অপেক্ষায় আছি

কী বিপন্ন দিন আমার, কী বিষাদের রাত্রি! কী নিরন্নের দিন আমাদের, কী দহনের কাল!
দরজার ওপারে করোনার কড়া নাড়া, ভেতরে-বাইরে বেরোবার দুর্বার বাসনা। যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব? এ যাওয়া যে মৃত্যুর অধিক! মনকে প্রবোধ দিই, থামো শংকর, অপেক্ষা করো মৃত্যুহীন দিনের জন্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মরিতে না হইলে বাঁচিয়া থাকিবার কোনো মর্যাদাই থাকিত না।’ এ এক মহৎ মরণের মাহাত্ম্যকীর্তন। কিন্তু সারা পৃথিবীতে আজ যে মৃত্যুর হিংস্র, নিষ্ঠুর, লোমশ উপস্থিতি, তা তো অসহনীয়।
এই অসহনীয় অসহায়তার মধ্যে আমার নিত্যদিনের বিষণ্ন জীবযাপন। ‘যারে মরণ–দশায় ধরে,/ সে যে শতবার করে মরে’—প্রতিদিন শতবার করে মরছি আমি। টেলিভিশন যখন বলে, আজ পর্যন্ত এক লাখ পঁচাশি হাজার সাত শ পঁয়ত্রিশ জনের মৃত্যু হলো, তখন একবার মরি আমি। যখন নারায়ণগঞ্জ থেকে মাসুদা বেগম নামের একজন আকুল কান্নার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর স্বামীর মৃত্যু সংবাদ দেন, তখন আরেকবার মরি আমি। যখন গর্ভজাত সন্তানেরা করোনা–সংক্রমিত হবার আতঙ্কে জননীকে অরণ্যে ফেলে আসে, তখন আরও একবার মরি আমি।
আচ্ছা, মৃত্যু কারে কয়? আমি তো রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে পারি না, ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান।’ কারণ, আমার ভেতরের বাসনা যে এখনো মরেনি!
আচ্ছা, মৃত্যুর আর কী কী নাম হতে পারে? মরণ, প্রাণত্যাগ, জীবননাশ, দেহান্ত, প্রাণনাশ, পরলোকগমন—এই তো! আমি ভাবলাম, মৃত্যু শব্দটি দিয়েই এক শ সাঁইত্রিশটি বিশেষ্য পদ তৈরি করা যায়। বিশেষণ, ক্রিয়াপদও হয় অনেকগুলো। হিন্দু পুরাণে ‘মৃত্যু’ নামের একজন দেবতাই আছেন।
আজ সারা বিশ্বে মৃত্যুর যে রণহুংকার শুনছি, তা কখন থামবে? নাকি তার দুর্বার অগ্রগমন চলতেই থাকবে?
শুনেছি, মৃত্যুও মানুষকে সতর্ক করে, নিষ্ঠুর মনকে কোমল করে, অমানবিককে মানবিক করে। তা–ই যদি হয়, তাহলে নেতার ব্যক্তিগত গুদামে দরিদ্র মানুষের আহার্য কেন? কেন জনপ্রতিনিধির গৃহকোণে গরিব মানুষের চাল–ডাল–তেল! তারা কি মৃত্যুকে ভয় পায় না? ধর্মের ভীতি কি তাদের মনে নেই?
না, পায় না। এসব প্রচণ্ড পাষণ্ডেরা মৃত্যুভয়ের তোয়াক্কা করে না।
মহাভারতের একটা কাহিনি মনে পড়ে গেল। বলি—
পঞ্চপাণ্ডব চৌদ্দ বছরের বনবাসে তখন। অজ্ঞাতবাস। দুর্যোধনদের হাতে ধরা পড়লে আরও চৌদ্দ বছর। বনে–বনান্তরে ঘুরে ফিরছেন যুধিষ্ঠিররা। তীব্র এক দুপুর। পথক্লান্তিতে ভাইয়েরা তৃষ্ণার্ত। অদূরের সরোবর থেকে জল আনবার দায়িত্ব পড়ল নকুলের ওপর। সময় বয়ে যায়, জল নিয়ে নকুল আর ফেরেন না। এরপর নকুলের সন্ধানে সহদেবকে পাঠালেন যুধিষ্ঠির। সহদেবেরও একই অবস্থা, ফিরে আসেন না। এরপর গেলেন অর্জুন, ভীম। বহুক্ষণ পর চিন্তিত যুধিষ্ঠির পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সরোবরের দিকে। তৃষ্ণার্ত যুধিষ্ঠির আঁজলা ভরে জল খেতে উদ্যত হলে পেছন থেকে বকরূপী ধর্ম বললেন, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জল খেয়ো না যুধিষ্ঠির। যদি খাও, তোমার ভাইদের মতন অবস্থা হবে তোমার। ওই দেখো, তোমার ভাইদের কী দশা হয়েছে।’
যুধিষ্ঠির ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন, অর্জুনাদি ভাইদের মৃতদেহ জলে ভাসছে। যুধিষ্ঠির বুঝলেন, প্রশ্নকর্তা নিতান্ত বক নন, বকরূপী অন্য কেউ। যুধিষ্ঠির বকের প্রশ্নের উত্তর দিতে সম্মত হলেন। বক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিমাশ্চর্যম্!’ অর্থাৎ যুধিষ্ঠির, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্যের কী?
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আমাদের চারপাশে, এমনকি নিজ আলয়ে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। দেখছি আমরা। দেখছি আর ভাবছি, যদু–মধু–রাম–শ্যাম মারা গেলেও আমি মারা যাব না। আমি অনন্তকাল বেঁচে থাকব। মানুষের এই যে মূর্খামি, এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের।’
আমরা তো এ রকম করেই ভেবে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। সবাই করোনায় আক্রান্ত হলেও আমি হব না। সবাই মারা গেলেও আমি অমর থাকব।
তা নইলে কেন রাস্তায়, অলিতে–গলিতে এত মানুষের উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো! কেন আমরা আজ আইন অমান্যের প্রতিযোগিতায় নেমেছি!
আমার বুক কেঁপে যাই। বুক কাঁপে এ জন্য যে, আনিসুজ্জামান, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মোহিত কামাল, তপন বাগচী, রফিকুর রশীদ—আমার প্রিয় মানুষেরা ভালো আছেন তো, সুস্থ আছেন তো?
আমার বুক কাঁপে আমার পুত্রটির জন্য, পুত্রবধূটির জন্য। এরা এখন জীবন বাজি রেখে ঢাকার জাতীয় হৃদ্রোগ হাসপাতালে এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
এই অসুস্থ্ দিন, এই বিষাদ–রাত্রির অবসান হবে একদিন। আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি।