লুইজ গ্লিক ও তাঁর কবিতা

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন মার্কিন কবি লুইজ গ্লিক। নোবেল জয়ের অনেক আগে তাঁর কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন শামস আল মমীন এবং তা ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয়, ২০০৫ সালে। সেই কাহিনির সূত্রে এই কবির কাব্যজগতে ফিরে তাকানোর প্রয়াসেই এই লেখা।

লুইজ গ্লিক
ছবি: সংগৃহীত

সাহিত্যে নোবেল কে পাচ্ছেন—এ নিয়ে জল্পনাকল্পনার অবসান হলো। নোবেল জয় করলেন মার্কিন কবি লুইজ গ্লিক। পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলাদেশের অনেককেই বলতে শুনেছি, না, এই কবির কবিতা তো পড়িনি। এর আগেও অনেকবার এমন ঘটেছে, নেবেল লাভ করেছেন আমাদের অপরিজ্ঞাত অনেক সাহিত্যিক। তাতে অবশ্য নোবেলের মহিমার হ্রাস-বৃদ্ধি কিছুই ঘটেনি। কিন্তু লুইজ গ্লিক, যিনি এ বছর নোবেল পেলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সুবাদে তাঁকে আমি জানতাম ঢের আগে থেকে। আজ থেকে ১৫ বছর আগে তাঁর দুটি কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদও করেছিলাম আমি, যা ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায়। সম্ভবত আমিই প্রথমজন, যে লুইজ গ্লিকের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছি। এখনো নানাজন নানা উচ্চারণে তাঁর নাম লিখছেন। ওই সময় সব মিলিয়ে আমি ২৫ জন আমেরিকান কবির কবিতা অনুবাদ করি, যার বেশির ভাগই প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল। অবশ্য এ গুচ্ছের দু-চারটি কবিতা সংবাদ-এও ছাপা হয়। পরে ২০০৯ সালে ওই সব কবিতার সমন্বয়ে সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা শিরোনামে অনন্যা প্রকাশনী থেকে একটি বইও বেরিয়েছে। যা হোক, যখন আমি লুইজ গ্লিকের কবিতা অনুবাদ করি, তখন নিশ্চয়ই জানতাম না যে একদিন তিনি নোবেল জয় করবেন। তবে এটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম, মার্কিন মুলুকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি তিনি। একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে।

এই কবির জীবনচিত্রে তাকালে দেখা যাবে, তিনি জন্মেছেন নিউইয়র্ক শহরে ১৯৪৩ সালে। আর বেড়ে উঠেছেন নিউইয়র্কের অদূরে, লং আইল্যান্ডে। হাইস্কুলে পড়ার সময়ই তিনি অ্যানারেক্সিয়া নার্ভালসা রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় সাত বছর পর সুস্থ হয়ে ওঠেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি শিক্ষকতাও করছেন।

হঠাৎ করেই কবি হয়ে ওঠেননি গ্লিক। শৈশবেই কবিতা লেখায় তাঁর হাতেখড়ি। প্রায় ৫০ বছর ধরে কবিতা লিখছেন। কবিতা ও প্রবন্ধ মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১২টি, ১১টি কবিতার, ১টি প্রবন্ধের। কবিতার জন্য আমেরিকার প্রায় সব প্রধান পুরস্কারই পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পুলিৎজার প্রাইজ, ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ মেডেল, ন্যাশনাল বুক পুরস্কার প্রভৃতি। ২০০৩-০৪ সালে গ্লিক ছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রীয় কবি।

তাঁর কবিতা বারবার মুগ্ধ করেছে কাব্যমোদী পাঠকদের। অনেকে তাঁকে আত্মজৈবনিক কবিও মনে করেন। গ্লিক তাঁর কবিতার আবেগ পাঠকদের বোধে পৌঁছে দিতে পারেন অবলীলায়। কারণ তাঁর কাব্যভাষা ও ভাবনা স্বতন্ত্র, সরল ও সুনিপুণ।

কবিতা লেখায় ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম মানেন না এই কবি। এমন সময়ও গেছে দীর্ঘ দুবছর কিছুই লিখতে পারেননি তিনি। আবার কখনো চার সপ্তাহেই একটা পুরো কবিতার বই দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। এসব অনিয়মই মূলত তাঁর নিয়ম, গ্লিক এভাবেই লিখে চলেছেন। নিজের কবিতার পাঠক বাড়ানোর প্রতিও কখনো আগ্রহ দেখাননি তিনি। কবিতা পড়া ও আলোচনার জন্য গ্লিক পছন্দ করেন ছোট ধরনের শ্রোতা/পাঠক সমাবেশ। তিনি আমেরিকার পোয়েট লরিয়েট পদ গ্রহণের আগে কর্তৃপক্ষকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, রেডিও-টেলিভিশনে তিনি সাক্ষাৎকার দেবেন না কিংবা বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করে কবিতার কোনো রকম প্রচারও করবেন না। তবে এর অর্থ এই নয় যে গ্লিক খুব নিভৃতচারী, আদতে তিনি তাঁর কবিতার ওপর কাউকেই খবরদারি করতে দিতে চান না।

নোবেল কমিটি কর্তৃক তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই কবির নামবিভ্রাট দেখা দিয়েছে। এটি হয়েছে তাঁর নামের শেষাংশ নিয়ে। অর্থাৎ নামের শেষাংশের উচ্চারণ—গ্লিক, গ্লুক নাকি গ্লাক—কোনটি সঠিক? আরও মজার বিষয় হলো, অনেকেই লুইজ (Louise)–কে ‘লুইস’ (Luis) উচ্চারণ করছেন ও লিখছেন, কিন্তু এ নিয়ে কেউই টু-শব্দটি করছেন না। এখানে বলা দরকার, গেল ৮ অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদক ডোয়াইট গার্নার তাঁর এক লেখায় এই কবির নাম বিভ্রান্তির আশংকা করে নাম উচ্চারণের ক্ষেত্রে সাবধান হতে বলেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, তাঁর সেই আশঙ্কা এখন সত্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে লুইজ গ্লিককে সবাই লুইস গ্লিক, গ্লুক বা গ্লাক লিখছেন। আদতে তাঁর নামের সঠিক উচ্চারণ হবে লুইজ গ্লিক।

তো, এবার একটু কৌতূহল মেটানোর পালা। ফেসকুকে যখন জানাজানি হলো, লুইজ গ্লিকের কবিতা বাংলা ভাষায় অনেক আগেই অনুবাদ করেছি আমি, তখন কৌতূহলবশত অনেকে জানতে চেয়েছেন, এই কবির খোঁজ আমি কীভাবে পেলাম? আর কেনই-বা অনুবাদ করলাম তাঁর কবিতা। বলে নেওয়া ভালো, নিউইয়র্কে আমি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত, ইংরেজি পড়াই। ফলে ছাত্রদের গল্প-কবিতা পড়াতে পড়াতে অনেক নতুন কবি ও কবিতার সন্ধান পাই এবং তাঁদের কবিতা অল্প কিছু করে অনুবাদও শুরু করি—এভাবেই চলছিল। এর মধ্যে ১৯৯৫ সালে প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান নিউইয়র্কে আসেন। এক আড্ডায় আমার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, কবিতা ছাড়া আর কিছু লিখি কি না? তাঁকে বললাম, এ যুগের আমেরিকান কবিদের কবিতা অনুবাদ করছি। কাদের কবিতা? জানতে চাইলেন তিনি। শ্যারন ওল্ডস, লেনার্দ নেইথান, লোরনা দে সেরভান্তেসসহ অনেকের নামই সে সময় বলেছিলাম তাঁকে। জবাবে কবি বললেন, এঁদের কারও নাম আমি শুনিনি। তাঁকে বললাম, কবিতায় যাঁরা প্রবাদপ্রতিম নন অথচ প্রতিভাবান এবং যাঁদের কবিতা বর্তমান আমেরিকার সাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে তঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই এ ক্ষেত্রে আমার একমাত্র মতলব। আরও বলি, হুইটম্যন, এলিয়ট, গিন্সবার্গ বাংলাদেশে বহুল পরিচিত ও পঠিত। ফ্রস্টের কবিতা আপনি নিজেই অনুবাদ করেছেন। তবে সমকালীন বিদেশি কবিদেরও তো চেনা দরকার।

আমার কথা শুনে স্বল্পভাষী শামসুর রাহমান অল্প কথায় বললেন, ‘আইডিয়াটা ভালো।’

সেই কবিতাগুলো দিয়েই সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা বইটি প্রকাশিত হয়, যেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল গ্লিকের দুটি কবিতাও।

গ্লিকের কবিতা যেন ‘জীবন ঘষে শিল্প’ হয়ে উপস্থিত হয় আমাদের সামনে। আবেগ ও ভাবালুতাকে সঙ্গী করে বারবার যেন যাপিত জীবনের তটেই ফিরে আসেন তিনি। স্বভাবতই তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে আসে আমাদের নিত্যদিনের চাওয়া-পাওয়া, ছেলেবেলা, হারানো ভালোবাসা, যৌনতা, মৃত্যু, প্রকৃতি ও প্রেম। সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে নতুনভাবে উপস্থিত হয় পুরাণও। সব মিলিয়ে এই কবির কবিতার মধ্যে আছে সাধারণ—খুবই সাধারণ এক সুর। আর এই সুরটি একই সঙ্গে আমাদের চেনা আবার অচেনাও। বোধ করি এসব কারণেই গ্লিকের কবিতা সাধারণ হয়েও ‘অসাধারণ’।

লুইজ গ্লিক প্রশংসা আর সবার চোখে চোখে থাকা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই ভালোবাসেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আই অ্যাপ্রিহেন্ড অ্যাক্লেইম,’ আই থিঙ্ক, ‘আহ, ইটস আ ফ্ল ইন দ্য ওয়ার্ক’।

কিছুদিন আগেও তাঁর বাসার পাশের রাস্তাটা কী নির্জন আর নিরিবিলি ছিল। এখন সেখানে রেডিও-টেলিভিশন আর রিপোর্টারদের ক্যামেরা তাঁর দিকে তাক করে থাকে দিনভর।

কারও কারও মনে এখনো সন্দেহ, লুইজ গ্লিক কি আদতেই নোবেল পাওয়ার যোগ্য? উত্তরে বলি, ভুলে গেলে চলবে না, আমেরিকার প্রায় সব কটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কারই ইতিমধ্যে তিনি পেয়েছেন তাঁর কবিতার শৈল্পিক সৌন্দর্যের জন্য। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদক ডোয়াইট গার্নার এ ব্যাপারে বলেন, লুইজ গ্লিককে নির্বাচন করে একাডেমি একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর আমি বলি, কবি লুইজ গ্লিক সগর্বে বলতেই পারেন, ‘গিভ মি মাই ড্যাম রেসপেক্ট’।