বাবা তাহিরের রুবাইয়াৎ
প্রিয়তমা পান করো মুহূর্তকে
বাবা তাহির (৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ) ইরানি সাহিত্যের একজন অত্যুজ্জ্বল কবি এবং সুফি সাধক। তাঁর রচিত রুবাইগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঊষর মরুভূমির উটচালকের কণ্ঠে, জনস্রোতের বিভিন্ন পথে নানাভাবে গীত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর বয়েৎ ইরানের আকাশে উদাস হাওয়া ছড়ায়। যদিও ওমর খৈয়ামের রুবাইগুলো এডওয়ার্ড ফিট জেরাল্ডের অনুবাদের মাধ্যমে জগদ্ব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তবু বাবা তাহিরের বয়েৎ ইরানি জনগোষ্ঠীর কাছে অনেক বেশি সমাদৃত। তাহিরের কবিতা তৎকালীন অনেকের কবিতার চেয়ে, অনুবাদক তাজারের ভাষায়, ‘অনেক বেশি মধুর, অনেক বেশি কোমল এবং অনেক বেশি স্পর্শাতুর।’ বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে একেবারেই অপরিচিত এই কবির কয়েকটি রুবাই এম এস তাজারের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় রূপান্তর করা হলো। বলা বাহুল্য, ভাব রক্ষার স্বার্থে রুবাইয়ের অন্ত্যমিলগুলো রক্ষা করা গেল না। — অনুবাদক
• অনুবাদ: চরু হক
এক
রাত গভীর অন্ধকার, নেকড়ে দল বেরিয়ে গেছে ভেড়াদের খোঁজে।
তোমার অবর্ণনীয় কৃষ্ণ চোখ নিহত করেছে আমার নিদ্রাকে
মায়াবী চেরি ফলের মতো তোমার ঠোঁট দিয়ে আমাকে একটু চুমু দাও
বলো, ‘আহা! ভুল করে হয়ে গেছে, আমার তো ইচ্ছে ছিল না।’
দুই
রাতে রাতে প্রতিটি তারাই আমি গুনে যাই, যাতে তোমাকে দেখতে পাই একা,
তাকাই চাঁদের দিকে, ভাবি শুধু এ বুঝি তুমিই,
তোমার পায়ের শব্দ লক্ষ করি, যখন আসতে থাকো কাছে,
কত আর সইব বলো কখন না জানি ফাটে এ হৃদয় সশব্দে হঠাৎ।
তিন
আমি তো দুঃখিত, তাই ফোঁপাই, তাই যাতনাতে থাকি,
যেমন আগুনে শুধু গলে মোম তেমনি আমার কান্না গলে,
পথের মাঝখানে এসে বসে পড়ি, দিনরাত সেখানেই থাকি,
তুমি যদি এ পথ দিয়ে যাও কখনো, তাহলে তো তোমাকেই পাব।
চার
একটি হৃদয় আছে এ আমার, যেন একটি পাথরের কাক,
যেন তীরে বাঁধা নৌকা এক, কোনো মাঝি ধরে না তো হাল,
তুমি এসে বলছ আবার ‘তাহির, কেন বাজাও না সে সুর?’
কিন্তু ভাঙা বীণা সুর কি বাজাতে পারে আর?
পাঁচ
কোথাও এমন কোনো হৃদয় নেই, যা আমার মতো কাঁদে,
এমন কোনো জীবন নেই, যা আমার মতো মরে,
এমন কোনো জলভরা মেঘ নেই, নদী নেই,
বা কোনো চোখ নেই, যা আমার মতো ঝরে।
ছয়
টুপটুপ করে কাঁদছে মালি, হাত দিয়ে গোলাপের চারা রুইছে
চোখের জল ভাসিয়ে দিচ্ছে জলে, যখন চারাগাছের সঙ্গে কথা বলছে
বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস, কারণ যত চারাই রোপণ করো না কেন তুমি
সবকিছু যে শেষ হয়ে যাবে মৃত্যুতে।
সাত
তুমি এতই মনভোলানো, এতই কুহকিনী, সুন্দর হে আমার,
অশ্রু দিয়ে গড়া এই চোখ নিয়ে আমি ভাসছি আগুনে,
ভয়ে ভয়ে থাকি, কোন দিন জানি, আমার বাহুতে ঢলে পড়,
জল মিশে যায় বাতাসে, তেমনি মিশে গিয়ে আমার আগুনে যদি পুড়ে মরি।
আট
আমি দৌড়ে বের হয়ে যেতে চাই এ পৃথিবী থেকে,
চীন থেকেও দূরে, ঈশ্বরের দূরতম দেশ থেকেও দূরে,
সেখান থেকে খবর পাঠাব আমি তোমাকে এবং বলব,
‘আরও কি দূরে যেতে হবে? নাকি অন্য কোনো গ্রহে?’
নয়
হে নিঠুরের নিঠুর, তুমি কি কিছুই গণ্য করো না?
যদি আমি মরে যাই কিংবা দুঃখে দুঃখে এভাবেই বাঁচি,
তাহলে জ্বালিয়ে যাব সব, এমনকি তোমার হৃদয়ও
মোম যদি গলে, তবে জেনে রাখো, শেষাবধি গলে।
দশ
দুঃখ ফলছে ভালোই, আমার হৃদয়ের এ মধ্যিখানে,
এভাবেই ঘটছে সব, আর ঘটে যাচ্ছে একেবারে প্রথম থেকেই,
প্রিয়তমা পান করো মুহূর্তকে, তা না হলে একটু পরেই
মৃত্যু এসে ছিঁড়বে তোমার মুণ্ডু, জ্ঞানী কি অজ্ঞান তুমি যা–ই হওয়া কেন।
এগারো
আমার মন পাগল, কিন্তু পাগল তো তোমার জন্যই,
এভাবেই চলছে জীবন, যেন আকাশ থেকে পাতালে পড়ে গেছি আমি,
এই পাগলামি সারা জীবনেও আর সারবে না তো
যদি না তোমার ভালোবাসার মিঠেধারা পাই।