আনিসুজ্জামান: আলোর মানুষ মজার মানুষ

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

ছবি: অন্য আলো

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন আমার প্রেরণা, বিস্ময় ও শ্রদ্ধার মানুষ। এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। স্যারের ভালোবাসার এক অসাধারণ জাদুকরি ক্ষমতা ছিল। আমার মতো অনেকেই মনে করতেন, স‌্যার তাঁকেই বেশি ভালোবাসেন।

আমি স্যারের ছাত্র ছিলাম না। ছাত্র হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ, আমি পড়েছি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্যার শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রাম আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপরও স্যারের অপরিসীম ভালোবাসা আমি অনুভব করেছি প্রতিমুহূর্তে।
সরোজিনী সাহু নামে ওডিশার একজন বিখ্যাত লেখকের বই অনুবাদিত হয়ে ঢাকার অনুপম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হবে। আমি আনিস স্যারকে অনুরোধ করলাম সেই বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে আসার জন্য। সরোজিনী দিদি ঢাকা এসেছিলেন। লেখক মোরশেদ শফিউল হাসান ছিলেন তাঁর ঢাকার হোস্ট।

আনিস স্যার তাঁর বক্তৃতায় বললেন, ‘ঢাকা শহরে আমার কয়েকজন প্রভু আছেন। তাঁরা যা আদেশ করেন, আমি তা-ই পালন করি। আনিসুল হক তাঁদের একজন। আনিসুল হক আমাকে এই অনুষ্ঠানে আসতে বলেছেন। আমি তাঁর আদেশ পালন করতে এসেছি।’

আমি কীভাবে স্যারের ভালোবাসার ছায়াতলে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম, আজ আর মনে নেই। যেহেতু আমি ১৯৮৯ সাল থেকেই ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকা, ১৯৯০-এর পর ‘কাগজ’, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ‘ভোরের কাগজ’-এ ছিলাম, কাজেই ‘কাগজ’-এর মাধ্যমেই স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হবে, তা–ই হয়তো স্বাভাবিক। আমি আমার প্রকাশিত বই নিয়ে ফুলার রোডে স্যারের বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে হাজির হতাম। বেবি ভাবি আমাকে খেজুরের গুড়ের সন্দেশ খেতে দিতেন। স্যার আমার গদ্যকার্টুন নিয়মিত পড়তেন। ভালো লাগার কথা দেখা হওয়ার পর বলতেন। কখনো কখনো ফোন করেও জানাতেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করায় জগন্নাথ হলের ছাত্ররা প্রহৃত হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে, বইমেলার উদ্বোধনী দিনে। আমি একটা কলাম লিখেছিলাম। স্যার প্রশংসা করেছিলেন। আবার একবার একটা গদ্যকার্টুনে সবকিছুর নাম বদলে দেওয়ার প্রবণতার কঠোর সমালোচনা করেছিলাম, সেটা পড়ে তিনি বলেছিলেন, একটু বেশি কড়া হয়ে গেছে।

১৯৯৮ সালে আমরা ‘প্রথম আলো’ শুরু করি। স্যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন। মেরিল-প্রথম আলো অনুষ্ঠানেও আসতেন। ২০০৩ সালে আমার ‘মা’ উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এটি পড়ার পর বেবি ভাবি—সিদ্দিকা জামান আমার বিশেষ রকমের ভক্ত হয়ে পড়েন। তিনি একটার পর একটা ‘মা’ কেনেন এবং তাঁর প্রিয়জনদের উপহার দিতে থাকেন। ঘরের লোক আমার পাঠক হয়ে পড়ায় বোধ হয় আনিস স্যারের পক্ষে আমার প্রতি স্নেহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

‘মা’ প্রকাশের পর আমরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সেগুনবাগিচা চত্বরে একটা অনুষ্ঠান করি। আজাদের মা এবং আজাদের চিঠিপত্র, বই, ছবি ইত্যাদি সে সময় আমরা হস্তান্তর করেছিলাম জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে। এতে মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ, হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, শিমূল ইউসুফ, আজাদের চাচাতো ভাই ফেরদৌস আহমেদ জায়েদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আর সভাপতিত্ব করেছিলেন আনিসুজ্জামান স্যার।

আনিস স্যার ‘প্রথম আলো’ (কিংবা ‘ভোরের কাগজ’) পত্রিকায় লেখা দিয়ে প্রুফ দেখতে নিজে চলে আসতেন পত্রিকা অফিসে। সেই মুহূর্তটা ছিল আমাদের জন্য বিশেষ আনন্দের। আমরা গিয়ে স্যারের পাশে হাজির হতাম। স্যার এক কাপ দুধ ছাড়া কফি চাইতেন। সেটা নিয়ে আমাদের কেউ হাজির হলে পকেট থেকে স্যার বের করতেন সুইটেনার। চামচে নেড়ে কফি খেতে খেতে প্রুফ দেখতেন। প্রুফ দেখা হয়ে গেলে স্যার মজার মজার গল্প করতেন। তাঁর প্রতিটি কথায় থাকত সূক্ষ্ম রসবোধ।

আনিসুজ্জামান
ছবি: অন্য আলো

আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে আমি আমেরিকায় ভ্রমণ করেছি, দুবার। একবার মুক্তধারার বইমেলা নিয়ে নিউইয়র্ক, ডালাস, লস অ্যাঞ্জেলেস। আরেকবার ফোবানার অনুষ্ঠানে হিউস্টন।

স্যারের সঙ্গে থাকা মানে মজার মজার কথা শুনতে পারা।

একটা কথা বলে রাখি। স্যার কিছুতেই তাঁর ব্যাগে হাত দিতে দিতেন না। নিজের ব্যাগ তিনি নিজেই বহন করতেন।

২০০৭ সালে মুক্তধারার আমন্ত্রণে আমেরিকা সফর শেষে ফিরে এসে লিখেছিলাম। ব্যক্তি আনিসুজ্জামান, প্রাজ্ঞ আনিসুজ্জামান ও রসিক আনিসুজ্জামানকে বোঝার জন্য সেই লেখা পুরোটাই তুলে ধরা যাক:

আমি খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। স্যারের হাত-পা কিছু ভাঙল নাকি! স্যারের স্মৃতিশক্তি, মনের জোর, চলাফেরার শক্তি একজন তরুণের পক্ষেও ঈর্ষণীয় কিন্তু বয়স তো আসলে মনের বন্ধন মানবে না।
স্যারের কাছে দৌড়ে গেলাম। স্যার মোটামুটি একটা ডিগবাজি খেয়েছেন। পায়ের খানিকটা কেটে গেছে, রক্তও বেরোচ্ছে।

কমেডি না ট্র্যাজেডি

‘আমাদের দলে সবচেয়ে তরুণ কে? আনিসুজ্জামান স্যার। এই বয়সেও তিনি আমাদের আগে হাঁটেন, আমাদের চেয়েও বড় রসিকতা করেন এবং শারীরিক ধকলও নিতে পারেন। আনিসুজ্জামান স্যার উঠেছিলেন ফাহিম রেজা নূরদের বাসায়। তারিক সুজাত আর মাহমুদুজ্জামান বাবু এক বাসায়। আমি উঠেছি যথাপূর্বং মঞ্জু-সীমাদের ওখানে।

মঞ্জুরুল ইসলাম আমাদের বন্ধু, সাংবাদিক, প্রাক্তন সহকর্মী আর এখন নিউইয়র্ক এটিএন বাংলার কর্ণধার। (কর্ণধার শব্দের আসল মানে আমি জানি না, আমার ধারণা, যিনি কান ধরে থাকেন। মঞ্জুরুল ইসলাম এটিএন বাংলা নিউইয়র্কের কান না ধরলেও হাল যে ধরেছেন, তাতে আমার সন্দেহ নেই)।

মঞ্জুর নেতৃত্বে আমরা যাব আটলান্টিক সিটিতে। নিউইয়র্ক শহর থেকে ঘণ্টা চারেক গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে ওই শহরটি প্রধানত জুয়াড়িদের আকর্ষণ করার জন্য তৈরি। কিন্তু আমাদের মতো ডাল-ভাত টাইপ বাঙালিরাও ওই শহরে যেতে পারে, নানা ধরনের থিমেটিক হোটেল দেখার জন্য। একেকটা হোটেল একেক থিমের ওপরে বানানো, কোনোটার থিম তাজমহল, কোনোটার থিম মিসরীয় সভ্যতা। সে এক চোখধাঁধানো এলাহি কাণ্ড।

আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত বেশি হয়ে যাবে। রাতে থাকব ওখানে। পরের দিন আবার রওনা হব সকাল সকাল। এই ধকল কি সইতে চাইবেন আনিসুজ্জামান স্যার। ‘স্যার, থাকবেন, নাকি আমাদের সঙ্গে যাবেন?’ স্যার সঙ্গে সঙ্গে রাজি। যাবেন। এর আগেও স্যার গিয়েছিলেন আটলান্টিক সিটিতে, বঙ্গ সম্মেলনে।

একই গাড়িতে বড় মানুষদের পাশাপাশি পেলে আমি একটু সবক নিয়ে নিতে চাই। আমি পড়াশোনা করেছি বুয়েট থেকে, ওখানে শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-সভ্যতা নিয়ে পড়ার সুযোগ পাইনি। বই পড়ে নিজে নিজে বোঝার চেষ্টা করি। কাজেই প্রায় কিছুই বুঝি না, আর যা বুঝি, ভুল বুঝি। বড় মানুষকে কাছে পেলে কিছু প্রশ্ন জিগ্যেস করে তাঁর মতটা জেনে নেওয়া যায়। যেমন গাড়িতে বাজছে মৌসুমী ভৌমিকের গান। একটু পরেই অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন দি যশোর রোড’ বাজতে লাগল। স্যারকে বললাম, ‘স্যার, ধরেন এই গানটা। কবিতা হিসেবে এটার খুব ভালো বলে গণ্য হওয়ার কথা না, কারণ গানটা উপদেশমূলক।’ “কাকে বলি আজ মৃত্যু থামাও” বলে এর একটা উপসংহারও দেওয়া আছে। কবিতার ক্ষেত্রে শব্দকেই যাঁরা মনে করেন লক্ষ্য, যেমন মালার্মে, তাঁদের দলের-কবিতায় এই উপদেশ থাকার কথা নয়। কিন্তু এই যে আমেরিকার এক কবি কবে এটা লিখেছিলেন, সেই একাত্তরে, আজ ৩৬ বছর পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভাষার মানুষ সেটা অনুবাদ করে গাইছে, আর আমরা সেটা কী আকুল হয়ে শুনছি, এটার কি কোনো মূল্য নেই?’
স্যার জবাব দিয়েছিলেন, ‘নিশ্চয়ই এটা মূল্যবান।’

‘প্রথম আলো’ অফিসে আনিসুল হকের টেবিলে আনিসুজ্জামান
ছবি: সংগৃহীত

যা-ই হোক, যে গল্প বলার জন্য এই প্রসঙ্গ এল, তা হলো ক্লান্তিকর ভ্রমণ, রাতজাগা ইত্যাদি সত্ত্বেও দেখতে পেলাম, আনিসুজ্জামান স্যারই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তপোক্ত আছেন।

নিউইয়র্কে মুক্তধারার অনুষ্ঠান হচ্ছে দুটো হলে। একটা হলে আলোচনা, যেখানে দর্শকসংখ্যা খুবই কম। আরেকটা হলে সংগীতায়োজন, গান গাইবেন হাবিব, সেটার প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। ওই বড় মঞ্চেই গবেষক-লেখক গোলাম মুরশিদের সংবর্ধনা। হাসান ফেরদৌস, আনিস স্যার, গোলাম মুরশিদ প্রমুখের সঙ্গে আমিও উঠেছি।

দাঁড়িয়েই সংবর্ধনা বচন পঠিত হলো, পর্দায় ভিডিও ছবিও দেখানো হলো গোলাম মুরশিদ সাহেবের ওপরে। তাঁকে সম্মাননা হিসেবে উত্তরীয় পরানো হলো। কৃত্য শেষে বাতি নিবিয়ে দেওয়া হলো। প্রায় অন্ধকারের মধ্যে আমরা মঞ্চ থেকে নেপথ্যে চলে আসছি। হঠাৎই মেঝেতে রাখা ইয়া বড় একটা স্পিকারে পা বেধে পড়ে গেলেন আনিসুজ্জামান স্যার।

আমি খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। স্যারের হাত-পা কিছু ভাঙল নাকি! স্যারের স্মৃতিশক্তি, মনের জোর, চলাফেরার শক্তি একজন তরুণের পক্ষেও ঈর্ষণীয় কিন্তু বয়স তো আসলে মনের বন্ধন মানবে না।

আনিসুজ্জামান স্যারের মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। স্যারের জীবন ও কর্ম নিয়ে স্কলারলি লেখা হয়নি বললেই চলে। যা হয়েছে, তার সবই স্মৃতিচারণামূলক।

স্যারের কাছে দৌড়ে গেলাম। স্যার মোটামুটি একটা ডিগবাজি খেয়েছেন। পায়ের খানিকটা কেটে গেছে, রক্তও বেরোচ্ছে।

তিনি উঠলেন কারও সাহায্য ছাড়াই এবং বলতে লাগলেন, ‘আমি ঠিক আছি, আমি ঠিক আছি।’

তাঁর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে মিলনায়তনের বাইরে আসছি। তিনি বললেন, ‘ট্র্যাজেডি আর কমেডির পার্থক্য জানো?’
‘স্যার!’

‘শোনো, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ইন্টারভিউ নিচ্ছেন মুজিবুর রহমানের (বেতারশিল্পী, পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)। জিগ্যেস করলেন, ট্র্যাজেডি আর কমেডির পার্থক্য কী?

মুজিবুর রহমান বললেন, ধরা যাক, আমি মধুর ক্যানটিন থেকে আসছি। কলার খোসা পায়ের নিচে পড়ল, আর আমি পিছলে পড়ে গেলাম। তাহলে এটা কমেডি।

আর আমার জায়গায় যদি আপনি পড়তেন, তাহলে সেটা হতো ট্র্যাজেডি।

কারণ, এটা হচ্ছে মহতের পতন।

আনিসুজ্জামান স্যারের মনের জোর আর রসবোধের পরিচয় আবারও পেয়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম।

যাক, স্যারের এই পা হড়কে পড়ে যাওয়াটা মহতের পতন হলেও শেষতক ট্র্যাজেডি বলে গণ্য করতে হলো না। এটাকে আমরা কমেডি হিসেবেই নিতে পারলাম। কারণ, স্যার ভেঙেও পড়েননি, হাত-পাও ভাঙেননি।

রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত আর পাদরি সাহেবের সেমিনার

মুক্তধারার এই বাংলা উত্সবের প্রধান ঘটনা ছিল সেমিনার। কিন্তু প্রধান আকর্ষণ ছিল সংগীতায়োজন।

আগেই যেমনটা বলেছি, সেমিনারে শ্রোতাসমাগম হতো খুব কম। কিন্তু তাতে সেমিনারের গুরুত্ব বা গৌরব কোনোটাই কমেছে বলে আমি অন্তত মনে করি না। ঢাকা থেকে যাওয়া প্রকাশকেরা ফরিদ আহমেদ, মনিরুল হক আর আহমেদ মাহমুদুল হক, তারিক সুজাত, মাহমুদুজ্জামান বাবুসহ আমরা বসে পড়তাম দর্শকসারিতে, কখনোবা মঞ্চে। কথা বলছেন হয়তো সমরেশ মজুমদার, সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান, প্রশ্ন করছেন জ্যোতির্ময় দত্ত, তাঁর পাশেই হাসান ফেরদৌস আর রাবেয়া খাতুন, তর্ক জমে উঠলে মুখ খুলছেন গোলাম মুরশিদ। আর বইমেলার নামে সবকিছু হলেও বইমেলার অংশটাই ছিল সবচেয়ে নিষ্প্রভ। কারণ, প্রকাশকেরা ঢাকা থেকে মাস দুয়েক আগে জাহাজে করে অনেক অনেক বই চালান করেছিলেন, সেসব নিউইয়র্ক সমুদ্রবন্দরে পড়ে ছিল, ছাড়ানো যায়নি। এই নিয়ে প্রকাশকেরা অনেকটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন।
হয়তো আমার সঙ্গে যাওয়া মঞ্জুরুল ইসলাম বা উদ্যোক্তাদের মধ্যে ফাহিম রেজা নূর বা প্রথম আলো বন্ধুসভার কর্মীরাও দর্শকসংখ্যা বৃদ্ধি ও দর্শকমানকে উন্নততর করেছেন।

তা সত্ত্বেও আমাদের মন ভরে না। সেমিনারে দর্শকসংখ্যা কম থাকবে কেন?

তখন আনিসুজ্জামান স্যার আমাদের সান্ত্বনা দিলেন একটা ঘটনা বলে।

‘রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বক্তৃতা দেবেন। সভাপতি একজন পাদরি। নির্দিষ্ট সময়ে দুজনেই অনুষ্ঠানস্থলে হাজির। কিন্তু শ্রোতা বলতে একটা কাকপক্ষীও নেই। সভাপতি বললেন, হবে হবে। শ্রোতা আসবে। কেউই আসে না। বৃষ্টি শুরু হলো। কিছু মানুষ এসে ঢুকল ওই ভবনে। এবার শ্রোতা হবে। তা–ও হয় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিলিয়ার্ড খেলা হচ্ছে, বৃষ্টিতাড়িত আশ্রয়প্রার্থীরা সবাই খেলা দেখছে। তখন রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বললেন, সেমিনার বাতিল করে দিন।

সভাপতি বললেন, না, হবে। আপনি বক্তৃতা আরম্ভ করুন। বক্তা বক্তৃতা করলেন। সভাপতি হাততালি দিলেন। তারপর সভাপতির ভাষণ। শেষ হলে বক্তা হাততালি দিলেন। ধন্যবাদ দিয়ে সভাপতি অনুষ্ঠান শেষ করলেন।’

দুই আনিস—আনিসুজ্জামান ও আনিসুল হক
ছবি: সংগৃহীত

ডালাসে এক রাতে স্যারের মনে হলো আইসক্রিম খেতে হবে। আমাকে রুম থেকে ডেকে বের করে বললেন, ‘চলো, আইসক্রিম খেতে যাই।’ দুজনে বের হলাম। ডাউনটাউন। সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। একটা ছোট্ট দোকানে কাপ আইসক্রিম পাওয়া গেল। তাতেই সই।

স্যারের এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বলেছিলাম, স্যারের সঙ্গে আমার কতগুলো মিল আছে। স্যারের নামও আনিস, আমার নামও আনিস, স্যারের স্ত্রীর নাম বেবি, আমার স্ত্রীর নামও বেবি, স্যারের বিবাহবার্ষিকী ১ অক্টোবর, আমারও ১ অক্টোবর।

তবে আনিসুজ্জামান স্যারের মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। স্যারের জীবন ও কর্ম নিয়ে স্কলারলি লেখা হয়নি বললেই চলে। যা হয়েছে, তার সবই স্মৃতিচারণামূলক। সাজ্জাদ শরিফ, মোহাম্মদ আজমের লেখায় কিছুটা হয়তো স্যারের লেখার বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা এবং তাঁর প্রভাবের কথা এসেছে। একটা ভালো প্রবন্ধ পড়েছিলাম ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এ, লিখেছেন টমাস নিউবোল্ড। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক, যার বিষয় ইতিহাস। প্রবন্ধটির নাম: ‘আনিসুজ্জামান, দ্য আনএক্সপেক্টেড হিয়ার’।
আনিসুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, স্বাধিকার আন্দোলনে অগ্রণী ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন, গণ–আদালত করতে গিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচারে সাক্ষ্য দিতে আদালতে গেছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কনভেনশন করেছেন—তাঁর এই সব কর্মকাণ্ড এত বড় হয়ে ওঠে যে তিনি যে আমাদের সবচেয়ে স্বচ্ছ চিন্তার বুদ্ধিজীবী, যাঁর লেখালেখির মূল্য অপরিসীম, এই কথাটা বলার আর অবকাশ পাওয়া যায় না। অথচ বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জন্ম, এর দার্শনিক ভিত্তি বুঝতে হলে আনিসুজ্জামানের জীবন ও সাহিত্যকে বিচার-বিশ্লেষণ করতেই হবে। সেটা করার যোগ্যতা যেমন আমার নেই, তেমনি এই কলাম সে চেষ্টা করার উপযুক্ত জায়গাও নয়।

আনিসুজ্জামান স্যার প্রথমে কোমরের ব্যথায় শয্যাশায়ী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। সেই সময় তাঁকে দেখতে পিজি হাসপাতালে যেতাম। স্যার সেরে উঠলেন। আবারও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। করোনার মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। প্রথমে ছিলেন ইউনির্ভাসাল হাসপাতালে। তখন আর তাঁকে দেখতে যেতে পারিনি। স্যারের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতাম তাঁর ছেলে আনন্দর কাছ থেকে। কখনোবা ভাবির কাছ থেকে। কিন্তু স্যার মারা গেলে (১৪ মে ২০২০) তাঁকে দেখতে যেতে পারিনি, তাঁর শেষকৃত্যে অংশ নিতে পারিনি, এই দুঃখ কোনো দিনও যাবে না। স্যার ‘মা’ বইয়ের ওপরে একটা আলোচনা লিখেছিলেন। ২০২০ সালের শেষে ‘মা’ বইয়ের ১০০তম মুদ্রণ বেরোল, সেই আলোচনাটা বইটিকে মূল্যবান করে তুলল। শুধু আনিসুজ্জামান স্যারের হাতে ১০০তম ‘মা’ তুলে দিতে পারলাম না।

আমি স্যারের অভাব রোজ অনুভব করি। এটা কেউ বিশ্বাস করবে কি না জানি না, আমি প্রতিদিন আনিসুজ্জামান স্যারকে মিস করি। স্যারের বইগুলোর জন্য আমার একটা আলাদা শেলফ আছে। মার্কার দিয়ে সেখানে লিখে রেখেছি—আনিসুজ্জামান। স্যারের মৃত্যুর পরেও স্যারের বই বের হচ্ছে। বইগুলোর পাতা ওলটাই আর বারবার করে ভাবি, এত জ্ঞানী, এত বিদ্বান এবং এত সহজ করে বলতে ও লিখতে পারা মানুষটা আমার মতো অকৃতী অধমের সঙ্গে কথা বলতেন কেন? আমার ফোন ধরতেন কেন?
স্যারের মূল্যবান সময় কত কত নষ্ট করেছি, ভেবে এখন শোচনা হয়!