পৃথিবী আগোছালো বেদনায় ভরে গেছে

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

গোল সোর্খ

কবির মৃত্যুদিনে

শহরের রোদগুলো বেওয়ারিশ পড়ে থাকে,

মিছিল থেকে ফেরা যুবকের সাথে

মেয়েটির আর দেখা হয় না।

লাল গোলাপে ছেয়ে যায় সন্ধ্যারা,

স্বজন ছেড়ে যায়, লুট হয় তরুণ রাত,

কত যুদ্ধ আসে-যায়; কবিরা হারায়!

ল্যাম্পপোস্টের নিঃসঙ্গতা কাটে না।

জেনো, পালালেও ছায়া থাকে সমান্তরালে,

থেকে যায় ক্ষত, পোড়া দাগ।

তোমাকে দেখে হেসে ওঠে কিছু পথ,

মায়ের মতো অপেক্ষায় থাকে না কেউ।

বালুতীর জুড়ে দখলদারদের ছোটাছুটি;

তবুও আকাশে ওড়াউড়ির দিন আনতে

রক্ত-ঘাম মেখে মানুষ পথে নামে,

যুবকের অপেক্ষায় থাকা কিশোরীর দুঃখ মুছে

রাজপথ লাল হয় মরুর বিপ্লবে,

সর্বহারা বৃদ্ধার লাঠিটিও ধনুক হয়ে ওঠে,

মানুষ ফেরে তাঁর চেনা চেহারায়—

রোদ ঝরে, ঝরে গোল সোর্খ,

সময়ের স্রোত ও সন্ধিতে

জিতে যায় সংখ্যালঘুর হাসি—

আর পারস্যের আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়ে

জ্বলতে থাকে পারনিয়া আব্বাসি।

অক্টোবর ৭

ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ইরানি কবি পারনিয়া আব্বাসি
ছবি: রাইটার্সমোজাইক

যতটা দূর থেকে সবটা ঝাপসা লাগে

তার থেকে দূরে বসেও সবকিছু স্পষ্ট দেখি,

কে যেন চলে যায়—না বলা গল্প বুকে।

সবুজ মাঠগুলো ঘরে ফেরে

সন্ধ্যার বিষণ্ণতা মাখতে থাকে একলা হাওয়া,

পা হারানো পাখিটার ভাঙা ডানা কাঁপে

তুমুল উড়ালের অপেক্ষায়...

অবুঝ শিশু হেসে ওঠে, হাঁটে, পড়ে, দৌড়ায়—

কার হাত থেকে ছুটে আসে আলো!

হঠাৎ কার বুকে বিদ্ধ বুলেট!

কত রক্তে জমাট পথ, পড়ে আছে

স্বপ্নমগ্ন কিশোরীর গোলাপি সাইকেল!

আমার চোখে ভেসে ওঠে ডি সিকার ‘দ্য বাইসাইকেল...’

পৃথিবীর সবচেয়ে দুখী দৃশ্য; বাবাদের অবনত মাথা!

সবচেয়ে ভারী বোঝা; সন্তানের লাশ!

সবচেয়ে অসহায়... ক্ষুধার্ত শিশুর মায়ের মুখ!

পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারতে কতটা ঘৃণা লাগে?

কে জানে, আর কতজন বেঁচে আছে!

বহুদূর থেকে এসব ভাবনার হিসাব কষি;

চোখে মুখে কত কী রং এসে লাগে,

হঠাৎ বিপন্নতায় আজও কাফকাকে খুঁজি।

আমাদের সময়গুলো ঘুণপোকা খেয়ে দেয়,

উৎসব শুরু চারদিকে, উড়ে যাচ্ছে লাশের ফানুস!

ঈশ্বরের চোখ

আঙুলে মাখা মুহূর্তগুলো এইবার মুছে ফেলো,

গিলে ফেলো গলা বেয়ে উঠে আসা শোক,

তোমার আকাশে ভাঙনের কথা আমি জানি,

আমি জানি

তোমার নদীতে ঢুকে পড়েছে ভিনদেশি সমুদ্রের নোনা।

এতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, অথচ কেউ খুব শান্ত!

পাথরে ঘষা লেগে রক্ত ঝরছে দু পা থেকে

তবু কারো কারো চূড়া ছোঁয়ার তর সইছে না।

ঈশ্বরের দিকে যেতে যেতে মানুষ জেনে গেছে

পৃথিবীর প্রাচীনতম আঘাতের নাম, তাইতো

যে মানুষ ঘাসের বুকের অবুঝ ব্যথা বুঝত,

সে মানুষ আজ ঘোর বর্ষণেও বিমুখ।

পৃথিবী আগোছালো বেদনায় ভরে গেছে,

ভুল জীবনের বিনিময়ে আমরা যেসব ভ্রূণ পুড়িয়েছি—

তাদের নাম কী দেবে?

জানো তো, যে অতীত মুছে ফেলা যায় না;

তার নাম ফিলিস্তিন!

দাঙ্গা

পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছিল আমাদের,

সামনে রীতি-সংস্কার, পাতা ফাঁদ, কোলাহল-চিৎকার,

ঝোড়ো হাওয়া, অকাল দুপুর!

দিনের পর দিন, কতকিছু তাড়া করেছিল!

মনে আছে...?

বাঁচার জন্য, আমরা পরস্পরের হৃদয় বিছিয়ে দিলাম—

জাতপাত-ক্রোধ-আক্রোশ; একে একে মাড়িয়ে গেল,

আমরা রক্তাক্ত হলাম ভয় আর জড়তার জুজুতে।

চোরাবালিতে ডুবে গেল আমাদের মন ও মুগ্ধতা।

আমাদের বন্ধুরা সবকিছু দেখল চুপচাপ—

মুখ চেপে হাসল আমাদের শত্রুরা—

পড়ে থাকল আমাদের পরিচিত রাস্তা, স্মৃতি ও গল্পরা।

তোমাকে কখনো এসব উপলব্ধির কথা বলা হয়নি!

লুব্ধক

মুখগুলো সূত্রবন্দী নিঃসঙ্গ গণিত

সময়ের ধাঁধায় আসর জমাতে মশগুল,

বয়সী নর্তকীর মতো

আহত, ঝরে পড়ছে তীব্র আলোর ফুল।

পাশ ফিরতেই, স্বপ্নমগ্ন

তাঁর গাঢ় নিশ্বাসের ওঠা-নামা ছুঁয়ে

জীবনের আশা শুনি,

বাতাস কাঁপিয়ে ছুটে যায় দুষ্ট দেবদূত

শ্রমিকের চোখ ঘুমায় না।

আমার গল্পের ওই রাখালকে মনে পড়ে,

শহরের সব দেয়াল থেকে

ঘষে ঘষে সে এখন মিথ্যা মুছে চলে।

মনে পড়ে বাঘটির কথাও,

যে ভাবে রাখাল বুঝি আজও মিথ্যা বলে!

এভাবে বদলে যায়

পৃথিবীর সমস্ত যৌথ ও একক বৃত্তগুলো—

যেখানে কেউ হেরে গেছে,

কেউ জিতেও নত, কেউ কেউ নিরুদ্দেশ।

আমাদের ঘড়ির কাঁটায়

স্মৃতি-বিস্মৃতির দুই অজগর ঝুলে আছে

বেছে বেছে যারা

এই রাতগুলো গিলতে এসেছে।

মানুষকে ইদানীং!

খুব বিবর্ণ আর গল্পহীন লাগে,

যেন ভুল প্লাটফর্মে পড়ে থাকা বিচ্যুত রেলগাড়ি,

যারা কিনা সামান্য জাগতিক বিভ্রমে

জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হারিয়েছে!