মুক্তিযুদ্ধের সহমর্মী তিনটি উর্দু কবিতা

ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে উর্দু কাব্যে মীর, গালিব আর ইকবালের ধারাবাহিকতায় বড়মাপের কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক। ১৯৭১ সালে শাসকদের পক্ষ থেকে ফয়েজের ওপর ভয়ানক চাপ এসেছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের মনোবল বাড়ানোর জন্য গীতিকবিতা লেখার জন্য। ফয়েজ এবার লাহোর ছেড়ে দেশের ভেতরে অজ্ঞাতবাস নিয়েছিলেন। কবিতা লেখার মন্ত্র হিসেবে তিনি বলতেন, কান পেতে শোনো হৃদয় কী বলে! হৃদয়ের কথা শুনতে তিনি ভুল করেননি। তিনি কবিতা লিখেছেন খুব কম। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে লিখেছিলেন দুটি কবিতা, যার একটি লেখা হয়েছিল মার্চ ১৯৭১ এবং আরেকটি ১৯৭৩ সালে। দুটি কবিতাই বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালির পক্ষে কবিদের মধ্যে অ্যালান গিনসবার্গ আর ফয়েজ সবচেয়ে আলোচিত। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে লেখা হয়েছে আরও কবিতা—যুদ্ধ চলাকালেই। সেই কবিতাগুলো অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত। এখানে তিনটি কবিতার মধ্যে দুটি কবিতা এর আগে বাংলায় অনূদিত হওয়ার হদিস পাওয়া যায়নি।

ফয়েজের ধারাবাহিকতায় এসেছিলেন সাহির লুধিয়ানভি (১৯১৯—২০০২)। সাহির বোম্বে (এখন মুম্বাই) সিনেমাজগতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় গীতিকার। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের লাহোরে ছিলেন তিনি। তাঁর কবিতার বই তলখিয়াঁ মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে তাঁকে ভারতজুড়ে বিখ্যাত করেছিল। ছিলেন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ১৯৪৯ সালে খোলা আসরে পাঠ করেন কবিতা, ‘আওয়াজে আদম’, মানে মানুষের ডাক। সেই কবিতায় ছিল পাকিস্তানে সাম্যবাদী বিপ্লবের ডাক। এরপর তিনি এসে পড়েন বোম্বেতে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বিপক্ষে তিনি লেখেন কবিতা, ‘এয় শরিফ ইনসানোঁ’। প্রবল যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের কারণে সে সময় ভারতে সমালোচিত হলেন তিনি। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশিদের পক্ষে তিনি যে কবিতা লিখলেন, সেখানে তিনি খোলাখুলি যুদ্ধের পক্ষে।

কাইফি আজমি (১৯১৯—২০০২) উর্দুর প্রগতিশীল ধারার অন্যতম কবি। উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে জন্ম। তিনিও বোম্বে সিনেমার গীতিকার ছিলেন। সেই আয়ের টাকায় পার্টি কমিউনে থাকতেন আর শ্রমিক রাজনীতি করতেন। বিপ্লবী রাজনীতির দায়ে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। এর পঞ্চান্ন বছর পর সেই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট প্রদান করে। ভারতের হায়দরাবাদ থেকে ১৯৭১ সালের জুন মাসে একটি পত্রিকা ছাপা হয়, নাম র​্যাহনুমায়ে বাংলাদেশ। মানে ‘বাংলাদেশের পথপ্রদর্শক’। প্রকাশনাটি দেখলে বোঝা যায় বাংলাদেশ নিয়ে একটি মুশায়রা অর্থাৎ কবিতার আসরের অয়োজন করা হয়েছিল। সেই মুশায়রায় পাঠ করা কবিতাগুলোর সংকলন এই প্রকাশনা। এতে কাইফি আজমির কবিতাটি পাওয়া গেছে।

১৯৩৬ সালে ভারতের হায়দরাবাদে জন্ম নেওয়া জেহরা নিগাহ উর্দু ভাষার জীবিত কবিদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে নারীবাদী কবি বলে ডাকা হলেও তিনি কোনো ছাপমারা কবি হিসেবে পরিচিত হতে আগ্রহী নন। তিনি নারীর চোখ দিয়ে তাঁর চারপাশের বিশ্বকে দেখেন। তবে এ কথা বলতে ভোলেন না যে এই দেখার বিষয়গুলো শুধু নারীর উদ্বেগের বিষয় নয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে নারীসুলভ চিত্র ও বাগ্​ধারা ব্যবহার করেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের ওপর নির্যাতন নিয়ে তাঁর লেখা কবিতা ‘ভেজো নবীজি র​্যাহমাতেঁ’। কবিতাটি গীতিমূলক, বেদনাতাড়িত কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সূক্ষ্ম।

বাংলাদেশ

কাইফি আজমি

আগুনে পোড়াবে আমাকে সে দেশ নই আমি

দেয়াল নই যে মিশিয়ে দেবে ধুলায়

কোনো সীমান্তও নই যে নিশ্চিহ্ন করে দেবে

এই পৃথিবীর পুরোনো মানচিত্র

বিছিয়ে রেখেছ মেঝেতে তুমি

এলোমেলো রেখা ছাড়া তাতে নেই কিছু আর

মাকে সেখানে কোথায় খুঁজে পাবে

আমি খ্যাপা এক মানুষের বাসনা


আমি এক দুর্বারপ্রাণ স্বপ্ন

পদদলিত মানুষের

মানুষ যখন পান করে রক্ত মানুষের

শোষণ যখন ছাড়িয়ে যায় সীমা

নিপীড়ন অসহ্য হয়ে যায়

তখন হঠাৎ আমাকে দেখা যায় কোনো কোণে

হঠাৎ বের হয়ে আসি কারও বুক ফুঁড়ে

আজকের আগেও কোথাও তুমি দেখেছ আমায়

কখনো পুবে, কখনো পশ্চিমে

কখনো শহরে, কখনো গ্রামে

কখনো বসতি, কখনোবা অরণ্যে


আমার ইতিহাসই ইতিহাস

কোনো ভূগোল নেই আমার

আর আমার ইতিহাস

নিষিদ্ধ যার পাঠ

মানুষ গোপনে করে সেই পাঠ

কখনো বিজয়ী, কখনো পরাজিত আমি

কখনো নিজের ঘাতকদের শূলে চড়িয়েছি

নিজেই কখনো চড়েছি শূলে

তফাত এই—ঘাতকেরা মরে যায়

আমার মরণ নেই

আমি পারি না মরতে


কোন হাতে পরাবে শিকল বলো

আমার যে সাত কোটি জোড়া হাত

কোন মাথা আমার করবে ছিন্ন

আমার ঘাড়ে সাত কোটি মাথা


কত অবুঝ তুমি

ভিক্ষায় পাওয়া ট্যাংক নিয়ে

এসেছ আমার হৃদয় কাঁপিয়ে দিতে

রাতদিন ফেলছ বোমা

একদিন নিজেই ক্লান্ত হয়ে যাবে

আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি

সাহির লুধিয়ানভি

আমরা শান্তি চাই কিন্তু নির্যাতনের বিরুদ্ধে

যদি যুদ্ধ করতে হয় তবে তাই সই

নির্যাতককে যে বাধা না দিল সে শামিল জুলুমে

ঘাতককে যে দিল না বাধা সে সঙ্গে ঘাতকের

আমরা উঠেছি ভয় ফেলে যেন ন্যায় পায় জয়

বলে দাও যারা মিথ্যার ফৌজের সাথে আছে

যদি শক্তি প্রয়োগ হয় তবে এই ধরনই সই

নির্যাতকের নেই জাত, নেই ধর্ম, নেই কোনো জাতি

নির্যাতকের ঠোঁটে এসব নাম আসাও অন্যায়

এই মাটিতে নিষ্ঠুরতার ডালে ফলে না ফল

ইতিহাস জানে এই কাল আছে সাক্ষী

কিছু জন্মান্ধের দৃষ্টি না হয় দেখতে নাই পেল

এ যুদ্ধ না সম্পদ না মাটির মালিকানার

এই যুদ্ধ জেনো বেঁচে থাকার জন্য লড়াই

এই যে রক্ত দিয়েছি মাটিকে নৈবেদ্য

সেই রক্ত দিয়েছি ফুল ফোটাব বলে

আসবে শান্তির ভোর না হয় সে রক্তে রাঙা হয়েই

ও নবীজি রহম দাও

জেহরা নিগাহ

একটা ঘর ছিল, ছিল খোলা প্রান্তর

কিছু ফসলের মাঠ ফসল মাড়াইয়ের উঠান

চলতি সড়কও সঙ্গে ছিল

ঘরে তো সে একা ছিল না

চুলায় ছিল চড়ানো হাঁড়ি

মাখানো আটা ছিল তৈরি

দোলনায় শিশুও ছিল

খাঁচায় ছিল তোতা

তাকে রাখা ছিল কোরান

যার ওপরে তার বিশ্বাস ছিল

চুলোতে ফুঁ দিচ্ছিল সে

শিশুকে দিচ্ছিল প্রবোধ

তোতাকে শেখাচ্ছিল কথা

‘ও মিঠু, বলো—নবীজি বরকত দাও

ও নবীজি রহম দাও

হাসান হোসেনের দোহাই

হাসান হোসেনের দোহাই’

সেদিন হঠাৎ কী হলো

মানুষের মতো দেখতে এক পশু

ঢুকে পড়ল হঠাৎ ঘরে

সবকিছুকে ফেলল ছেয়ে

মাথা থেকে সরল ঘোমটা যখন টানে

কোরানের রেহেল পড়ল ঢাকা

তাওয়ায় রুটি গেল পুড়ে

জ্বলে গেল চুলার হাঁড়ি

শিশুর দোলনা পড়ল ছিঁড়ে

তোতা ছটফট করে করল চিৎকার

‘নবীজি বরকত দাও

ও নবীজি রহম দাও

হাসান হোসেনের দোহাই

হাসান হোসেনের দোহাই’

কিন্তু কেউ এল না

কেউ এল না