শুয়ে আছে ধুলো, সাঁতারের অপেক্ষায় জলবিন্দু

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ভাতঘুম

কলতলায় অযত্নে
ফুটে আছে ফুলের সৌষ্ঠব—

বারান্দায় নৈঃশব্দ্য
সারি সারি আধো অন্ধকার ঠেলে, শিরীষের ছায়ায়
যতটুকু আলো আসে—বাকি সব চুপচাপ।

পুকুরের অসীমে, শ্বাস নিবু নিবু হয়ে এলে
অবাক বিস্ময়ের লোভ সামলে ফেলি
ভেঙে ভেঙে পাথরের দূরত্ব, মুখ্যত পুনরায়
ফিরে যাওয়া শূন্যের কাছাকাছি—

সামান্য, অতিক্ষুদ্র বিনয়ের নিবেদনে
প্রণামের মতো আনত কষ্টবোধ
বিচ্ছিন্ন, ছিন্নবিচ্ছিন্নতার গল্প
উষ্ণ সর্বনাশের ভিড়ে—
মহোত্তম প্রেম ভেঙে যাওয়ার দুঃখকেও
স্বার্থপরতা মনে হয়—

দীর্ঘ সময় ধরে সন্ধ্যা নামবে, সলতের
তেল ভেজেনি এখনো—

আজ মাকে একটু বেশি ভাতঘুম ঘুমোতে দেব!

গ্রামের নাম রং

স্থির সাইকেলের উল্টো প্যাডেলে, নিষুপ্ত কুয়াশা নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে শীত, শৈশবের গন্ধ মেখে—

শুয়ে আছে ধুলো, সাঁতারের অপেক্ষায় জলবিন্দু
বিস্তর তেপান্তরের গল্প শেষে নিশ্চুপ বিকেল, কিছু
ছন্দ নিয়ে এখনো সন্ধ্যা নামায়
দূরের হাটুরেদের হাঁক, গ্রামের নাম রং—

খড়পোড়া গন্ধে গোয়ালের শান্তি, ধীরতম দৃশ্য
কলতলায় গন্ধরাজ, পুজোঘরে ধূপ
পাড়াশেষে বাড়িফেরা উচ্ছল চাঁদ, কিশোরী

অপ্রস্তুত চুমুর ঘোর, কেটে গেলে বিদ্যুৎস্পর্শ
যেমন ছিটকে যায় বোধ, আমিও খোপছাড়া বিবাগী—
বিচ্ছিন্নতার গোপন সূত্র খুঁজে খুঁজে হয়রান, নির্বাণ

আমার গ্রামের নাম রং।

বুড়ো শীতের ওম

ফিরতি ভিড়ের দিন গায়ে না মেখে
অদৃশ্য অহংকারে যে পথে হাঁটা যায়, তার
মাথায় মাথায় ভাঁটফুলের গান, আর
ক্ষীণচেনা বালিকার শেষ বড় হওয়ার উচ্ছ্বাস—

ভিউকার্ডের সন্ধ্যা
শশীমালতির গন্ধ
অলিখিত স্পর্শের গোপন—
সব অবলায় দিয়ে, সে থেমে গেছে যদিও
কলাগাছের চৌকো আর জরির উজ্জ্বল পরাধীনতায়।

তারপর চলে গেছে—ভিন্ন দূরগ্রামের সুখে।

এখন ধুলোর কাল, ঘনঘোর বাস্তবকাল
ঘুম নেই, রাতের আকাল—

বুড়ো শীতের শেষ রোদ নীরবে কুয়াশার মতো
ঘুমপাড়ানি মায়েদের গান, আর তাদের গায়ের ওম
গিলে খেয়ে লাল-কালো কুচবরন হয়ে ফুটে আছে!

গার্হস্থ্য

কোথাও খিলখিল হয়ে ফুটে আছে বিকেল।

ফুলের রেণু উড়ে উড়ে ক্লান্ত, রাতের অভিমুখী
সন্ধ্যার জংশন, ট্রেনের নাম জানি না;
অশ্রু লিখি না, ব্যর্থতা লিখি বরাবর
সংগীত পড়ে আছে, অবহেলায়। থাকুক—

মায়া কেটে গেলে যে মতন উড়ে যায়
শালিকের আনুগত্য, মানুষও স্নানের জল মোছার মতো
ভুলে যায় কৈশোর-সরলতা। মহামৃত্যুর পৃথিবীতে—
আর শোক নেই, মানুষ তো ক্ষমারই পুত্র!

পবিত্র ভয়, যা দিয়েছ দুই হাতে
গার্হস্থ্য, তোমায় প্রণাম করি।

কৃষ্ণচূড়া

কৃষ্ণচূড়া কি জানে তার এ শহরের ব্যামো?
জানে তাকে ভালোবাসে যারা, তার মাঝে কত কত খুনি?

একই শ্বাস, একই নিষিদ্ধতা, একই হাওয়ার দলে
কত কত বিষাক্ততা—হয়তো তারা
মেখে দেয় ভাতের মতো, শেষ পাতে
শেষ ক্ষুধার লোকমার মতো, গলা টিপে মারার আগে
সবুজ ঘন মিছামিছি এ শহরের জঙ্গলে যারা খুঁজেছিল
গ্রামের ফেলে আসা শৈশবের শেষ গন্ধটুকু!

এই শহর কি জানে
তাকে ভালোবাসে তার কত আততায়ী?