আকাশের চোখে যখন প্রথম জমল জল
সেই জল নেমে এল ছয় কুড়ি কান্দায়, নয় কুড়ি বিলে
যেন দেবতার হাসি ছড়িয়ে গেল সবুজের বুকজুড়ে
তখন ছিল না জলমহালের দখলদার
ছিল মাছেদের রাজ্য, শাপলা-শালুকের রঙিন সংসার
হিজল-করচের বন থেকে ঝরত ভোরের শিশির
নদীর ঢেউয়ের কোলে; এক রাতে চাঁদ—
তার সাদা শাড়ির নীল আঁচল ভেজাল হাওরে
সেই থেকে প্রাচীন এই জলাভূমির জল—
চন্দ্রালোকে নীলাভ হয়ে ওঠে বর্ষায়
রামসার সাইটের নথি ছিল না তখন
ছিল মানুষের বিশ্বাস—এই জলরাশি
পৃথিবীর গভীরতম আয়না, যেখানে পূর্বপুরুষেরা
ভেসে আসে নৌকা হয়ে, আসন্ন বর্ষার খবর দিতে
আজও বর্ষায় প্রথম বাজ পড়লে—
হিজলপাতার ফাঁকে ফিসফিস করে ওঠে আদি কণ্ঠস্বর—
‘হাওরের জল শুকায়, তার স্বপ্ন শুকায় না।’
ছয় কুড়ি কান্দা আর নয় কুড়ি বিলের এই ভূগোল
শুধু মানচিত্র নয়; এক অনন্ত মিথ; যেখানে মানুষ
আর প্রাণ-প্রকৃতি একই দেহে বাঁচে।
২
প্রথমে জলই ছিল
অতল নীলে জন্ম নিল হাওর
যেন স্বপ্নের গভীর পাত্রে রাখা মাতৃগর্ভের ভ্রূণ
ছিঁড়ে পড়া মেঘ, বৃষ্টিধারা
দূর পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসে নদীর শিরায়
প্রাচীন এই ভূমির বুকে জেগে ওঠে—
অসংখ্য আঙুলের ফাঁক ভরা জলের ফুসফুস
এ জলে জন্ম নেয় শাপলা, শালুক, পানিফুল
তাদের গায়ে এসে পড়ে সূর্যের সোনালি আঁচল
আর কাদাজলের ভেতর নড়ে ওঠে গোপন নিশ্বাস
যা কেবল মাছেরাই বোঝে
হাওর তখন এক বিশাল আয়না—
যেখানে আকাশ নিজেই তার ছায়া
পানকৌড়ির ডানায় লেগে থাকে—
দিগন্তের ছেঁড়া আলোর চিহ্ন
প্রথমে মানুষ এল নৌকায় চড়ে—
ডোঙা কেটে, বাঁশে পাল তুলে
জলকে জয় নয়, তার সাথে ভাব জমাতে এসে
জেনেছিল জল শত্রুও হতে পারে, পরম বন্ধুও
তাঁদের প্রথম ঘর ছিল খুঁটির ওপর
জলের পিঠে দাঁড়ানো অস্থায়ী প্রার্থনালয়
হাওরের বুক ভরে উঠেছিল অসংখ্য মাছের নিশ্বাসে—
আইড়, বোয়াল, শোল, টেংরা, পাবদা, পুঁটি, কই…
প্রতিটি মাছ যেন জলতরঙ্গের অন্তশিশু
যাদের জন্ম শুধু মানুষের উদরপূর্তির জন্য নয়
গান ও গল্পের ভেতরে বেঁচে থাকার জন্যও
তখন হাওর মানে পাখির সিম্ফনি—
ধলা বালিহাঁস, চখাচখি, পানকৌড়ি, সারস…
যাদের উড়ান আকাশে এঁকে দেয় জলজ মানচিত্র
নদী থেকে জল এসে ঢুকে পড়ে
প্রতিটি খালে, বিলে
ঢেকে দেয় মানুষের পায়ের চিহ্ন
যেন পৃথিবী চায় না কোনো মালিকানা
সবই একদিন ফিরে যাবে জলে
জলে জন্ম ধান, মাছ, মানুষ, প্রাণ-প্রকৃতির
অসংখ্য অদৃশ্য বীজের, যারা এখনো—
অপেক্ষায় পরবর্তী মৌসুমে মেঘের ডাকের।
৩
ভোর ফোটে কুয়াশার ধূসর উচ্ছ্বাসে
চোখ খুলতেই হাওরের মানুষ দেখে—
তাদের ঘর এখনো দাঁড়িয়ে আছে জলের সিথানে
বাঁশের খুঁটি কাঁপছে রাতের ঢেউয়ের ধাক্কায়
তবু অটল, চাষির বিশ্বাসের মতো অনড় যেন
ধানের চারা রোপণ মানে কৃষিকাজ নয় শুধু—
এ যেন জলের সাথে অলিখিত চুক্তি—
তুমি আমাকে ডোবাবে না, যতক্ষণ না শীষ পাকে।
চাষির পা ডুবে থাকে কাদায়
হাতে বীজের স্বপ্ন, মুখে লোনা হাসি
যেন প্রতিটি শস্যদানা আকাশের সাথে
ব্যক্তিগত সমঝোতায় মত্ত
হঠাৎ বাঁধ ভেঙে বান আসে
কেউ বলে প্রকৃতির গোপন প্রতিশোধ
তখন জলের রং হয়ে যায় কালো
ভাসে মরা মাছ
ছিঁড়ে যায় ফসলের শিরা
যেন বুকের ভেতর থেকে ছিঁড়ে নেওয়া প্রাণ
তবু তারা নৌকা চালায়—
প্রতিদিনের মতোই গরু-বাছুর, ধানগাছ
শিশুর বই, বৃদ্ধের লাঠি
সব তুলে নেয় বাঁশের ডিঙিতে
নৌকা তখন হয়ে ওঠে শিশুর স্কুল, নারীর রান্নাঘর
পুরুষের বাজার, বৃদ্ধের শোবার ঘর
মাছ ধরা এদের কাছে শুধু জীবিকা নয়
এ এক প্রাচীন উৎসব
যেখানে জাল নদীর তলদেশ ছুঁয়ে আসে
পুরোনো গোপন ধ্বনি
টেংরা, বোয়াল, কই, কাতলা, রুই…
যখন জালবন্দী হয়—
চোখে ঝলমল করে শিকারির আদিম আনন্দ
জল কমে গেলে উন্মুক্ত হয় মাঠ
ধান কাটা শুরু হয় গানে
গলা থেকে বের হয় বংশানুক্রমিক সুর
মিশে যায় বাতাসে, শাপলার ঘ্রাণে…
তারা জানে, এ জীবন অস্থায়ী
জল আজ বন্ধু, কাল শত্রু; তবুও সংগ্রাম…
এই জলেই লুকিয়ে আছে জন্ম, মৃত্যু
হাজার বছরের গল্প।
৪
হাওরের বুক এক উন্মুক্ত জাদুঘর
পাখিরা ইতিহাস লেখে ডানায় ডানায়
জলতরঙ্গের ওপর আঁকে ষড়ঋতুর গোপন নকশা
শীতে উত্তরের দূরদেশ থেকে আসে অতিথি পাখিরা
নিশাচর হেরন, সরালি, জলপিপি, হরিয়াল…
চোখে তাদের দূর বরফপাহাড়ের প্রতিফলন
ঠোঁটে বয়ে আনে নতুন বীজ—
ফুঁড়ে ওঠে পানির তলদেশ থেকে
জল কেবল প্রাণীর নয়—
হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের বসতি
শাপলা, শালুক, নলখাগড়া, কচুরিপানা
পাতায় জমে থাকে ভোরের শিশির
ছোট ছোট আকাশখণ্ড
শীত শেষে শুকায় জল
শিকড় ধরে রাখে মাটি
বৃষ্টি ফিরে এলে যেন—
সবুজে ভরে ওঠে হাওরের শরীর
মাছেরা হাওরের প্রাণ
আইড়ের গা মলিন সোনালি
নাচতে থাকে বোয়ালের পাখনা
টেংরার চোখে জলের ঝলকানি
তাদের গতিবিধি ধরে—
নদী মেপে নেয় নিজের স্বাস্থ্য
কই, পাবদা, শিং… শুধু মাছ নয়
এরা হাওরের রক্তধারা
যেখানে সাঁতার কাটে মানুষের স্বপ্নও
জলপোকা, ঝিনুক, শামুক, কাঁকড়া
সম্মিলিত এক জলজ সংসার—
যেখানে শিকারি পাখি জানে কোন মুহূর্তে দিতে হবে ঝাঁপ
সন্ধ্যায় পানকৌড়ি উড়ে এসে বসে থাকে
জলডোবা গাছের গুড়িতে
যেন মিলিয়ে নিচ্ছে দিনের হিসাব
বর্ষায় জল বাড়ে, পাখিরা খুঁজে নেয় নতুন দ্বীপ
মাছেরা খুঁজে নেয় খালের গভীর গর্ত
গাছেরা শ্বাস নিতে মেলে ধরে পাতা
সবাই জানে, এ জীবন জলের সাথে বাঁধা
হাওর এক সংগীত—
যেখানে পাখির ডানার শব্দই বাঁশির সুর
মাছের সাঁতারের তরঙ্গই একতারার টুংটাং
শাপলার মুখে ফোটে নীরব কবিতা।
৫
হাওরের আকাশ হঠাৎ কালো হয়ে ওঠে
মেঘ শুধু নদীতে নয়
মানুষের বুকেও নেমে আসে বন্যার পূর্বাভাস হয়ে
দূর থেকে দেখা যায়—দিগন্ত গিলে নিচ্ছে আলো
বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে আসে ঘূর্ণিঝড়ের গর্জন
ছিঁড়ে ফেলে বেড়া, উড়িয়ে নিয়ে যায় ঘরের চাল
তখন মানুষ নৌকা বেঁধে রাখে—
বাঁশ, রশি আর প্রার্থনার গিঁটে…
বাঁধ-ভাঙন এক মুহূর্তের আততায়ী
রাতারাতি গ্রাস করে ধানের খেত
শুকনো আঙিনা, এমনকি পূর্বপুরুষের কবরও
কেউ জানে না, কোন শোকে আগে কাঁদতে হবে—
ফসলের, নাকি ডুবে যাওয়া ঘরের জন্য
জলবায়ুর বোবা অভিধানে
নতুন শব্দ যোগ হয় প্রতিদিন—
অকালবন্যা, দীর্ঘ খরা, মাছের বিলুপ্তি
শুকনো মৌসুমে শস্যের আধমরা দেহ
পানির অতিরিক্ত রূপ বদলায়-
কখনো বিষাক্ত কাদা হয়ে
তরুণ ফসলের শ্বাস রোধ করে
তবু প্রতিরোধ থামে না—
মেয়েরা বালতি ভরে তুলে আনে বৃষ্টির জল
নারী-পুরুষেরা জাল মেরামত করে রাতভর
শিশুরা কাঁদতে কাঁদতে বই ধরে রাখে
যেন কাগজে লেখা অক্ষরগুলো ডুবে না যায়
ঝড় শেষে হাওর যেন বিশাল এক ধ্বংসস্তূপ—
তবুও সেই ধ্বংসস্তূপে
শাপলার কুঁড়ি মাথা তোলে ধীরে
যেন ঘোষণা করছে—
জল যতবার ভাঙে, ততবার গড়বেও।
মানুষ শিখে নিয়েছে—
বাঁচতে হলে জলের সাথে লড়াই নয়
বরং নাচতে হবে তার তালে তালে
পদক্ষেপ যতই হোঁচট খাক
শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতেই হবে।
৬
বৃষ্টির মৌসুম শেষ হলে
আকাশ ধুয়ে যায় স্বচ্ছ নীল রঙে
হাওরের জল রেখে যায় পলি
তখন কৃষকেরা কাদামাটি চষে
নতুন বীজ বোনে
যেন প্রতিটি দানা—
ভবিষ্যতের গোপন চিঠি
শিশুরা দৌড়ায় শুকনো তীরে
তাদের পায়ের ছাপ প্রতিশ্রুতির নকশা
বলে দেয়-মাটি এখনো মানুষকে বাঁচাতে পারে
তাদের চোখে থাকে নৌকার লাল-সবুজ পাল
দিগন্তের ওপারে অজানা ভোরের স্বপ্ন
হাওরের মানুষ জানে
প্রতিটি বিপর্যয়ের পরেই
শুরু হয় নতুন দিনের গান-
শাপলা ফোটে, ডিম ছাড়ে মাছ
পাখি ফিরে আসে নীড়ে
ধীরে ধীরে জল মুছে দেয় ধ্বংসের দাগ
শীতের কুয়াশায় ধান কাটা শেষে
বাড়ি ভরে ওঠে নবান্নের ঘ্রাণে
মায়েরা শুকনো মাছ মেলে রাখে রোদে
বাবারা জাল বোনে আগামী মৌসুমের জন্য
বৃদ্ধেরা গল্প বলে-কীভাবে একসময় বড় বন্যায়
সব হারিয়েও আবার গড়েছিল ঘর
হাওরের মানুষের কাছে আশা কোনো আশ্চর্য প্রদীপ নয়
এক প্রাত্যহিক সংগ্রাম-যেখানে হাসি মানে বেঁচে থাকা
কান্না মানে আগামীকাল বাঁচার প্রস্তুতি
প্রতিটি জন্ম, প্রতিটি ফসল, প্রতিটি নিশ্বাস
তাদের বলে দেয়-
হাওর কেবল জল নয়, কেবল মাটি নয়-
জীবনব্যাপী এক সম্পর্ক
যেখানে মৃত্যু কেবল পুনর্জন্মের আগের বিশ্রাম
সূর্য যখন হাওরের জলে শেষ আলো ফেলে যায়
সেই আলো পথচিহ্ন হয়ে থাকে দূর ভবিষ্যতের
যেখানে জল, মানুষ, মাছ, পাখি, গাছ একসাথে বাঁচে
একই ছাদের নিচে-আকাশের।