মৃত্যুর আগে কি কোনোই জীবন নেই

৭ অক্টোবর সকালে ইসরায়েল ভূখণ্ডে হামাসের অতর্কিত আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে আবার শুরু হয়েছে ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধ। দশকের পর দশক ধরে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছেন ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনি কবি মুরিদ বারগুতির এই কবিতায় ধরা পড়েছে সেই সুর—নিপীড়িত ফিলিস্তিনবাসীর বেদনা আর বর্তমান পরিস্থিতি। অনুবাদ করেছেন হিজল জোবায়ের

ইসরায়েলের হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা এখন মৃত্যুপুরী। বুকে ক্রোধ, চোখে বেদনা। মৃত স্বজনদের সৎকারের জন্য কবর খুঁড়ছেন দক্ষিণ গাজার কয়েকজন তরুণ। ১২ অক্টোবর
ছবি: রয়টার্স

কোনো সমস্যা নেই আমার

তাকালাম নিজের দিকে:

কোনোই সমস্যা নেই আমার।

একদম ঠিকঠাক আছি,

আমার ধূসর চুল আকর্ষণীয়ই মনে হবে

কিছু কিছু মেয়ের কাছে;

সুন্দর করে বানানো আমার চশমা,

শরীরের তাপমাত্রা একদম ৩৭,

ইস্ত্রি করা শার্ট

আর জুতা জোড়াও আরামদায়ক।

কোনোই সমস্যা নেই আমার।

হাতে নেই হাতকড়া

এখনো জবান বন্ধ করে দেওয়া হয়নি,

এমনকি কারাগারেও যেতে হয়নি আমাকে

ছাঁটাই করা হয়নি কাজ থেকে,

কয়েদখানায় আত্মীয়স্বজনদেরও দেখতে যেতে পারি,

নানান দেশে তাঁদের কবর জিয়ারতেও

যেতে দেওয়া হয় আমাকে।

কোনোই সমস্যা নেই আমার।

বন্ধুর মাথায় শিং গজিয়েছে

তা নিয়ে মোটেও বিচলিত নই আমি,

পোশাকের তলায়

লেজ লুকিয়ে রাখায় তার চাতুরি আমার পছন্দ,

পছন্দ ওর শান্ত থাবাও;

আমাকে সে খুনও করতে পারে

কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে

তাকে আমি ক্ষমা করে দেব;

যেকোনো সময়

আমাকে আঘাত করতে পারে সে।

কোনোই সমস্যা নেই আমার।

টিভিতে উপস্থাপকের হাসিতে

মোটেও আর অসুস্থ বোধ করি না,

খাকিরা আমার স্বপ্ন, রাত আর দিন রুদ্ধ করে দেয়

তা–ও সয়ে গেছে;

সে কারণেই সব সময় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখি,

এমনকি সুইমিংপুলেও।

কোনোই সমস্যা নেই আমার।

গতকাল রাতের ট্রেনে চড়ে বসে আমার স্বপ্নেরা

আর আমি বুঝেই উঠিনি

কী করে তাদের বিদায় জানাতে হয়।

শুনলাম, এক ঊষর উপত্যকায়

বিধ্বস্ত হয়েছে সে ট্রেন

(কেবল ট্রেনের চালক বেঁচে গেছে)।

খোদাকে শুকরিয়া জানালাম

আর ব্যাপারটাকে সহজ করে নিলাম,

যেহেতু ছোটখাটো দুঃস্বপ্ন হয় আমার,

আশা করি এগুলোই একদিন

দুর্দান্ত এক স্বপ্নের জন্ম দেবে।

কোনোই সমস্যা নেই আমার।

জন্মের প্রথম দিন থেকে আজ অবধি

নিজের দিকে তাকিয়ে আছি আমি,

নিরাশার কালে শুধু মনে রাখি—

মৃত্যুর পরও এক জীবন আছে;

ফলে কোনোই সমস্যা নেই আমার।

কিন্তু প্রশ্ন রাখি:

হে খোদা,

মৃত্যুর আগে কি কোনোই জীবন নেই?

মুরিদ বারগুতি
ছবি: সংগৃহীত

একনজরে মুরিদ বারগুতি

ফিলিস্তিনি কবি মুরিদ বারগুতিকে বর্তমান ফিলিস্তিনের শীর্ষ কবিদের একজন বলে মনে করা হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের ৪ বছর আগে ১৯৪৪ সালের ৮ জুলাই পশ্চিম তীরের রামাল্লায় তাঁর জন্ম। মারা গেছেন ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ৭৬ বছর বয়সে, জর্ডানের রাজধানী আম্মানে।

১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় উচ্চশিক্ষার্থে মিসরে ছিলেন মুরিদ বারগুতি, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়তেন। যুদ্ধে আরবদের পরাজয় হলে ইসরায়েল যখন গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে নিল, তখন বিদেশে থাকা অন্যান্য ফিলিস্তিনির মতো মুরিদ বারগুতিকেও মাতৃভূমিতে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ৩০ বছর পর রামাল্লাহে যাওয়ার অনুমতি পান তিনি।

ইসরায়েলি আগ্রাসন ও দখলদারির মুখে জীবনের বেশির ভাগ সময় এই কবি কাটিয়েছেন লেবানন, জর্ডান, ইরাক, কুয়েত, হাঙ্গেরি ও মিসরে।

মুরিদ বারগুতি ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশের বন্ধু। আরবি ভাষায় তাঁর ১২টি কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে। কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায়। প্যালেস্টাইন অ্যাওয়ার্ড, নাগিব মাহফুজ মেডেলসহ নানান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

বারগুতির স্ত্রী মিসরের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাদওয়া আশোরের অনুবাদে মিডনাইট অ্যান্ড আদার পোয়েমস নামে প্রকাশিত হয় কবির কবিতার একটি ইংরেজি সংকলন। এখানে পত্রস্থ বাংলায় অনূদিত কবিতাটি সেই বই থেকে নেওয়া।