কার্তেসিয়ান সন্দেহের নীল ছায়া

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

কার্তেসিয়ান সন্দেহের নীল ছায়ায় একটি অন্ধ কাক

সমস্ত রাস্তা কি সত্যিই কোথাও পৌঁছায়? নাকি—বিভ্রমের মানচিত্রের ভিতর
দিয়ে হাঁটছি অনন্ত! যেখানে প্রতিটি গলিপথ কেবলই নিজের প্রতিফলনে...
ফিরে যায়। কার্তেসিয়ান সন্দেহের নীল ছায়ায় ঘড়িগুলো উল্টো দিকে হাঁটে—
সময় আসলেই আছে কি না, নাকি হেরাক্লিটাসের নদীর মতো, একই স্রোতে
দুবার দাঁড়াইনি।

বৃষ্টির ভিতর ভেসে থাকা অন্ধ কাক-ক্লান্ত ডানায় জমে আছে উপনিষদের শেষ
শ্লোক; যেন অদেখা কোনো সমুদ্র-আকাশের ভিতর থেকে লোনা ঢেউ পাঠিয়ে
দিচ্ছে গোপনে—পৃথিবীর প্রার্থনারত ফাঁকা হাতগুলোতে।

এক বৃদ্ধ ভিখারি শূন্য পকেট থেকে বের করে আনছে স্বপ্নবিভক্ত ভাঙা শঙ্খের
ভেজা নিশ্বাস, যা শুকিয়ে যায়—চোখ ফেলতেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটি
বলে, ‘তুমি নিশ্চিত তো—আমি আছি?’

জলের অন্ধকারে জমাট প্রতিধ্বনি

ভেলা মানেই গন্তব্য নয়—বেহুলার কপালে নদীর শেষ অশ্রু।
অর্ধেক দীর্ঘশ্বাস—জমাট প্রতিধ্বনি।
পড়ে যায় জল।
না, অন্ধকার।
(পার্থক্য কী?)
‘মানবী হও’—তৃষ্ণা বলে।
কিন্তু মানবী হওয়ার মানে কী? এই কংক্রিটের জঙ্গলে নাকি সেই
পুরানো জলে?
ভাসানের ভেলায় গোপন জোয়ার—
শুধু নিশ্বাসে।
(এমনকি নিশ্বাসও মিথ্যা হতে পারে)
ভাঁজ খুললে:
—অনুপস্থিতির গন্ধ
—পুরানো জ্বরের ঘাম
—কারও শরীরের ছায়া (কিন্তু কার?)
বেহুলা এখনো ভাসছে
লখিন্দর জেগে উঠবে কি না—সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মুখ থেকে মুছে ফেলা চেহারা

ওমের কম্পন—গুনগুনায় এয়ারকন্ডিশনার। ঘরের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস; হৃদয়—
বরফের নিচে। সোডিয়াম বাতির কমলা কুয়াশায় একটি নীল কুকুর—ঘেউ ঘেউ করে চাঁদের দিকে
তাকিয়ে। কিন্তু শব্দ বের হয় না। চাঁদ শুনতে পায়—নিচে নেমে এসে কুকুরের পাশে বসে।
ওভারটাইমের ঘণ্টা গুনতে গুনতে মনে পড়ে—রাজা যুধিষ্ঠিরের মিথ্যা। থেরাপিস্ট বলেছিল,
‘আপনার অন্তর্জগৎ একটি মেট্রো স্টেশন।’ ডায়েট চার্ট আর অরণ্যের পথ—কোথায় পার্থক্য? কারও
রেখে যাওয়া গন্ধ এখনো ইন্টেরিয়রের দেয়ালে লেগে আছে। স্টুডিও ফ্ল্যাটে বসে ভাবি, নার্সিসাসও কি
এভাবেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল?
আঙুল স্ক্রল করে যায়—অর্ফিউসের বীণার মতো। অ্যালগরিদম জানে কী চায় হৃদয়। রঙিন
বিজ্ঞাপনের পিক্সেলে লুকায়িত অসীমতা—যতই জুম করি, সব ভেঙে যায় দানাদার শূন্যতায়, তবু
মনে হয় হাত বাড়ালেই ঈশ্বর। চন্দ্রের মতো গোল হয়ে বসে আছি। কিন্তু আমার কোনো রাহু নেই।
সকাল। শেভিং ক্রিমের ফেনা। মুখ থেকে মুছে যায় গতকালের চেহারা—কিন্তু আয়না, একমাত্র
বিশ্বাসঘাতক, আমাকে প্রতিদিনই চিনে ফেলে।

অনুপস্থিতির জানালা

হাত দুটি মনে করতে পারে না কোন গাছের ডাল ছিল।
কিন্তু পাখিরা এখনো বসে আছে। উড়ে যাওয়ার ভান করে
মা কখনো বলেছিল: জল ভালোবাসে না, শুধু প্রবাহিত হয়।
কিন্তু এই নদী
থেমে আছে কেন?

রঙের নাম ভুলে যাওয়া ফুলেরা এখনো ফোটে
গন্ধ ছড়ায় স্মৃতির মতো—অস্পষ্ট, কিন্তু সত্যি।
স্ক্রিনের ভেতর থেকে স্পর্শ বেরিয়ে আসে—
চায় না কিছু, শুধু ছুঁতে চায়
এমন বৃষ্টি, যা কখনো পড়েনি।

একাকিত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার স্বপ্ন

...কিন্তু একাকিত্বের তো কোনো এক্সপায়ারি ডেট নেই।

ফার্ডিনান্ড দ্য সাউসুর ট্রাফিক জ্যামে বসে ভাবছে:
সিগনিফায়ার আর সিগনিফায়েডের মধ্যে দূরত্ব কতটা?
হর্ন বাজে।
অর্থ ভেঙে যায় হাজার টুকরোয়।
প্রতিটি টুকরো ভিন্ন ভাষায় কাঁদে।
‘আমি ভাবি, তাই আমি আছি।’ কিন্তু এটিএম মেশিন বলে:
‘ইনসাফিসিয়েন্ট ব্যালান্স’
তাহলে কি
আমি নেই?
রাতের শহরে নিয়ন লাইটগুলো হেরাক্লিটাসের নদী। একই
আলো, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞাপন। ‘কিনুন, কিনুন’—শুধু এই
স্রোতে, এই প্রবাহ।
আমার জানালায় চাঁদ দেখা যায় না।
শুধু
প্রতিবেশীর
টিভির নীল আলো।