আর্কাইভ থেকে
সচেতন অবচেতনা
ষড়্ঋতুর বাংলাদেশে আবার ফিরেছে বর্ষা। প্রকৃতি সেজেছে তার আপন রূপে। প্রায় ২৫ বছর আগে এমনই এক বর্ষায়, ১৪০৬ বঙ্গাব্দের ৯ আষাঢ় (২৩ জুন ২০০০) প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীর বর্ষা আয়োজনে ছিল কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের একগুচ্ছ কবিতা। ‘সচেতন অবচেতনা’ শীর্ষক বর্ষাবন্দনামূলক সেই গুচ্ছকবিতা অনলাইন পাঠকের জন্য প্রথমবার তুলে ধরা হলো।
আষাঢ়ে–শ্রাবণে
অগ্নি কি নিবেছে?
একনাগাড়ে কত দিন ধরে
বৃষ্টি চলেছে তো চলেছেই।
জ্যৈষ্ঠে শুরু। তারপর এই
সারাটা আষাঢ় মাস ধরে
বৃষ্টি হচ্ছে। সারা দিন–রাত।
আকাশে পিঙ্গল পর্দা টানা।
সূর্য নেই। মেঘেলা। ধূসর।
রাস্তায় রাস্তায় জলস্রোত।
দিনরাত্রি অঝোর ঝরন।
মনে হয়, কখনো দেখিনি
সূর্য কিংবা রৌদ্রের ঝলক।
জলধারা ভুবন ভাসায়, —
শুধু এক কণা অগ্নি জ্বলে
সব দৃষ্টি–শ্রুতির বাইরে।
বৃষ্টির শাবলে
(মুস্তফা আনোয়ার–কে)
বৃষ্টির শাবলে আর গাঁইতির চাড়ে
রাত্রির কালো খনি ধসে পড়তে থাকে।
দেখি আর মনে মনে বলি: শেখো–শেখো–
কী করে মেলাতে হয় স্বপ্ন–ও–সত্তাকে।
কিন্তু ভোরবেলাতেই ভুল হয়ে যায়;
বুঝতে পারি না, বৃষ্টি নাকি জ্যোৎস্না ঝরছে?
পুষ্পিতা যুবতী, নাকি জুঁইফুলগাছ?
বেঁচে আছি, নাকি ঢুকে পড়েছি স্বর্গে?
বাস্তবতা নিয়ে আজো খাই হিমশিম,
ঊনষাটেও দেখছি আজো কিছুই মেলে না:
নিসর্গ রহস্যময়: নারী অপ্রবেশ্য;
পৃথিবী আকাশে ঢাকা; মানুষ অচেনা।
রাত্রি একটার ঢাকা
রাত্রি একটার ঢাকা। বৃষ্টি হয়ে গেছে এই একটু আগে।
ভিজে কালো রাস্তায় লাল–নীল–হলুদ–পাটকিলে আলোর বাহার।
ফিরছিলাম আমরা দুজন–আমি আর আতাহার।
আকাশ কি মেঘে ঢাকা? কালো মেঘ–ছেঁড়া দু–চারটি তারা
সিল্কের মতন আকাশে জ্বলছে পুঁতির মতন।
এখনো বাতাসে ঠান্ডা, বৃষ্টি থামলো এই কিছুক্ষণ।
পৃথিবীতে এরকম রাত্রি আর আসেনি কখনো।
ময়ূরের মতো এতো বর্ণময়, এমন নীরব–কলস্বরা,
এতো শান্ত-গতিশীল, এতো সশরীরী অথচ অধরা।
আরে। বৃষ্টি ফের: শাদা পর্দা পড়ে গেল রাত্রির নাটকে।
ভিজে কালো রাস্তায় চমকাচ্ছে আকাশের যত তারা।
কোথাও উৎসব নেই, তবু বাজছে ধ্বনি–প্রতিধ্বনিময় সারা–রারা–রারা।
দিনগুলি মিথ্যা হল এরকম বৃষ্টি–বেঁধা রাত্রির ঝংকারে
কতো গ্রীষ্ম ধুয়ে গেল এবারের আষাঢ়ে–শ্রাবণে,
হে রাত্রি, বৃষ্টির রাত্রি, তুমি আজ ঝরছো গহনে।
রাত্রি আজ জেগে উঠলো প্রজ্জ্বলন্ত বৃষ্টির বিভায়,
মেঘে লুপ্ত হয়ে চাঁদ মিশে রইল আমাদের নগরে–বন্দরে,
চলো যাই উড়ে যাই কালো–নীল রাত্রির ভিতরে।
ঊনষাট বছর বয়সে
বহুক্ষণ বৃষ্টি থেমে গেছে।
এখন গাছের ডাল থেকে,
পাতা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে
জলবিন্দু। হিরের। রুপোর।
কে ডাকছে ডাক নাম ধরে?
এতো রাতে কে ডাকছে? কে? কে?
ভুল। কেউ নেই। কিছু নেই।
পথে পথে সোনার মোহর।