বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত কবিতা
৩০ নভেম্বর ছিল কবি–সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর জন্মদিন। ১৯২৭ সালে ১৯ বছর বয়সে ঢাকায় বসে তিনি লিখেছিলেন অগ্রন্থিত এই কবিতাটি।
সংগ্রহ ও ভূমিকা: ভূঁইয়া ইকবাল
বাংলা একাডেমির তৎকালের মহাপরিচালক মাহমুদ শাহ কোরেশী ১৯৯১ সালে আমাকে একাডেমির জীবনী গ্রন্থমালার বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-৭৪) সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখার ভার দেন। উপকরণ সংগ্রহকালে বুদ্ধদেব বসুর বেশ কিছু কৈশোরক রচনার সন্ধান পাই। আমার আগেই মুনতাসীর মামুন আবিষ্কার করেছিলেন ‘দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত’ ‘ডাক’ কবিতাটি। শঙ্খ নামে পত্রিকার ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ১২ আষাঢ় সংখ্যায় এটি প্রথম বেরিয়েছিল। তা ছাড়া আমার সংগ্রহে ছিল বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি কবিতা—‘প্রভাত আলো’ (ভাদ্র ১৩৩০) ও ‘ভগ্নদূত’ (শ্রাবণ ১৩৩১)। মোহাম্মদ আবদুল কাইউম দিয়েছিলেন তাঁর পিতার সম্পাদিত ঢাকার অভিযান পত্রিকার ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায় (ভাদ্র ১৩৩৩) মুদ্রিত দীর্ঘ কবিতা ‘শ্রাবণ বেদন’। আবার চাঁদপুর রাহাত আলী হাইস্কুলের গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করেছিলাম অতুলচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংকলন কবি-প্রশস্তি (১৩৩৮)। সে সময়ে আরও কিছু কৈশোরক কবিতা সংগ্রহ করে ‘কৈশোরে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ নামে আলোচনা লিখেছিলাম কালি ও কলম পত্রিকায়। সৈয়দ আবুল মকসুদও কয়েকটি কৈশোরক কবিতা আবিষ্কার করে প্রকাশ করেন তাঁর ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু গ্রন্থে।
সমীর সেনগুপ্ত তাঁর প্রামাণ্য জীবনী বুদ্ধদেব বসুর জীবন এবং অমিয় দেব বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাহিত্য সাধক চরিতমালায় বুদ্ধদেব বসু গ্রন্থ রচনাকালে আমাকে অনুরোধ করেন জীবনীর উপাদান সংগ্রহে সহযোগিতার জন্য। কিছু কৈশোরক লুপ্ত রচনা উদ্ধার করে পাঠিয়ে আমি তাঁদের সাধুবাদ অর্জন করি। সমীর সেনগুপ্ত বলেন, আমিই বাংলায় বুদ্ধদেব বসুর প্রথম জীবনীকার।
কুমিল্লা রামমালা গ্রন্থাগার প্রাচীন ও লুপ্ত সাময়িকপত্রের খনি। সাপ্তাহিক আত্মশক্তি পত্রিকার ছিন্ন-জীর্ণ ফাইল খুঁজে পাই এখানে। আমার এই অভিযান আয়োজন করেন মারুফুল ইসলাম। ১৯২৭ সালের আত্মশক্তি থেকে দুটি দীর্ঘ কবিতার সন্ধান পাই: ১. ‘শীতললক্ষ্যা তীরে গিয়েছিনু লক্ষীপূর্ণিমাতে’, ২. ‘কবির বিপদ’। প্রথমটি এখানে পত্রস্থ হলো। প্রথম তারুণ্যে শ্রীবুদ্ধদেব বসু নামে লিখতেন তিনি। কিন্তু এখানে বুদ্ধদেব বসু নামটিই রাখা হয়েছে।
শীতললক্ষ্যা তীরে গিয়েছিনু লক্ষ্মীপূর্ণিমাতে
বুদ্ধদেব বসু
মনে পড়ে কি গো আজি আষাঢ়ের
জোনাকি জ্বালানো রাতে
শীতললক্ষ্যা তীরে গিয়েছিনু
লক্ষ্মীপূর্ণিমাতে।
মনে পড়ে কি গো নীল নদী নীরে,
শিশির শীতল উতল সমীরে
পূর্ণ-চাঁদের কণক কিরণ
উঠেছিল চঞ্চলি,
শীত-শিহরণে শীর্ণ। তটিনী
শিথিল-শিথান কোনো বিরহিণী,
মঞ্জুল গান গুঞ্জন করি’
চলেছিল ছলছলি।—
মনে পড়ে কি গো আজ?
আকাশের আঁখি অন্ধ যখন,
ঘন গরজিছে বাজ।
তুমিও কি ভুলে গেছ সেই কথা,
ছিলে যে আমার সাথে,
শীতল শীতললক্ষ্যার তীরে
লক্ষ্মীপূর্ণিমাতে।।
রঙিন শাড়িটি পরেছিলে কি না,
ভুলে গেছি সেই কথা,
এঁকেছিলে কি না চরণের পরে
আলতার রাঙা ব্যথা।
শুধু মনে পড়ে, তোমার তনুর
আবেশ–মদির গন্ধ মধুর
আমার দেহের দেউল দুয়ারে
জ্বেলে দিয়েছিলে ধূপ,
শুধু মনে পড়ে, দুটি কালো আঁখি
আমার দৃষ্টি রেখেছিলে ঢাকি’,
রুপার মতন রূপবতী চাঁদে
হেরেছিনু অপরূপ:
আর সবই গেছি ভুলে’,
হারায়ে ফেলেছি নব-বরষার
তিমিরের কালো কূলে।
কাঁকন কণিত কর দুটি তব
রেখেছিলে মোর হাতে,
শীতললক্ষ্যা তটিনীর তীরে
লক্ষ্মীপূর্ণিমাতে।।
অন্তর ভরা কত কথা ছিল
ভুলে গিয়াছিনু সব,
দুজনে নীরবে শুনেছিনু শুধু
তরঙ্গ কলরব।
দেখেছিনু শুধু চাঁদের মায়ায়
কোন সে সোনার জাল বুনে যায়,
বনের ছায়ায় দুলেছে যে কোনো
চারু চরণের ছোঁয়া,
ক্ষণ পরে তুমি নিয়ে বীণাখান
ক্ষীণ মৃদুস্বরে গেয়েছিলে গান,
দেখেছিনু তব আঁখিপল্লব
স্নিগ্ধ অশ্রুধোয়া।
সে কথা জাগিছে মনে,
অন্ধ গগন ঝরিছে যখন
উচ্ছল বরিষণে।
তোমার চক্ষের অশ্রু ঢেলেছ
আমার আঁখির পাতে
শীতললক্ষ্যা তটিনীর তীরে
লক্ষ্মীপূর্ণিমাতে।।
যাব নাকো আর পূর্ণিমারাতে
শীতললক্ষ্যা তীরে,
তুমি গেলে যাবে বহুদূরে চলে
আর আসিবে না ফিরে’।
সেই নব দেশে নব নদীকূলে
সে রাতের কথা ভাব কি গো ভুলে
ভেসে আসে কভু বাতাসের গায়
সে দিনের সৌরভ?
আজিকে নদীতে এসেছে জোয়ার
চিহ্ন নাহিকো শশী-তারকার,
মলমল জলে জ্বলে নাকো আর
পূর্ণিমা-উৎসব।
যাব নাকো সেথা আর,
যদিও লক্ষ্মীপূর্ণিমারাত
ফিরিবে পুনর্বার।
অতন্দ্র চোখে স্বপ্ন শিহরে
আজি বিষণ্ন রাতে,
শীতললক্ষ্যা তীরে গেছি মোরা
লক্ষ্মীপূর্ণিমাতে।।