হো চি মিনের কারাগারে লেখা কবিতা
হো চি মিন তখন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনায়ক। ভিয়েতনামের দুই অংশ একীভূত হতে তখনও অনেক দেরি। ১৯৪২ সাল। হো’র বয়স তখন ৫২ বছর। গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগে দক্ষিণ চীন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। চীনা কারাগারে থাকার সময় কবিতা লেখা শুরু করেন হো। কবিতার আদলে আসলে ডায়েরি লেখা। পরে তা বই হিসেবে বেরিয়েছে। তখন তাঁকে ১৪ মাস কারাভোগ করতে হয়। অধিকাংশ সময় তাঁর পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হতো। প্রায়ই স্থানান্তর করা হতো এক জেল থেকে আরেক জেলে। কবিতাগুলোর বাংলা অনুবাদ করতে গিয়ে অনুসরণ করা হয়েছে কেনেথ রেক্সরথ এবং এইলিন পামারের ইংরেজি অনুবাদ। মূল বইটি চীনা ভাষায় লেখা। বইটির নাম প্রিজন ডায়েরি অব হো চি মিন। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক হো চি মিনের জন্মদিনে ছাপা হলো তাঁর এই কারা-কবিতাগুলো।
কয়েদির কাগজের কম্বল
নতুন বই, পুরনো বই,
সব ছেঁড়া পাতার গাদাগাদি
কম্বল না থাকার চেয়ে
ভালো এই কাগজের গাদি
কারুকাজ করা কম্বলে
ঘুমাও যারা রাজপুত্তুর
তোমরা কি জানো
কারাগারে কত লোক
সারা রাত একটুও ঘুমাতে পারে না?
শরতের রাত
ফটকের সামনে এক প্রহরী
কাঁধে বন্দুক।
আকাশে, মেঘের ফাঁকে
পালিয়ে বেড়ায় চাঁদ।
বিছানায় ছাড়পোকার ভিড়,
রাতের আঁধারে যেন এগিয়ে আসে
সেনাদের সতর্ক কালো ট্যাংক।
মশার ঝাঁক,
যেন ধেয়ে আসা আক্রমণকারী যুদ্ধবিমান।
ভাবি আমার দেশের কথা।
স্বপ্ন দেখি উড়ে যাচ্ছি বহু দূর।
স্বপ্ন দেখি আমি ঘুরছি আশাহীন,
আটকে আছি যাতনার ঢেউয়ের ভেতর।
এখানে কেটে গেল আরেকটা বছর।
কী আমার অপরাধ?
চোখের জলে লিখি
আরেকটা কারাগারের কবিতা।
উজ্জ্বল সকাল
সকালের সূর্য জ্বলে ওঠে
কারার দেয়ালের ওপর
আর দূরে চলে যায়
নিরাশার ছায়া ও ধোঁয়াশা
পৃথিবীজুড়ে বয়ে যায়
সঞ্জীবনী হাওয়া।
একশত বন্দির মুখে
হাসি ফুটে আবার।
ঠান্ডা রাত
শরতের রাত।
না বালিশ, না কোনো চাদর।
ঘুম নেই। শরীর কুঁকড়ে আসে।
পায়ে খিঁচুনির টান।
হিমে ঢাকা কলাপাতায়
জ্বলছে ঠান্ডা চাঁদ।
আমার গরাদের বাইরে
নিরিবিলি আকাশে শুয়ে আছে মহান ভালুক
সুদিন আসছে
সবকিছু বদলায়,
আইনের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরাম।
বৃষ্টির পরে আসে রোদ।
চোখের পলকে বিশ্বজগৎ
ছুড়ে ফেলে তার কাদার পোশাক।
দশ হাজার মাইলজুড়ে
ছড়িয়ে পড়ে নিসর্গশোভা
যেন বিরাট এক রেশমি পর্দায়
রঙিন কারুকাজ।
কোমল রোদ।
হালকা বাতাস।
ঝিকিমিকি পাতার ফাঁকে হাসে ফুল।
সব পাখি গায় একসাথে।
মানুষ আর প্রাণী জেগে ওঠে আবার
পুনর্জন্ম যেন।
এর চেয়ে স্বাভাবিক
আর কিছু কী আছে?
বেদনার পরে আসে আনন্দ।
মুক্ত আমি, পাহাড়ে হাঁটি আর দৃশ্য দেখি
(এই কবিতাটি কারাগার থেকে মুক্তির পর লেখা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে ওয়েস্টার্ন রেঞ্জে গিয়েছিলেন হো। এই কবিতা তখন লেখা।)
পাহাড়ের বুকে মেঘ
মেঘের আলিঙ্গনে পাহাড়
দূরে নিচে ঝলমলে এক নদী,
উজ্জ্বল, নিদাগ আয়না যেন।
একাকী, দুরুদুরু হৃদয়ে
হাঁটি পশ্চিমের পাহাড়ি পরিসীমায়,
আর তাকিয়ে থাকি দক্ষিণে,
ভাবি আমার পুরোনো সঙ্গীদের কথা।