসরবাজারে!

এই তো এখন চারপাশ থেকে
কানে ভেসে আসছে বকুলের গন্ধধ্বনি
নাকের ঝিল্লিতে ঝাপসা ধাক্কা খাচ্ছে
ব্রতবদ্ধ ব্যস্ত মৌমাছির বিবিধ গুঞ্জনগন্ধ।
আর কিছুক্ষণ পরে ঝোপের আড়াল থেকে
ঢুলুঢুলু চোখে তাকাবে বহুচক্ষু আনারস
তার চূড়ায় চড়ে-বসা এক মাথাগরম গিরগিটি
চেরা জিভ বাড়িয়ে দিয়ে মাপতে থাকবে
টিপটিপ রোদের সুর, ছন্নমতি খেয়ালি হাওয়ার গতি।
রূপসী আকন্দ ফুল, অভিনয়পটু, সখিদল নিয়ে ছিনালি-আনন্দে
মান ভাঙাবে তিরিক্ষিমেজাজ কিছু বিছুটিপাতার।

এইবার মেলাও তো দেখি হে গুনিন
ওপরের দুই স্তবকের মধ্যকার মিসিং লিংক?

তদন্ত

কী ঘটেছে ওইখানে, ওই ছায়াপথে,
রাতের আকাশে ফুটে-ওঠা
ওই চেরি-ব্লসমের পুষ্পসমাবেশে?

যেন এক মহাজাগতিক অপরাধপট,
তদন্ত চলছে, নেমে পড়ছে বাঘা-বাঘা সব
জ্যোতির্গোয়েন্দা ও মহাকাশীয় পুলিশ
খোঁজা হচ্ছে ক্লু, মোটিভ, সাবুদ, সাক্ষী ও অ্যালিবাই...

ওই যে ওখানে একটি তারা ছিল,
লাপাত্তা হঠাৎ। মেরে ফেলেছে কি কেউ?
কোথায়ই-বা লুকাল সে-ডেডবডি?

হঠাৎ হাউৎ করে ডুকরে-ওঠা, গায়ে-হিম-ধরানো কসমিক কান্না...

আর কারাই-বা, কোন ধীর বিষপ্রক্রিয়ায়,
আস্তে আস্তে হনন করছে প্রিয় এই গ্যালাক্সিকে!

দীর্ঘ তদন্তের পর জানা গেল—
ওই যে আবর্তমান তারা-জ্বলা কসমিক চাকতি,
কল্পনাকেও ক্লান্ত-করে-ফেলা ওই মহাকায় যমজাঙাল,
মর্মদেশে বসে আছে তার
সে-এক ভাবগম্ভীর, রাশভারী, ঘনীভূত কালামামা।

এই সব নাকি তারই কাজ।

ফাতনা

সরল ছিপের এক প্রান্তে মাছশিকারি, চুপচাপ,
অন্য প্রান্তে মাছ।

মাঝখানে নিরীহ ফাতনা—ভাসে নিরুপায়, মধ্যপক্ষরূপে
তাকায় চঞ্চল শিকারের দিকে একবার, পরক্ষণেই চতুর শিকারির প্রতি।

জগতের প্রত্যেকটি ঘটনার তীব্র, তুঙ্গ মুহূর্তে হাজির থাকে
তৃতীয় একটি পক্ষ। থাকে এক সুদর্শন মাছরাঙা—
বড়শির বিবেকের মতো বাঁকা, রঙিন, আকর্ষণীয়।

আর এই সমস্ত কিছুর মৌনী মধ্যস্থতা আকারে ভাসতে থাকে
একা এক শোলার ফাতনা।

স্বভাব

শ্রেয়তে বিরাগ যথারীতি,
অনুরাগ হেয়তে আমার।
অব্যাপারে আগ্রহ অধিক, যথাব্যাপারে সন্ন্যাস।
অকাজে উদ্ব্যস্ত।

বারবার আড়াল হয়ে দাঁড়ায় এক বেঢপ পাহাড়।
পাহাড় ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে তাই
হেলান দিয়ে রেখেছি দিকচক্রবালে,
গোল হয়ে নেমে আসা আকাশের গায়ে।

এদিকে তারার ভস্মে ভরে যায় খরখরে গিরিপথ।


অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]